Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেষ রূপকথা: নিষ্ঠুর পৃথিবীর এক চরম বাস্তবতার আখ্যান  

রূপকথা? সে তো কাল্পনিক, অসম্ভব আর অবাস্তবের গল্প। সে তো ছোট্ট শিশুকে নিষ্পাপ স্বপ্নের মাঝে মেঘের দেশ ঘুরিয়ে আনার আখ্যান। কিন্তু দরিদ্রতা, শ্যামল এই পৃথিবীর হয়ে যাওয়া প্রতিনিয়ত দূষণ, বিষাক্তকরণ, রোগ, শোক, অন্যায় আর শোষকের নিয়ত শুষে যাওয়া গরীবের শেষ রক্তবিন্দু- সে তো কোনো রূপকথা নয়। রূপকথা নয় মানুষের অসহায়ত্ব, একটি দুর্বল কাঁধে পুরো পৃথিবীর বোঝা।

লোভ আর স্বার্থ মানুষকে যে কত নিচে নামিয়ে দিচ্ছে, মমতাময়ী পৃথিবীর শিরায় শিরায় মানুষ যে চরম দূষণ ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তা তো কোনো অসত্য, অবাস্তব গল্প নয়। মানুষই এই ধরণীর সকল দূষণের মূল হোতা। আর পৃথিবীর সমস্ত পবিত্রতাই যেন সেই বিষক্রিয়ার প্রধান শিকার। এজন্য মানবজীবন ও পৃথিবীর এই গভীর অনুধাবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা আবুল বাশারের ‘শেষ রূপকথা’ কাল্পনিক কোনো রূপকথা নয়, বরং বাস্তবতার কালি দিয়ে লেখা এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতা। লেখকের গভীর চিন্তাধারার ছাপ পাওয়া যায় এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়। কলমের খোঁচায় এভাবেই উঠে এসেছে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতার বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা-

“কোনো সভ্যতা কখনো অহিংসার দ্বারা নির্মিত হয়নি। গণতন্ত্র একটি চমৎকার সভ্যতা, কিন্তু তা-ও এসেছে রক্তের পথ ধরে এবং অবশেষে তারই গর্ভে জন্ম নিয়েছে দুর্বৃত্ততন্ত্র। সে মানুষের হাতে অস্ত্র দেয় না, দেয় শয়তানের হাতে।”

পৃথিবীর পরতে পরতে মানুষই ভরেছে বিষ আর অন্যায়; Source: prothomalo.com

‘শেষ রূপকথা’ বইটিতে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে লেখক যেন বলে গেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবন, মন ও মনন, ঘরে-বাইরে সর্বত্র মানুষের চিরাচরিত প্রকৃতির এক তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের আখ্যান। জীবনের প্রতি সংবেদনশীল মনের অনুধাবন তিনি প্রকাশ করেছেন সুনিপুণভাবে-

“স্বার্থ জিনিসটা বাধাগ্রস্ত হলে সাপের লেজের মতো হয়ে ওঠে, পা পড়লেই ফুঁসে উঠে ছোবলাতে চায় সাপটা। সে বন্ধুকে বোঝে না, বন্ধুকে ব্যবহার করে, ছোবলায়। স্বার্থ একটি অন্ধ সাপ, ত্বক দিয়েও সে শোনে কোথায় কী।”

নকশাল আন্দোলন পরবর্তী ভারতবর্ষ তখন অতি দ্রুত শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকছে। দরিদ্রতার আঘাতে জর্জরিত ভারতে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গড়ে ওঠা ছোট ছোট কারখানাগুলো মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর এক ভয়াবহ অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। নিকট অতীতেই ঘটে যায় ভুপাল গ্যাস দুর্ঘটনার মতো ইতিহাসের মর্মান্তিক এক মানবসৃষ্ট প্রাণঘাতী বিপর্যয়। এমনই এক সময়কে মাথায় রেখে রচিত হয় আবুল বাশারের এই উপন্যাসটি, নাম ‘শেষ রূপকথা’ হলেও চরম বাস্তবতাই এর মূল উপজীব্য।

