Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেষের কবিতা: যে উপন্যাসের কোনো শেষ নেই

প্রেম কি শুধু একটা সময়ে একজনের জন্যই আসে? আর যদি কারো মন একই সময়ে দুজনের জন্য দুভাবে নাড়া খায়? ভালোবাসাকে নির্দিষ্ট সংখ্যা বা গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না। তাকে বয়ে যেতে দিতে হয়, উড়তে দিতে হয় আকাশের মুক্ত বিহঙ্গের মতোই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ভালোবাসার আচরণ একটু অন্যরকম, অনেকটাই আটপৌরে। আটপৌরে বলে তার গুরুত্ব কমে যায় না, বরং জীবনটাকে বেঁধে রাখে এই আটপৌরে প্রেমের অভ্যেস। অন্যদিকে থাকে সীমাহীন বিস্তৃত প্রেম, নিজেকেই যাতে হারিয়ে ফেলা যায়। এ প্রেমের তল পাওয়া যায় না, আকণ্ঠ নিমজ্জনে তাতে শুধু সাঁতরে বেড়ানো যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ একটি মনস্তাত্ত্বিক রোম্যান্টিক উপন্যাস এবং এতে প্রেমের দুটি স্বরূপকে খুব স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে। একদিকে অমিত রায়ের উচ্চমার্গীয় সমাজের নাকউঁচু লোকের সভা, অপরদিকে স্বমহিমায় বিরাজিত শিলং পাহাড়ের প্রকৃতিকন্যা লাবণ্য। দুটো মেরু মুখোমুখি দাঁড়ায়, মাঝখানে সুবিস্তৃত অঞ্চল। বহুদূর, তবু অবিরাম স্বচ্ছতা মনে করায়, তারা কাছেই আছে।

শেষের কবিতা; Source: purnoboi.com

রোমান্টিসিজম ও বাস্তববাদিতা এ দুয়ের এক অদ্ভুত মিলন দেখতে পাই এ উপন্যাসে। একদিকে পেছনের সবকিছুকে তোয়াক্কা না করে অমিত-লাবণ্য একে অপরের প্রণয়ের আলিঙ্গনে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একবারও সে বন্ধনকে খেলো হতে দেয়নি তারা। একদম শেষপর্যন্ত দেখা যাবে যে তারা একে অপরের কতটা কাছে আছে, তার পরিমাপ করাটা অনেক কষ্টকর। রবি ঠাকুরের একটি কবিতার লাইনেই যেন তাদের পরিণতি বোঝা যায়,

“যারা কাছে আছে, তারা কাছে থাক

তারা তো পাবে না জানিতে

তাহাদের চেয়ে কাছে আছ তুমি

আমার হৃদয়খানিতে”

সাহিত্যের সমঝদার অমিত ও লাবণ্য দুজনেই। দুজনের বেড়ে ওঠার ধরন ভিন্ন, জীবন ও যাপনে রয়েছে বৈপরীত্য। তবু একে অপরের মধ্যে যেন নিজের পরিপূরক রূপ খুঁজে পায় তারা। অমিত কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের তরুণীদের হৃদয়ে মুহূর্তেই আলোড়ন জাগানো এক যুবাপুরুষ। সে-ও তরুণীদের এই আলোড়ন খুব উপভোগ করে। কিন্তু সে যা চায়, তা যেন শুধু ঐ আলোড়ন নয়। সে ফ্যাশন চায় না, চায় স্টাইল। তার মতে, “ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী”। চারদিকে শুধু ফ্যাশনেরই ছড়াছড়ি। চাইতে না চাইতে অমিতও সেই ফ্যাশনের অন্তর্গত দলের সদস্য। কিন্তু লেখক অমিতের মনের চাওয়াটা বুঝতে পেরে বলেছেন, “অমিতের নেশাই হলো স্টাইলে”। তাই সে ফ্যাশনের সঙ্গ উপভোগ করলেও শেষমেশ স্টাইলের কাছেই আশ্রয় খুঁজতে চাইবে, এ আর আশ্চর্য কি!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; Source: bonikbarta.com

অমিত চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্রোতের বিপরীতে চলতে চাওয়া। নিজেকে আলাদা করে দেখাতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। যে যতই বলুক না কেন, “আমি সাধারণ”, সেই বলার পেছনেও থেকে যায় অসাধারণ হবার একটি আকুতি। অমিতের মধ্যেও সেই ছাঁচটি রয়ে গেছে। সে সবদিক দিয়ে নিজেকে আলাদা দেখাতে মরিয়া। পাঁচজনের মধ্যে তাকেই যাতে লোকে দেখে। সবাই আলাদা দেখাতে চাইলেও সবাই সেটা পারে না, পারে কেউ কেউ। অমিত সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই গর্বিত এক সদস্য।

লেখক নারীর মধ্যে সেই ‘ফ্যাশন’কে কিছুটা চিত্রকল্পের সাহায্যে দেখাতে চেয়েছেন এভাবে,

“এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চৈঃস্বরে বলে; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর করে সঞ্চালন করে, এবং পুরুষবন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে”

এই ক’টি লাইনের মাধ্যমে সেই সময়ের উচ্চবিত্ত ও নবশিক্ষিত সমাজের একটা ছবি ধরা দেয়। কেমন ছিলেন তখনকার শিক্ষিতা মহিলারা? কেমন ছিল তাদের আচরণ? তারা তখন একটা নির্যাস নিজের মধ্যে শুষে নিতে বেপরোয়া, পাশ্চাত্যের ছোঁয়ালাগা একটা আধুনিক পরিচয় তারা নিজেদের দিতে চান।

কিন্তু উপন্যাসের নায়ক অমিত কাকে চায়?

