সেভেন: রহস্যের শেষ বিন্দু পর্যন্তই রোমাঞ্চকর

ক্রাইম-মিস্ট্রি ঘরানার সিনেমার প্রতি দর্শকদের বরাবরই বিশেষ আকর্ষণ থাকে। সিনেমার শুরুতে কাহিনী এগিয়ে যায় রহস্যময় পথ ধরে, শেষভাগে এসে উন্মোচিত হয় রহস্যের জট। মিস্ট্রি সিনেমার বৈশিষ্ট্যই এমন। দর্শককে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় সিনেমার কুয়াশা আবিষ্ট গল্প।

আজকের লেখাটি নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া অপরাধ-রহস্য গোছের সিনেমা ‘Se7en’ নিয়ে। আইএমডিবি কর্তৃক নির্বাচিত সেরা ২৫০ চলচ্চিত্রের তালিকায় সগর্বে ২২ নম্বর স্থানটি বাগিয়ে নিয়েছে ‘সেভেন’। নন্দিত পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চার তার সৃজনশৈলীর সবটুকুই যেন ঢেলে দিয়েছেন এই সিনেমার জন্য। সাথে চরিত্রাভিনেতাদের অনবদ্য অভিনয় আর দুর্দান্ত চিত্রনাট্য সিনেমাটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

‘সেভেন’ সিনেমার পোস্টার; Source: pinterest

কাহিনী সংক্ষেপ

আমেরিকার নাম না জানা এক শহর। এখানে সূর্যের আলো কালেভদ্রে হাজিরা দেয়। দিবারাত্রি ঝিরঝিরে বৃষ্টি সারাক্ষণ অতিষ্ট করে নগরবাসীকে। এমন মন খারাপ করা শহরে এক বৃদ্ধ গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার চাকরি শেষ হবার অপেক্ষায় দিন গোনে। নাম তার উইলিয়াম সমারসেট (মরগ্যান ফ্রিম্যান)। এই তো, আর মাত্র কয়েকটি দিন। এরপরই ইস্তফা দিয়ে নিশ্চিন্তে অবসর কাটাতে পারবে সে। অবশ্য অবিবাহিত উইলিয়াম চাকরি ছাড়ার পর করার মতো আর কাজ পাবে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। হঠাৎ ডিপার্টমেন্টে একটি নতুন কেস আসে, খুনের ঘটনা। এক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার তত্ত্ব-তালাশের জন্য উইলিয়ামের সাথে একজন তরুণ গোয়েন্দা পুলিশ নিযুক্ত করা হয়। এই অনভিজ্ঞ, রগচটা তরুণের নাম ডেভিড মিলস (ব্র্যাড পিট)। দুজন একেবারেই বিপরীত মেরুর মানুষ। উইলিয়াম প্রজ্ঞাবান, সুস্থির আর স্বল্পভাষী। অন্যদিকে ডেভিড অস্থিরমতি আর রাশভারী। দুজনের মধ্যে প্রতিনিয়ত মতভেদ হয়। কাজের স্বার্থে দাঁতে দাঁত চেপে কেসটা সামলায় তারা।

দুর্দান্ত অভিনয়ে গোটা সিনেমা জমিয়ে তুলেছেন এ দুজন; Source: Steven Benedict

ভিকটিমের নাম জানা যায়নি। মৃত্যুর আগে তাকে জোরপূর্বক স্প্যাগেটি খাওয়ানো হয়েছিল। যখন তার পেট স্প্যাগেটি দিয়ে পরিপূর্ণ, লাথি মেরে তার পেট ফাটিয়ে দেয় হত্যাকারী। এরই মাঝে আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটে যায়। এলি গোল্ড নামের এক উকিলকে তার অফিসে মেরে ফেলে গেছে আততায়ী। ভিকটিমের রক্ত দিয়ে লাশের সামনে মাটিতে লেখা রয়েছে ইংরেজি শব্দ ‘GREED’। উকিলের হত্যারহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ডেভিড। প্রথম হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যায় উইলিয়াম। জোর করে স্প্যাগেটি খাইয়ে কেন মারা হল লোকটিকে? উইলিয়াম দিন-রাত উজাড় করে দেয় একটি সূত্র পাবার আশায়। আরও তথ্য প্রয়োজন, সুতরাং খুনের ঘটনাস্থলে আবার হাজির হয় উইলিয়াম। ভিকটিমের বাসার রেফ্রিজারেটরে চোখ যায় তার। ফ্রিজের পেছনে চোখ পড়তেই সন্দেহ ঘনীভূত হয় উইলিয়ামের মনে। ফ্রিজটা সরিয়ে সন্দেহের জবাব পেয়ে যায় সে। কালি দিয়ে ফ্রিজের পেছনে লেখা রয়েছে ‘GLUTTONY’। মাথা খাটিয়ে এক পর্যায়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে প্রবীণ অফিসার উইলিয়াম। খুনগুলোর যোগসূত্র আঁচ করে ফেলে সে! খ্রিষ্টধর্মের দীক্ষা অনুসারে সাতটি পাপ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এদের বলা হয় ‘সেভেন ডেডলি সিনস’। পাপগুলো হলো যথাক্রমে- Pride, Greed, Lust, Envy, Gluttony, Wrath আর Sloth। এগুলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে খুনীর বার্তা। উইলিয়াম সমারসেট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, একজন সিরিয়াল কিলার ‘সেভেন ডেডলি সিনস’ এর উপর ভিত্তি করে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, এবং তার অপকর্ম সবে শুরু! আরও পাঁচটি খুন করবে সে।

