Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেথ অফ এ সেলসম্যান : পুঁজিবাদী পৃথিবীতে মধ্যবিত্তের মৃত্যু

আজকের বিশ্বের অর্থনীতিটাই যেন ভোগের, একে অপরকে ভোগ করবে বস্তুসামগ্রীর মতো, কোম্পানিগুলো নিজের শ্রমিকদের রক্ত-মাংস থেকে মন ও মনন পর্যন্ত চুষে খাবে, অতঃপর পরিত্যক্ত ছোবড়া ত্যাগ করে তাকাবে নতুন শ্রম বাজারের দিকে। এটাই যেন বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির পুঁজিতত্ত্বের লুকানো রহস্য। আর এই নিংড়ে নেওয়ার অর্থনীতির পরতে পরতে লুকোনো থাকে হাজারো লাখো সাধারণ মানুষ ও তাদের পরিবারের গল্প, লুকোনো থাকে তাদের নানা রঙের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন ভাঙার কাহিনী।

এরকমই এক স্বপ্ন ভাঙার গল্প নিয়ে তৈরি আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ নাটকটি। এক আমেরিকান সেলসম্যান আজীবন স্বপ্ন দেখে নিজের ও তার পরিবারের জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও ঋণমুক্ত জীবনযাপনের, কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ হয় তার জীবনের সাথেই। সন্তানদের সফলতার স্বপ্নের মাধ্যমে ফুটে ওঠে এই পুঁজিবাদী সমাজের সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পিতার আজীবন লালিত স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার সামর্থ্য, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মধ্য দিয়েই পিতা সন্তানদের জন্য নিজের সর্বশেষ প্রচেষ্টার চিহ্ন রেখে যায়। এভাবে একটি মৃত্যুর সাথে হাজারো স্বপ্নের বাঁচা-মরার গল্প জড়িয়ে গড়ে ওঠে ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’। উইলি লোম্যান চরিত্রটি যেন বলে মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের জীবনের গল্প। সামান্য সেলসম্যানের চাকরি করে উইলি, সামান্যই করতে পারে নিজের পরিবারের জন্য। স্বপ্ন তার স্ত্রীকে স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া, বাচ্চাদের জন্য চায় সে প্রাচুর্য আর সফলতা। কিন্তু সে সফলতার দেখা পায় যেন প্রতিবেশী চার্লি ও তার সন্তানের সফলতার মধ্যে, সে চায় নিজের ভাই বেনের মতো ভাগ্যের পরিবর্তন। উইলি যখন নিজের ব্যর্থতা আর পরিবারের ভারবহনে চিরক্লান্ত, তখন তারই ছোট ভাই বেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে পরিবার আর আপনজনের মোহ ত্যাগ করে ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমায় আফ্রিকায়, পরবর্তীতে হয়ে ওঠে ব্যাপক বিত্ত-বৈভবের অধিকারী। জীবনের শেষ পর্যন্ত বড়ো ভাই উইলি আশা করে, কোনো একদিন বেন ফিরে এসে তার জীবনযুদ্ধের কষ্ট লাঘব করবে, তার সন্তানদের প্রতি স্নেহাশীর্বাদ রেখে তাদের দেবে সঠিক পথের সন্ধান। পরিবর্তিত হবে তার ভাগ্য, পরিবর্তিত হবে তার জীবন। আর সে পরিবর্তন আনার চেষ্টাতে একদিন জীবনেরই গল্পের পরিবর্তন করে ফেলে সে।

মঞ্চে ডেথ অফ এ সেলসম্যান; source: yousense.info

আমেরিকান মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প বলা এই বইটি এমন এক সময়কার, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে দেশটির অর্থনীতি নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। আগের গ্রাম ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হয়ে উঠছে শহরমুখী ও শিল্প-কারখানা নির্ভর। তীব্র পুঁজিবাদ সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, ধনীরা যতো দ্রুত আরো ধনী হচ্ছে, তত দ্রুতই নেমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনমান। সে সময় মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয় দ্রুত, আগের ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর প্রকট হয়ে ওঠে নতুন চিন্তাধারা। মুক্ত স্বাধীন জীবনের চেয়ে মানুষের কাছে তখন প্রিয় হচ্ছে বিত্ত-বৈভবে পূর্ণ জীবন, একে অপরের কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করার এক দুর্দান্ত প্রতিযোগিতা তখন সর্বত্র। সমাজে তখন থেকেই সম্পদ আর প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করে মানুষের মূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমনই এক সময়ের প্রতিনিধিত্ব করা বই আমেরিকান লেখক মিলারের ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান।’

নাট্যকার আর্থার মিলার; source:imdb.com

গল্প শুরু হয় উইলির কর্মজীবনের ব্যর্থতার কথা দিয়ে। স্ত্রীর সাথে রান্নাঘরের আলাপচারিতায় ফুটে ওঠে সেলসম্যান হিসেবে বৃদ্ধ উইলির ব্যর্থতার চিহ্ন, পাওয়া যায় স্বামী হিসাবে উইলির ব্যর্থতার পরিচয়। অন্য নারীর প্রতি পুরুষসুলভ আকর্ষণে যে উইলি বিশ্বাস ভাঙে স্ত্রী লিন্ডার, সে উইলিই সহানুভূতি আর বিশ্বাসের খোঁজে আমৃত্যু নির্ভর করে স্ত্রীর ওপর। দুই পুত্র বিফ আর হ্যাপি ভাগ্যের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘোরে, কিন্তু উইলি ব্যর্থ হয় তাদের সঠিক পথ দেখাতে, ব্যর্থ হয় পুত্রের সামনে উত্তম পিতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে। দুই ভাইকে পাওয়া যায় পিতার সঙ্গের চেয়ে ছলনাময়ী অর্থলোভী নারীর সঙ্গ বেশি উপভোগ করতে। এযেন আজকের পৃথিবীর হাজারো নিম্নবিত্ত যুদ্ধরত পিতার আয়না। উইলির চরিত্র যেন আরো লাখো পরনারীপ্রীত কিন্তু স্ত্রীর প্রতি একান্ত নির্ভরশীল স্বামীর প্রতিচ্ছবি।

