Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১০,০০০ ঘণ্টা নীতি: মিথ নাকি বাস্তব?

“আপনি যদি কোনো একটি বিষয়ে ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করেন, তবে আপনি ওই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন। সুতরাং, একজন বিশেষজ্ঞ হতে আপনার প্রয়োজন টানা দশ বছর কোনো একটি বিষয়ে (বা কাজে) প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা করে অনুশীলন করা।”

উপরের এই নীতিটি সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন অনেকে। এর গালভরা একটি নামও রয়েছে: ‘10,000-hour rule’ বা ‘১০,০০০-ঘণ্টা নীতি’। যার মাধ্যমে এই নীতিটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তিনি স্বনামধন্য সাংবাদিক-লেখক ম্যালকম গ্লাডওয়েল। তিনি তার ২০০৮ সালে প্রকাশিত বেস্টসেলার আউটলায়ার্স: দ্য স্টোরি অভ সাকসেস-এ পাঠকদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশেষ এই নীতির সঙ্গে।

বইটিতে ১০,০০০-ঘণ্টা নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গ্লাডওয়েল বেশ কিছু উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। সেগুলোর মধ্যে প্রধান হলো ১৯৯৩ সালে মনোবিজ্ঞানী কে অ্যান্ডার্স এরিকসন প্রণীত একটি গবেষণা। গবেষণাটির প্রধান ফোকাস ছিল বার্লিনের একটি মিউজিক অ্যাকাডেমির ভায়োলিন শিক্ষার্থীরা। গবেষণাটিতে দেখানো হয়েছিল যে, ভায়োলিন বাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন এমন অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তাদের বয়স ২০ পেরোনোর আগেই এই বিষয়ে ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করেছিলেন।

ষাটের দশকের শুরুতে হ্যামবার্গে অন্তত ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করেছিল বিটলস ব্যান্ড; Image Source: Wikimedia Commons

এছাড়াও বইটিতে গ্লাডওয়েল হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, ১৯৬০-র দশকের শুরুতে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলস হ্যামবার্গে অন্তত ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করেছিল, এবং বিল গেটসও মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠার আগে ১০,০০০ ঘণ্টা ব্যয় করেছিলেন কেবল প্রোগ্রামিংয়ের কাজে।

এভাবেই আরো অনেক প্রাসঙ্গিক উদাহরণের সমন্বয়ে গ্লাডওয়েল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেয়েছেন যে, সফলতার মূলমন্ত্র হলো ‘স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন’। কোনো কাজে সফল হতে চাইলে সেটির পেছনে প্রচুর পরিমাণে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন বিনিয়োগ করতে হবে। এবং তিনি আরো বলেছেন,“শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে জাদুকরী সংখ্যা হলো ১০,০০০ ঘণ্টা।”

গ্লাডওয়েলের এই নীতি কিন্তু অনেক পাঠকই খুব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। কেননা গ্লাডওয়েল তার বইটিতে যা বলার চেষ্টা করেছেন, তা মানুষ বহুদিন ধরেই জানত। তারা বিশ্বাস করত, প্র্যাকটিসই একজন মানুষকে ‘পারফেক্ট’ করে তোলে। সুতরাং সেই প্রচলিত জ্ঞানকেই যখন একজন বুদ্ধিজীবী-লেখক যথাযথ তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন, সেটি তো গ্রহণযোগ্যতা পাবেই। তা-ই নয় কি?

মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠার আগে ১০,০০০ ঘণ্টা প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করেছেন বিল গেটস; Image Source: Getty Images

কিন্তু তারপরও, অনেক সন্দেহপ্রবণ মানুষের মনেই প্রশ্ন রয়ে গেছে, আসলেই কি বিষয়টি এতটা সোজাসাপটা? শুধু অনুশীলনের মাধ্যমেই কোনো কাজে সফল হয়ে যাওয়া যায়? এর পেছনে আর কোনো চলকের প্রভাব থাকে না?