রহস্যের জটিলতা টেনে নিয়ে যাবে অনেক দূরে; Source: zvenne’s homies

অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত এক সিরিয়াল কিলারের কেস নিয়ে কাজ করছে উইলিয়াম-ডেভিড। দুটি খুনের সুরাহা করতে পারছে না পুলিশ। আরও পাঁচটি সম্ভাব্য খুনের আশংকায় সতর্ক থাকতে হচ্ছে সবাইকে। যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে এই অদৃশ্য আততায়ী। সিরিয়াল কিলারের পরিচয় জানতে পারবেন সিনেমার একদম শেষভাগে। উইলিয়াম আর ডেভিড কি এই কেসের সমাধান করতে পারবে? কী অপেক্ষা করছে তাদের ভাগ্যে? রোমাঞ্চের ঢেউয়ে ভেসে যেতে দেখে ফেলুন দুর্দান্ত এই সিনেমাটি।

টুকরো গল্প

১। সিনেমার প্রযোজক চেয়েছিলেন কাহিনীর শেষাংশ পরিবর্তন করতে। কিন্তু ব্র্যাড পিট সাফ জানিয়ে দেন, গল্প পাল্টে দিলে তিনি অভিনয় করবেন না।

বিপরীতমুখী দুজন মানুষের লড়াই এক সিরিয়াল কিলারের বিরুদ্ধে; Source: wallpaper abyss

২। ডেভিড মিলসের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চারের প্রথম পছন্দ ছিলেন গিনেথ প্যালট্রো। কিন্তু গিনেথ খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। ব্র্যাড পিটের তৎকালীন প্রেমিকা গিনেথ প্যালট্রোকে রাজি করানোর জন্য পরিচালক ব্র্যাড পিটের শরণাপন্ন হন। ব্র্যাডের অনুরোধে রাজি হন গিনেথ

৩। এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি ম্যাগাজিন তাদের ‘স্কেয়ারেস্ট মুভিস অফ অল টাইম’ এর তালিকায় ‘সেভেন’কে অষ্টম স্থানে রেখেছে।

৪। উইলিয়াম সমারসেটের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য শক্তিমান অভিনেতা আল পাচিনোকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি অন্য একটি সিনেমায় কাজ করছিলেন বিধায় তার বিকল্প হিসেবে মরগ্যান ফ্রিম্যানকে বেছে নেওয়া হয়।

৫। ‘সেভেন’ এ অভিনয় করে ব্র্যাড পিট সাত মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক পান।

‘সেভেন’ সিনেমার সেটে ব্র্যাড পিট আর ডেভিড ফিঞ্চার; Source: cinephileandbeyond.com

৬। সিনেমার একটি দৃশ্যে সিরিয়াল কিলারের আক্রমণে আঘাত পায় ডেভিড মিলস, বাস্তবেও সেই দৃশ্যে অভিনয়ের সময় হাতে ব্যথা পেয়েছিলেন ব্র্যাড পিট। চিত্রনাট্যে উল্লেখ ছিল ডেভিড মিলস আততায়ীর আঘাতে আহত হবে, তবে সেটি হাতে নয়।

৭। একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে সাত ঝুড়ি তেলাপোকা ব্যবহার করতে হয়েছিল!

৮। মরগ্যান ফ্রিম্যানকে যেসব দৃশ্যে পিস্তল ব্যবহার করতে হয়েছে, সেখানে তিনি ট্রিগারে হাত রেখে পকেট থেকে পিস্তল বের করেন। শ্যুটিং সেটে থাকা সত্যিকারের পুলিশ অফিসার তখন তার ভুল শুধরে দেন এই বলে, পেশাদার পুলিশ অফিসার কখনোই ট্রিগারে হাত দিয়ে পিস্তল তাক করে না।

৯। নির্মাতারা সিদ্ধান্ত নেন, সিনেমার পটভূমিতে সারাক্ষণ বৃষ্টি দেখানো হবে। এতে সুবিধা হয় যে, সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামলেও শ্যুটিং করতে ব্যাঘাত হয়নি।

১০। জেনস্কোপ এন্টারটেইনমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ‘সেভেন’ এর সিরিয়াল কিলারের উপর ভিত্তি করে একটি কমিকস সিরিজ বানাতে চেয়েছিল, এজন্য তারা প্রযোজনা সংস্থার কাছ থেকে স্বত্ব কিনে নেয়।

ছলছল চোখে কীসের মুখোমুখি হয়েছিল ডেভিড? Source: Addicted to Horror Movies

১১। এই সিনেমায় সিরিয়াল কিলারের নাম ‘জন ডো’। জন ডো ভূমিকায় যে বিখ্যাত অভিনেতা অভিনয় করেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় সিনেমার প্রচারণা থেকে বিরত থাকেন। এমনকি সিনেমার শুরুতে যেন তার নাম না দেখানো হয়, সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন তিনি। এতে জন ডো চরিত্রটিকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয় এবং দর্শকরা সিনেমার স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন।

১২। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিউ লাইন সিনেমা ‘সেভেন’ এর সিক্যুয়েল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

সিনেমা: সেভেন (১৯৯৫)
পরিচালক: ডেভিড ফিঞ্চার
আইএমডিবি রেটিং: ৮.৬/১০

ফিচার ইমেজ: winwallpapers.net

Related Articles