সাধারণ পদার্থের উলটো কোনো পদার্থ থাকতে পারে- একটা সময় পর্যন্ত এই ব্যাপারটিই কেউ কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু কল্পনা করতে হয়েছে একটা পর্যায়ে। ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ পল ডিরাক ইলেকট্রন নিয়ে একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন। সেই সমীকরণ থেকে একটি সমস্যা বেরিয়ে আসে।
সমস্যা বলছে ইলেকট্রন দুই ধরনের হতে পারে। এক প্রকার ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক আর আরেক প্রকার ইলেকট্রনের চার্জ ধনাত্মক। ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন বাস্তব। কিন্তু ধনাত্মক চার্জের ইলেকট্রন? চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান কিংবা স্বাভাবিক বাস্তবতার সাথে এটি যে একদমই যায় না। কিন্তু গণিত তো আর মিথ্যা বলে না। গাণিতিক অকাট্যতা তো ফেলে দেয়া যায় না। ডিরাক বললেন প্রতিটি মৌলিক কণারই একটি করে বিপরীত ধর্মের কণা আছে। এসব কণার চার্জ ও স্পিন পরস্পরের বিপরীত।
পরবর্তীতে দেখা গেল সত্যি সত্যিই ইলেকট্রনের প্রতিকণা আছে। এই কণার নাম দেয়া হল পজিট্রন। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য কণার প্রতিকণাও আবিষ্কার হতে লাগল এবং একটু একটু করে সমস্যা, সম্ভাবনা ও রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করল। এসব সমস্যা, সম্ভাবনা ও রহস্যের পাঁচটি দিক তুলে ধরা হলো এখানে।
১. অস্তিত্ব থাকত না এই মহাবিশ্বের
তত্ত্ব বলছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় সমান পরিমাণ পদার্থ ও প্রতিপদার্থ তৈরি হয়েছিল। সমান পরিমাণ তৈরি হলেই তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সমীকরণ ঠিকভাবে মেলে। পদার্থ ও প্রতিপদার্থ যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তখন তারা ধ্বংস করে ফেলে একে অন্যকে। এর মানে হল খেলার শেষ ভাগে কেউই কিছু পাচ্ছে না। একদিকে পদার্থ আর প্রতিপদার্থ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে তারাই তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলছে। অস্তিত্ব থাকছে না কিছুর। সে হিসেবে আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের কোনোকিছুই অস্তিত্ববান থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা অস্তিত্ববান আছি। কোনো না কোনো একভাবে আছি। সেটা কীভাবে?
কেন এমনটা ঘটেছে সেটি নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সমর্থিত ব্যাখ্যাটি এমন- পদার্থ ও প্রতিপদার্থ সমান পরিমাণেই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ধ্বংসের সময় সামান্য পরিমাণ পদার্থের পরমাণু টিকে গিয়েছিল। পরিমাণটা প্রতি এক বিলিয়ন পদার্থ-প্রতিপদার্থ জোড়ার মাঝে একটি। আজকে আমরা যে এত বিশাল জগত দেখতে পাই, কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের তালিকা করি, মিলিয়ন মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরেও বস্তুর অস্তিত্ব খুঁজি তাদের সকলেই তৈরি হয়েছে এর মাধ্যমে। প্রতি বিলিয়ন জোড়ার মাঝে একটি একটি করে বেঁচে যাওয়া পদার্থের সমন্বয়ে।
কেন এমনটা ঘটেছে তা ভালোভাবে জানার জন্য বিজ্ঞানীরা এখনো অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন। কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞানীরা দশকের পর দশক গবেষণা করছেন। গত কয়েক দশকের পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে দেখা গেছে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো পদার্থের বেলায় যেমন খাটে প্রতিপদার্থের বেলায় তেমন নাও খাটতে পারে। মাঝে মাঝে আমাদের সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে প্রতিপদার্থের বেলায়। সেরকম কিছু ব্যতিক্রমের কারণে টিকে গিয়েছিল মিলিয়নের মাঝে একটি পরমাণু।