কৃষ্ণ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। একদিকে সে অত্যন্ত সংবেদনশীল, অন্যদিকে সুমতি-কুমতির দ্বৈতসত্ত্বার দ্বন্দ্বে জর্জরিত এক মানুষ। দরিদ্রতা আর সাংসারিক দায়িত্বের কাছে নিরুপায় কৃষ্ণ দুই বন্ধুর সম্পদ ও সাহায্যে লোকালয়ের মধ্যে নিজের বাড়ির পাশেই গড়ে তোলে রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা। জীবিকার সাথে ধীরে ধীরে এই কারখানা হয়ে ওঠে রাসায়নিক বিষেরও অন্যতম উৎস, আর এই ধাতব বিষে ভরে যেতে থাকে কৃষ্ণের জীবন। অংশীদার হয়েও কৃষ্ণ এখানে শ্রমিক, কাজ করে আরেক শ্রমিক প্রকাশের সাথেই। অংশীদার অন্য ধনী বন্ধুরা কারখানার অংশ হয়ে বিষ থেকে দূরে থাকলেও বিষের মাঝে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকে কৃষ্ণ আর প্রকাশের জীবন। একসময় চাইলেও কৃষ্ণ আর থামাতে পারে না কারখানার বিষক্রিয়া, আবার নিজেকে মুক্ত করতে পারে না বিবেকের মুহূর্মুহূ ছোবল থেকেও। ধ্বংসের পথে তারই পুর্বসূরী প্রকাশের দিকে তাকিয়ে তাই একসময় কৃষ্ণের মনে হয়-

“জীবিকা মানুষকে জীবন দেয় না,জীবন কেড়ে নেয়। তবুও মানুষ সেই জীবিকা ছেড়ে দেওয়ার বিকল্প জানে না।”

কৃষ্ণের এই কারখানা যেন প্রতিনিধিত্ব করে সারা পৃথিবীর হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নেওয়া কারখানার, ধনীর আরো ধনী হওয়ার লোভে পৃথিবীতে সৃষ্টি করে যাওয়া প্রাণঘাতী দূষণের, প্রতিবেশী দত্তদের বাড়ির শিশু মৌয়ের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সন্তানেরা হয় সে দূষণের প্রথম শিকার।

এই বইতে উঠে এসেছে ভুপাল গ্যাস দুর্ঘটনার খণ্ডচিত্র। কৃষ্ণের কারখানার পাশের খাটালের গরুগুলোর দুধের বাঁটের মতো পৃথিবী যেন আজ শুধু বিষ উদগিরণ করে। কৃষ্ণদের উঠানের আমগাছ আর পাড়ার পুকুরের মতো প্রকৃতির মাঝেও যেন এখন মিশে যাচ্ছে ধ্বংসের বীজ। পৃথিবী হেঁটে যাচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে, এই মৃত্যু তারই সন্তানের দেওয়া উপহার। আবার সন্তানের দেওয়া বিষ বক্ষে ধারণ করতে করতে পৃথিবী এখন তারই অন্য সন্তানদের প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। মৌয়ের অন্ধত্ব, প্রকাশের করুণ পরিণতি, খাটালের দুগ্ধবতী গাভীগুলোর পারদের বিষে ফেটে যাওয়া রক্তাক্ত বাঁট যেন পৃথিবীর সেই রক্তাক্ত প্রতিশোধের সুর বাজিয়ে তোলে।

বিষক্রিয়ায় অন্ধ শিশু মৌ পৃথিবীর বিশুদ্ধতার ক্ষয়ে যাওয়ার কথাই বলছে নাতো? (প্রতীকি) Source: theecologist.org

এই উপন্যাসের আরেকটি অংশ তুলে ধরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষিত ও শোষকের চক্র, লোভ, ঘুষ, অন্যায়, অবিচার, ঘৃণা, স্বার্থ প্রতিনিয়ত এই চক্রটিকেই সচল রাখছে। কৃষ্ণের দ্বৈত চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বে একদিকে এটি যেমন একটি অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, অন্যদিকে এটিকে একটি উৎকৃষ্ট সামাজিক উপন্যাস বললেও ভুল হবে না।