২০১৪ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা প্রবন্ধে গ্লাডওয়েলের নীতিকে সরাসরি নাকচ করে দেয়া হয়। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলনের উপর মোট ৮৮টি গবেষণাকে মেটা-অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে গবেষকরা খুঁজে পান যে, অনুশীলন বিভিন্ন খাতে মানুষের পারফরম্যান্সে মাত্র ১২ শতাংশ পার্থক্য গড়ে দিতে সক্ষম।

তাদের মতে:

  • ইনডোর গেমসে অনুশীলন পার্থক্য গড়ে দেয় ২৬ শতাংশ
  • সঙ্গীতে ২১ শতাংশ
  • খেলাধুলায় ১৮ শতাংশ
  • শিক্ষাক্ষেত্রে ৪ শতাংশ
  • পেশাজীবনে ১ শতাংশ

কেন এমনটি হয়? কেন কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অনুশীলনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুশীলনের কোনো প্রভাব থাকে না বললেই চলে? এই বিষয়টির সম্ভাব্য সেরা ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে ফ্রান্স জোহানসনের দ্য ক্লিক মোমেন্ট নামক বইটিতে।

এখানে জোহানসন বলেন যে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হতে পারে কেবল সেই সকল ক্ষেত্রে, যেগুলোর রয়েছে দারুণ স্থিতিশীল কাঠামো। উদাহরণস্বরূপ, টেনিস, দাবা কিংবা ধ্রুপদী সঙ্গীতে নিয়মকানুন কখনোই পরিবর্তিত হয় না। তাই আপনি যদি এসব ক্ষেত্রে একটানা অনুশীলন করে যান, তাহলে অবশ্যই নিজের পারফরম্যান্সের উন্নতি ঘটাতে পারবেন।

অপরিবর্তিত নিয়মের কাজে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন কার্যকর হয় বেশি; Image Source: Unsplash

কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম স্থিতিশীল খাতসমূহ, যেমন ক্ষুদ্র-উদ্যোগ কিংবা রক অ্যান্ড রোলে, যেখানে নিয়ম-নীতিমালার কোনো বালাই নেই, সেখানে একটানা অনুশীলনও সাফল্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে অনুশীলনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় দক্ষতা ও সৃজনশীলতা

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রবন্ধটির প্রধান লেখক ব্রুক ম্যাকনামারা এক বিবৃতিতে বলেন,“কোনো সন্দেহ নেই যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন খুব গুরুত্বপূর্ণ, পরিসংখ্যানগত ও তাত্ত্বিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই। কিন্তু এটি স্রেফ যতটা ভাবা হয়েছে (গ্লাডওয়েলের বইয়ে), তার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ।”

ম্যাকনামারা তার বিবৃতিটি শেষ করেন এভাবে, “বিজ্ঞানীদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সফলতার ক্ষেত্রে আর কী কী বিষয় প্রভাব ফেলে?”

ম্যাকনামারার এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ব্র্যাড স্টালবার্গ, যিনি ‘পিক পারফরম্যান্স: এলিভেট ইওর গেম, অ্যাভয়েড বার্নআউট  অ্যান্ড থ্রাইভ উইথ দ্য নি সায়েন্স অভ সাকসেস’ বইটির সহ-রচয়িতা। তার ভাষ্যমতে, কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান বা দক্ষতা গড়ে ওঠে মূলত কীভাবে আপনি অনুশীলন করছেন, তার ওপর ভিত্তি করে। কতটুকু সময় আপনি অনুশীলনের পেছনে ব্যয় করছেন, তার ওপর ভিত্তি করে নয়।

“হ্যাঁ, গ্রেট পারফর্মাররা অনুশীলনের পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করে। কিন্তু এমন অনেক মানুষও রয়েছে, যারাও ওই একই পরিমাণ কিংবা তার থেকে বেশি সময়ও অনুশীলনের পেছনে ব্যয় করে, কিন্তু তবু কখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে তো দূরে থাক, তারা এমনকি জাতীয় পর্যায়েও পৌঁছায় না। গ্রেট পারফর্মারদের সাথে এই ব্যর্থ ব্যক্তিদের মধ্যকার পার্থক্যটি গড়ে দেয় যে বিষয়টি, তা অনুশীলনের পরিমাণ নয়, বরং অনুশীলনের ধরন।”

স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলনের ক্ষেত্রে জরুরি হলো, আপনি যে কাজটি করছেন, সেটির উপর আপনার সর্বস্ব মনোযোগ ঢেলে দেয়া এবং মনোযোগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা। যেমন: হাতের কাছ থেকে মোবাইল সরিয়ে রাখা, কিংবা কোনো সঙ্গীর সাথে গল্পগুজবে মত্ত না থাকা।

এবং আপনি যদি সম্পূর্ণ মনোযোগ কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিনিয়োগ করেন, তবে তা আপনার শক্তির অনেকটাই কেড়ে নেবে। তাই একটানা আপনি ৬০ থেকে ৯০ মিনিট, কিংবা বড়জোর দু ঘণ্টার বেশি ওই কাজটি চালিয়ে যেতে পারবেন না।