“আমি মনে মনে যে মেয়ের ব্যর্থ প্রত্যাশায় ঘটকালি করি সে গরঠিকানা মেয়ে। প্রায়ই সে ঘর পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। সে আকাশ থেকে পড়ন্ত তারা, হৃদয়ের বায়ুমণ্ডল ছুঁতে না ছুঁতেই জ্বলে ওঠে, বাতাসে যায় মিলিয়ে, বাস্তুঘরের মাটি পর্যন্ত আসা ঘটেই ওঠে না”

উপন্যাসের একেবারে শুরুর দিকেই অমিত যেন উপন্যাসের শেষের আভাস দিয়ে ফেলে। অথবা বলা যায় শেষপর্যন্ত অমিতের ইচ্ছের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে।

উপন্যাসটির মূল চরিত্র অমিত ও লাবণ্য এবং এদের প্রেম পরিণত হয় একটি চতুর্ভূজ প্রেমের গল্পে। কেতকী ও শোভনলালের আগমন এবং এদের ভূমিকা দুজনের জীবনেই যেন দ্বিতীয় হয়ে রয়ে যায়। লেখক তার দিঘির জল ও ঘড়ার জলের উপমা দিয়ে দুটোরই প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন। কিন্তু তারপরও যেন ঘড়ার সংকীর্ণ গণ্ডিকে দিঘির প্রসারতার কাছে বড্ড কম বলে মনে হয়। পাঠকমনেও একটি প্রচ্ছন্ন তুলনা এসেই যায় এই দুয়ের মাঝে। ব্যক্তিভেদে এর আবেদন ভিন্নতা পাবেই। তবে এই উপন্যাসে বিকল্প হিসেবে নয়, দুটি মাত্রারই সহাবস্থান দেখানো হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের অতটা দেখা মেলেনি এতে, যতটা এমন একটি পরিস্থিতিতে পাওয়া উচিত ছিল। মনে হয়েছে, চরিত্রগুলো খুব সহজেই যেন দ্বন্দ্বের সাথে নিরসনটাও খুঁজে পেয়ে যায়। এতে অবশ্য চরিত্রগুলোর দৃঢ়তাও একটি কারণ। পরিস্থিতি কিংবা দ্বান্দ্বিক মনের চাইতেও চরিত্রের দৃঢ়তা বেশি প্রকাশ পেয়েছে। তারা যেন ঠিক জানত কোনসময় কী করতে হবে, কার সাথে যাত্রা কতটুকু পর্যন্ত এবং কোথায় গিয়ে থেমে যেতে হয়। সুপরিমিত চিন্তাভাবনা এবং আচরণের মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলো কখনো একঘেয়ে কিংবা বিরক্তিকর ঠেকে না। জটিল মনস্তত্ত্ব সহজ হয়ে ফুটে ওঠে।

রোমান্সের স্বাদ মেলে অমিত-লাবণ্যের কাব্যগঠিত প্রেমে, সাহিত্যের অনুরণনে। মিতা (অমিত) ও বন্যার (লাবণ্য) সুললিত প্রেমে পাঠকমন হারিয়ে যেতে পারেন সেই শিলং পাহাড়ের চূড়ায়, যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল অভিনব এক গল্পের। এর আগপর্যন্ত উপন্যাসের কাহিনীতে অমিতের পটভূমি বিশ্লেষণ করা হয়, তার স্বভাব, চলন-বলন ও জীবনযাপনকে বিভিন্ন ঘটনা ও চিত্রকল্পের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়। এই চরিত্রটি যেখানে আছে, সেখানে থেকে যে সম্পূর্ণ তৃপ্ত নয় এবং তার অনুসন্ধান যে অন্য কিছুর, অন্য কারো- তা পর্যায়ক্রমে বর্ণিত হয়েছে। এবং যখন মনে হয়েছে পাঠকের সাথে অমিত রায় ও তার জীবনের যথেষ্ট পরিচয় হয়েছে, তখন তাকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় কাহিনীর অপর প্রান্তের। একটি সুতো সৃষ্টি হয় এদের দুজনকে বাঁধতে। এখানে লেখক নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন, ঠিক যেমন গতানুগতিক সিনেমায় বা প্রেমের গল্পে দেখা যায়- ‘দুর্ঘটনা’! দৈবাৎ ঘটে যাওয়া এক মোটর দুর্ঘটনা পরিচয় ঘটায় উপন্যাসের মূল দুই চরিত্রের। তাদের মধ্যে মধ্যস্ততাকারী হিসেবেও একটি চরিত্র আবির্ভূত হন, লাবণ্যের মাসি যোগমায়া। তিনি প্রথম পরিচয়েই অমিতের সাথে অনেক আন্তরিক হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে তেমন কোনো অভিনবতা দেখা যায় না, তবে এই উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি হচ্ছে চরিত্রগুলোর কথোপকথন। যোগমায়ার সাথে অমিতের একের পর এক কথোপকথনে প্রকাশ পায় লাবণ্যের প্রতি অমিতের অনুভূতি এবং যোগমায়ার সাথে পরবর্তীতে লাবণ্যের কথোপকথনেও সেই একই ব্যাপার ঘটে। এই চরিত্রটি এখানে তাদের সম্পর্কের একজন মধ্যস্ততাকারীরই ভূমিকায় আছেন বলা চলে। তার একটি উক্তিতে তিনি তাদের সম্পর্কে অথবা এই প্রজন্ম সম্পর্কে কী ধারণা রাখেন, তা অনেকটাই বোঝা যায়। ভাবনা ও যাপনে যে প্রজন্মের মধ্যে একটি ফারাক রয়েছে, তা-ও যোগমায়ার মাধ্যমেই লেখক নির্দেশ করতে সক্ষম। তিনি লাবণ্যকে বলছেন,