এখানে পাঠক খুঁজে পাবেন সামন্ত আর পাড়ার দুশ্চরিত্রা বৌয়ের মতো সমাজের বিবেকহীন স্বার্থবাদী মানুষদের অন্যায়, অবিচার, ব্যাভিচার কীভাবে কৃষ্ণকে আরো অন্ধকারের গভীর অতলে টেনে নিয়ে যায়। পুঁজিবাদী সমাজের মুখপাত্র হয়ে শংকর আর সুদেব কৃষ্ণ তথা সমাজের দরিদ্র, অসহায় মানুষদের শেষ জীবনীশক্তিটুকুও শুষে নেয়। কৃষ্ণের জন্য শোষণের বীজ পোঁতা আছে সমাজ থেকে পরিবার- সর্বত্র। নিজের পরিবারের দায়িত্বই পায়ের বেড়ি হয়ে কৃষ্ণের জীবনের চলার পথের অন্তরায় এসে দাঁড়ায়, অসহায় কৃষ্ণকে করে তোলে আরো নিরুপায়, আরো দুর্বল। নিজের অজান্তেই তাই কৃষ্ণ নিজের মধ্যে ধারণ করে উনিশ শতকের ভারতবর্ষের দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবারের সক্ষম পুরুষদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। মা মহিমার কণ্ঠে সেই চিত্র হয়ে ওঠে আরো স্পষ্ট-

“তোকে শুষে শুষে শেষ করে দিচ্ছি আমরা। আমি, জিতু, সুমি, বিদিশা- সব্বাই। একদিক থেকে কেমিক্যাল তোকে খেতে আসছে, অন্যদিক থেকে আমরা।”

স্বার্থ ও অর্থের জন্য মানুষই করে চলছে জীবনের বেচাকেনা; Source: slguardian.org

তবুও এ কথা বলতেই হবে, উপন্যাসের ঘোর অমানিশার অন্ধকারের মধ্যে আশার ক্ষুদ্র দুটি প্রদীপ হয়ে জ্বলে থাকে দুটি নারী চরিত্র। সবচেয়ে বেশি অন্যায়ের শিকার হয়েও, বুকের মাঝে সন্তান হারানোর শোকের সবচেয়ে ভারি পাথর নিয়েও শেষপর্যন্ত ক্ষমা ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে সবিতা, অন্ধশিশু মৌয়ের মা সবিতা। তারই উচ্চারিত কবিগুরুর অনবদ্য কবিতা ‘প্রশ্ন’ হয়ে ওঠে কৃষ্ণের জীবনের অদৃশ্য কাঠগড়া। কৃষ্ণের বিবেকই যেন শব্দ খুঁজে পেয়ে প্রশ্ন করে-

“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো
তুমি কি বেসেছো ভালো?”

এত অন্যায়, অন্ধকার আর হতাশার পৃথিবীতে কৃষ্ণের কাছে এখনো জীবনের আশা আর প্রশান্তির একটি নাম বাকি থাকে- সে নাম ‘উর্বী’, কৃষ্ণের নায়িকা। উর্বী কৃষ্ণের কাছে তার সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত, মুক্তির একমাত্র উপায়। কৃষ্ণের দূষিত, বিষাক্ত পৃথিবীতে বেঁচে থাকা শুদ্ধতার শেষ রূপকথা তার উর্বী। কিন্তু উর্বী কি শেষপর্যন্ত পারে জীবনের পথ দেখাতে, প্রেম কি পারে সকল অন্ধকারকে সরিয়ে আলোর সকাল আনতে?

নিয়ত অন্যায় আর নিগ্রহে জর্জরিত কৃষ্ণ তবুও নিজের সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে, মুক্তির আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে যায় নিজের শেষ পরিণতির দিকে। নিজেই নিজের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেয় সে। তবুও নিখাদ বিষাদময়তা, ব্যথা ও কষ্টে আচ্ছন্ন থাকে সে মুক্তি। কৃষ্ণের মুক্তি যেন বন্দিত্ব উপহার দিয়ে যায় দুর্বলের ওপর অত্যাচারী শাসকের ন্যায় পৃথিবীকে। যুগে যুগে পৃথিবীতে এই চরম সত্যই কি প্রমাণিত হয় না? তাই তো কৃষ্ণের কণ্ঠে লেখক বলে ওঠেন-

“ধাতুবিষ সভ্যতার শেষ বিলয়ভূমি, নগর থেকেই সভ্যতার পতন হবে। সেই বিষের শেকলে বাঁধা হবে গ্রামের ওমরদের, শহরের কৃষ্ণদের হিংসার প্রলম্ব ছায়ায় ঘেরা হবে সমস্ত সমাজ। ধর্ষক ও দূষকের হাতে তুলে দেওয়া হবে সভ্যতার রথের রাশি।”

লেখকের আরো অন্যান্য বই; Source: allbdpdf.blogspot.com

ফিচার ইমেজ: Edited by writer

Related Articles