গবেষকরা অনুসন্ধান করে বের করেছেন, পূর্ণ মনোযোগের সাথে দেড় ঘণ্টা করা একটি কাজের কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রে অমনোযোগের সাথে করা দশ ঘণ্টা কাজের চেয়েও বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করে যতটুকু সফলতা অর্জন করবে, অনেকের পক্ষে সেই সফলতা ১,৫০০-২,০০০ ঘণ্টা অনুশীলন করেও লাভ করা সম্ভব।

যেকোনো কাজে সফল হতে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ; Image Source: Shutterstock

তাছাড়া গ্লাডওয়েলের দেখানো পথ অনুসরণ করে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলন করতে গিয়ে অনেকের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে যেতে পারে, যদি না ওই কাজের ব্যাপারে তার কোনো প্রাথমিক দক্ষতা থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ দেয়া যায় ফটোগ্রাফার ড্যান ম্যাকলাফলিনের। গ্লাডওয়েল প্রণীত নীতিতে প্রভাবিত হয়ে তিনি একজন পিজিএ ট্যুর গলফার হওয়ার লক্ষ্যে ১০,০০০ ঘণ্টার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুশীলনের অভিযান শুরু করেন। অথচ এই খেলায় তার অতীত অভিজ্ঞতা ছিল খুবই কম। শেষ পর্যন্ত ৬,০০০ ঘণ্টা অনুশীলনের পর তাকে ক্ষান্ত দিতে হয়। কেননা, তার শরীর এই কঠোর পরিশ্রমের চাপ আর সহ্য করতে পারেনি।

অতি সম্প্রতি রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স জার্নাল ১৯৯৩ সালে এরিকসন প্রণীত সেই বিখ্যাত গবেষণাটির (যেটির উপর ভিত্তি করে গ্লাডওয়েল তার ১০,০০০-ঘণ্টা নীতি প্রণয়ন করেন) একটি রেপ্লিকা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। রেপ্লিকেশনটি পরিচালিত হয় ব্রুক ম্যাকনামারা ও মেঘা মৈত্র কর্তৃক। এই রেপ্লিকেশনে নমুনার পরিমাণ মূল গবেষণাটির চেয়ে অনেক বেশি নেয়া হয়, এবং এখানে গবেষণার নিয়ন্ত্রণও ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি।

নতুন এই গবেষণা প্রবন্ধটি দেখিয়েছে যে, পারফরম্যান্সের উপর অনুশীলনের প্রভাব রয়েছে বটে, কিন্তু মূল গবেষণা প্রবন্ধে যতটা দাবি করা হয়েছিল, অত বেশি নয়। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এলিট পারফর্মারদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্নভাবে কাজ করে।

সাম্প্রতিক গবেষণাটির ফলাফল অনেকাংশেই ভিন্ন; Image Source: VideoBlocks

গবেষকদ্বয় লিখেছেন,“প্রকৃতপক্ষে, সিংহভাগ শ্রেষ্ঠ ভায়োলিন বাদকই গড়ে ভালো ভায়োলিন বাদকদের চেয়ে কম অনুশীলন করেছেন।” তবে তারপরও, অনুশীলনের কার্যকারিতা একেবারেই নেই বললে ভুল হবে। এটি ভালো ভায়োলিন বাদক এবং অপেক্ষাকৃত কম দক্ষদের মাঝে ২৬ শতাংশ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। অথচ মূল গবেষণাটিতে অনুশীলন কর্তৃক সৃষ্ট পার্থক্যের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৪৮ শতাংশ।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটুকু মোটামুটি প্রমাণিত যে, সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও এটিই সাফল্যের একমাত্র সিঁড়ি নয়। অর্থাৎ, গ্লাডওয়েলের নীতি অনুযায়ী স্রেফ কোনো একটি কাজের পেছনে ১০,০০০ ঘণ্টা অনুশীলনই যথেষ্ট নয়, যদি না ওই কাজে আপনার প্রাথমিক দক্ষতা থাকে, এবং কাজটিতে আপনি পূর্ণাঙ্গ মনোনিবেশ করেন। আর যদি আপনার মধ্যে এই দক্ষতা ও মনোযোগ থাকে, তাহলে ১০,০০০ ঘণ্টাও নয়, এর চেয়ে অনেক কম সময়েও আপনার পক্ষে ওই কাজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন সম্ভব।

বি: দ্র: ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল-এর আউটলায়ার্স: দ্য স্টোরি অব সাকসেস বইটি সম্বন্ধে জানতে ও কিনতে দেখতে পারেন এখানে। 

বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about whether the 10,000-hour rule is a reality or myth. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © BJJ Fanatics

Related Articles