২. আছে তারা চোখের সামনেই
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুসারে ক্ষুদ্র জগতে প্রতিনিয়তই পদার্থ ও প্রতিপদার্থের কণা তৈরি হচ্ছে। তারা তৈরি হবার সাথে সাথেই একে অন্যকে ধ্বংস করে ফেলে। ব্যাপারটা এত অল্প সময়ের মাঝে ঘটে যায় যে আমরা এদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। আমাদের সামনেই ব্যাপারগুলো ঘটছে কিন্তু ধরতে পারছি না, সেজন্য এই কণাদেরকে বলে ভার্চুয়াল কণা।
প্রতিকণারা আমাদের দেহে এমনকি আমাদের খাদ্যের মাঝেও তৈরি হয়। যেমন কলা। কলার মাঝে পটাসিয়াম-৪০ আইসোটোপ আছে। এ আইসোটোপ তেজস্ক্রিয়। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলাফল হিসেবে এটি পজিট্রন কণা নিঃসরণ করে। পজিট্রন হল ইলেকট্রনের প্রতিকণা। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন গড়পড়তা প্রতি ৭৫ মিনিটে একবার করে পজিট্রন নিঃসরণ ঘটে। পটাসিয়াম-৪০ আমাদের দেহেও আছে। সে হিসেবে আমাদের দেহ থেকেও প্রতিকণার নিঃসরণ হয়।
৩. অধরাকে ধরেছিল মানুষ
প্রতিকণারা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে তৈরি হলেও মানুষের কাছে তারা এখনো অধরা। মানুষ চাইলেই ইচ্ছেমতো প্রতিকণা কিংবা প্রতিপদার্থ তৈরি করতে পারে না। অনেক চেষ্টা চরিত্রের পর যা-ই তৈরি হয় তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাবে যতগুলো অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি করা হয়েছে তাদের সবগুলোকে একত্র করলে হবে মাত্র ১৫ ন্যানোগ্রাম। এই পরিমাণটা খুবই অল্প। ১ গ্রামকে সমান ১০০ কোটি ভাগে ভাগ করলে তার প্রতিটি অংশকে হবে ১ ন্যানোগ্রামের সমান। যেখানে ১ গ্রামই অনেক অল্প সেখানে ১ ন্যানোগ্রাম তো নগণ্যের চেয়েও নগণ্য। সার্নে অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি হয়েছে মাত্র ১ ন্যানোগ্রাম। জার্মানির DESY-তে হয়েছে ২ ন্যানোগ্রাম।
পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কিংবা কণা ও প্রতিকণা একত্র হলে তারা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। আর ধ্বংসের পর তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি। শক্তির পরিমাণটা খুবই বেশি। কারণ এখানে সম্পূর্ণ পদার্থই শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। মাত্র ১ গ্রাম প্রতিপদার্থই একটি নিউক্লিয়ার বোমার সমান বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। সে হিসেবে মানুষ যত প্রতিকণা তৈরি করেছে সেগুলো কী পরিমাণ শক্তি বহন করে? মানুষের তৈরি করা সবগুলো কণার শক্তি যদি একত্র করা হয় সেগুলো দিয়ে এক কাপ চা-ও তৈরি করা যাবে না।
প্রতিপদার্থ তৈরিতে খরচ ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও আকাশ ছোঁয়া। এক গ্রাম প্রতিপদার্থ তৈরিতে খরচ হবে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে যদি একটি টাকার প্যাকেট তৈরি করা হয়, তাহলে এরকম প্যাকেট লাগবে এক মিলিয়নেরও অধিক। কোথায় সোনা কোথায় হীরা? জগত এর চেয়ে মূল্যবান কিছু আর হতে পারে? এক গ্রাম প্রতিপদার্থ তৈরিতে লাগবে বিপুল পরিমাণ শক্তি। পরিমাণে সেটা ২৫ মিলিয়ন বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। তার উপর সেটাকে সংগ্রহ করে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ স্বাভাবিকভাবে কোনো পদার্থের সংস্পর্শে আসলেই সেটি ধ্বংস হয়ে যাবে। সেজন্য করতে হবে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা।