স্বপ্নদের ভেঙে যাওয়ার গল্প; source: philropost.com

পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী আর্থার মিলারের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ কেবল একটা শ্রেণির জীবনের গল্পই বলে না, এটা বলে একটা সময়ের কথা, একটা সমাজের কথা। এই সময় বিশ্বব্যাপী যান্ত্রিকতার সময়, সে গল্প এক যান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গল্প। এই যান্ত্রিকতা দেখা যায় যখন কর্মচারী হিসেবে উইলিকে ব্যবহারের পর বেতনহীন অবস্থায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এতোদিনের সেবা নেওয়া কর্মস্থল ও মালিক, হৃদয়হীনতা দেখা যায় যখন অসহায় এই সেলসম্যান আজীবন কোম্পানিতে কাজ করার দোহাই দিয়েও ঋণ না পেয়ে চাকরিচ্যুতির চিঠি নিয়ে বেরিয়ে আসে মালিকের অফিস থেকে, এই অনুভূতিহীনতার প্রবল প্রমাণ পাওয়া যায় ভাইয়ে ভাইয়ে সৃষ্টি হওয়া স্পষ্ট দূরত্বে।

তবে নির্দয়তার সবচেয়ে জোরালো দৃশ্য নিঃসন্দেহে উইলির শেষকৃত্য, যেখানে পরিবার ও প্রতিবেশী ছাড়া আর কেউ উপস্থিত থাকে না, অথচ উইলির শেষ ইচ্ছা ছিল একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হিসাবে নিজের কর্মের স্বীকৃতি ও সম্মান নিয়ে বিদায় নেওয়ার। কিন্তু তার চলে যাওয়াটাও থেকে যায় অসম্পূর্ণ, প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে স্ত্রী লিন্ডার দেওয়া তার দু’বারের আত্মহননের চেষ্টা পাঠকের সামনে সেই প্রশ্নকে আরো দৃঢ় করে। তবে কি উইলি নিজের গল্পের সমাপ্তি টেনেছে তার স্ত্রী- সন্তানদের জীবনের গল্পকে আরেকটু সহজ করার জন্য? জীবনবীমা থেকে পাওয়া টাকাতে নিজের পরিবারের মাথার ওপরের ছাদটা নিশ্চিন্ত করতেই তার এই শেষ চেষ্টা? কিন্তু তাতে কি শেষ হয় তার পরিবারের শূন্যতার আখ্যান? লেখকের কলমে এই প্রশ্নের উত্তর দেয় লিন্ডা-

“প্রিয়তম আমার, আজ আমাদের ঘরের জন্য করা ঋণের শেষ টাকাটাও আমি শোধ করে দিয়েছি, কিন্তু সে ঘরে থাকার এখন আর কেউ নেই।”

সারা পৃথিবীর মানুষ এখন শহরমুখী। গ্রাম থেকে, মফস্বল থেকে স্বপ্ন চোখে নিয়ে মানুষ এখন পাড়ি জমাচ্ছে বড় বড় ব্যস্ত সব শহরে। এসব বড় শহরে থাকে বিশাল অট্টালিকা, কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফ্যাক্টরি, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নানান কোম্পানি। এই বিশালতা বিত্ত-বৈভবের কথা বলে, বলে সম্পদের প্রাচুর্যের সুখ্যাতি ও স্বীকৃতির কথা। কিন্তু তা কি সবার জন্য? পুঁজিবাদী এই অর্থব্যবস্থার কতটুকু সম্পদই বা পৌঁছায় সাধারণ মানুষের কাছে?

মৃত্যুতেই নিঃশেষ যে আশাহত জীবন; source: pinterest.com

শহরের নামিদামি সব কোম্পানি ব্যবহার করে মানবসম্পদকে, শ্রমশক্তিকে। শ্রমিক ও কর্মীদের মাধ্যমে নিত্য বাড়াতে থাকে তাদের প্রাচুর্যতা, কিন্তু যে শ্রমিক বা কর্মচারী কাজ করে, শ্রম দেয়, সে থেকে যায় সেই সম্পদ বা সুখ্যাতি সবকিছুর আড়ালে। পুঁজির প্রাচুর্যের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি আরো প্রাচুর্য আনে পুঁজিপতিদের জন্যই, সাধারণ শ্রমনির্ভর মানুষের জন্য না। সারাবিশ্বের পুঁজিবাদী এই অর্থব্যবস্থা এবং তা থেকে সৃষ্টি হওয়া নানা বৈষম্যেরই চিত্র দেখানো অনিন্দ্য সুন্দর সাহিত্যসৃষ্টি আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ জীবনের করুণ পরিণতির সাথে সাথে পাঠককে পরিচয় করায় পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বাস্তবতার সাথে। দেখায় বৈষম্যনির্ভর পৃথিবীতে জীবন- মৃত্যুর খেলায় তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া এক অতি সাধারণ মানুষের নির্মম পরিণতির চিত্র।

This is a review of the book 'death of a salesman' in bangla by Authur Millar. The book deals with the extreme economic crisis of an American salesman and his family.

Featured Image: picsunday.com

Related Articles