“তোমাকে দেখে আমার অনেকবার মনে হয়েছে, অনেক পরে অনেক ভেবে তোমাদের মন বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে; তোমরা ভিতরে ভিতরে যেসব ভাব গড়ে তুলছ আমাদের সংসারটা তার উপযুক্ত নয়। আমাদের সময়ে মনের যেসব আলো অদৃশ্য ছিল, তোমরা আজ সেগুলোকেও ছাড়ান দিতে চাও না। তারা দেহের মোতা আবরণকে ভেদ করে দেহটাকে যেন অগোচর করে দিচ্ছে”

কেতকী অমিতের অভিজাত জীবনের একটি অংশ, যা তাকে তার জীবনের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করবে, লাবণ্যের মতো অদ্ভুত শুদ্ধতায় নাগরিক জীবনকে ভেঙেচুরে দেবে না। অমিত এ শুদ্ধতা চায়, কিন্তু তারচেয়েও অনেক বেশি দায়বদ্ধতা তার জীবনের প্রতি। এদিকে লাবণ্যের মনে রোমান্টিকতার ঢেউ দোলানো অমিত তার জন্যও হিসেব-নিকেশের মানুষ হয়ে আটপৌরে রূপে ঠিক খাপ খায় না। মিতাকে সে সাজিয়ে রাখে বন্যার বন্য মনে, প্রতিদিনকার হিসেবে তাকে টেনে আনা যায় না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাসটি পড়ার শেষে পাঠকমনে একটি সিদ্ধান্ত আরোপিত হবার সম্ভাবনা থাকে, “ভালোবাসা আর ঘর করা এক নয়!”

হে বন্ধু, বিদায়! Source: somewhereintheblog.net

সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নে বারবার একটি প্রশ্নের দেখা মেলে। ‘শেষের কবিতা’ কোন ধরনের রচনা? উত্তরে চারটি বিকল্পের মধ্যে দুটো থাকে কবিতা ও উপন্যাস। এই উপন্যাসে কবিতার বহু খণ্ডিতাংশ রয়েছে। কবিতার ছন্দে ও লয়ে সুরারোপিত হয়েছে কাহিনীতে। অমিতের আত্মবিশ্বাসী ঝঙ্কার, লাবণ্যের শান্ত স্থির স্রোত দুয়ে মিলে কাব্যকথনে মুখরিত হয়েছে প্রেমে। বিখ্যাত কবি জন ডানের “For God’s sake, hold your tongue and let me love”-কে এখানে রবি ঠাকুর অমিতের মুখ দিয়ে তর্জমা করিয়ে নিলেন, “দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর। ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।”

এখানে আরেকটি অদেখা চরিত্রের খোঁজ মেলে। অমিত যে কবির কবিতাকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, নিবারণ চক্রবর্তী। লাবণ্যের রবীন্দ্রপ্রেমের বিপরীতে সে একেই দাঁড় করিয়ে দিতে চায়। তাকে কেউ চেনে না, জানে না, গালি দেবারও উপযুক্ত মনে করে না। ক্ষণে ক্ষণে এও মনে হয়, অমিত নিজেই কি সেই নিবারণ চক্রবর্তী? সে কি গা ঢাকা দিয়ে আছে হালফ্যাশান প্রগলভ ব্যারিস্টার অমিত রয়ের মধ্যে? কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়, সাথে বহু সম্ভাবনাও।

শেষের কবিতার শেষ হয় কাব্যসুরে বিদায়ের ধ্বনি কানে নিয়ে,

“হে ঐশ্বর্যবান,

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান-

গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।

হে বন্ধু, বিদায়”

ফিচার ইমেজ- youtube.com

Related Articles