৪. ফাঁদে পড়া কুটুম
প্রতিপদার্থ কিংবা প্রতিকণা নিয়ে গবেষণা করতে গেলে প্রথমেই দরকার তাদের স্থায়িত্ব। তৈরি করার সাথে সাথেই যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তাদের নাড়িভুঁড়ি উলটে দেখার সুযোগ রইল কই? প্রতিকণারা যেন পদার্থের কণাদের সাথে মিলে ধ্বংস হয়ে যেতে না পারে সেজন্য উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। এরা বিদ্যুৎ ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়। প্রভাবিত হলে এই ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রতিকণাকে সাধারণ কণার সংস্পর্শ থেকে আটকে রাখা সম্ভব।
কোনো একটা ভ্যাকুয়াম টিউবের কথা কল্পনা করি। এর ভেতর প্রতিকণা তৈরি করা হল। টিউবের দেয়াল পদার্থ দিয়ে তৈরি। যদি বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে টিউবের দেয়ালের সাথে মিলে ধ্বংস হয়ে যাবে প্রতিকণা। তবে সেখানে তৈরি করা হলো বিশেষ এক চুম্বক ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের প্রভাবে দেয়ালের সংস্পর্শে যেতে পারবে না নবসৃষ্ট প্রতিকণা। তাহলে কিন্তু এর ভেতর কিছুটা স্থায়িত্ব পাচ্ছে এই অধরা জিনিসটি। বিজ্ঞানীরা এরকম যন্ত্র তৈরিও করেছেন। এই যন্ত্রের নাম দিয়েছেন পেনিং ট্র্যাপ। তবে সকল প্রতিপদার্থ এর মাধ্যমে আটকানো যায় না। অন্য ব্যবস্থা নিতে হয় তখন। এরকম একটি ব্যবস্থা হলো আয়োফ ট্র্যাপ।
পৃথিবীর চারপাশে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। সেখানে বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কণারা থাকে। তাদের চার্জ থেকে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিশেষ এই চৌম্বক ক্ষেত্রকে বলা হয় ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট। এটিও প্রতিপদার্থের ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। এখানে সময়ে সময়ে অ্যান্টিপ্রোটনের দেখা পাওয়া গেছে।
৫. আছে টান সবার মতোই
পদার্থ আর প্রতিপদার্থরা তো একে অন্যের বিপরীত। পদার্থরা মহাকর্ষের টানে নীচে নামে। তাহলে প্রতিপদার্থ? এরা কি পদার্থের উলটোটা করবে? না। পদার্থ ও প্রতিপদার্থের মাঝে বৈপরীত্য থাকলেও সাদৃশ্যও আছে। তাদের কণার চার্জ এবং স্পিন বিপরীত হলেও তাদের ভর কিন্তু স্বাভাবিকই। চার্জ কিংবা স্পিন মহাকর্ষীয় বলের মাঝে কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারে না। যার ভর আছে সে মহাকর্ষের টানে নীচে নামবেই, এবার সে পদার্থই হোক আর প্রতিপদার্থই হোক। কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলও বলছে মহাকর্ষ বল পদার্থ ও প্রতিপদার্থ উভয়ের উপর একইরকম আচরণ করবে।
তবে ব্যাপারগুলো এখনো হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। বিজ্ঞানীরা এর পেছনে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিপদার্থের উপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব কেমন তা পরীক্ষা করা, গাছ থেকে আপেল পড়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার মতো সহজ নয়। তবে তারপরেও বিজ্ঞানীরা লেগে আছেন AEGIS, ALPHA কিংবা GBAR এর মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রজেক্টে।
প্রতি পদার্থের আরো পাঁচকাহন জানতে দেখুন এখানে।
This article is in Bangla language. It discusses some facts about antimatter.
References: Symmetry Magazine, CERN, MIT Technology Review, Sanford Lab, National Centre for Biotechnology Information
Featured Image: CERN