Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাণিজগতের শীতনিদ্রা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

সায়েন্স ফিকশন গল্প, উপন্যাস কিংবা সিনেমাপ্রেমীদের নিকট একটি দৃশ্য বেশ পরিচিত। প্রয়োজনে পড়লে মহাকাশচারীরা বছরের পর বছর ধরে সুরক্ষিত কুঠুরির ভেতর একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে কোনোরূপ বিরতি ছাড়াই। মজার ব্যাপার হলো, এই সময়টুকুতে ঘুমন্ত মহাকাশচারীর বয়স একদম বাড়ে না। যেন সময়কে কোনো ভেলকিবাজির মাধ্যমে থামিয়ে দিয়েছে সেই কুঠুরি। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে সেই নিদ্রাভঙ্গ হতো। ঘুম থেকে উঠে তারা আবিষ্কার করতো এক ভিন্ন জগত। বেশ কয়েক বছরের নিদ্রার মাঝে বিশ্বজগতে ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। কল্পকাহিনীর এই Hibernation বা শীতনিদ্রার ঘটনা পড়ে অভিভূত হন অনেকেই। কর্মব্যস্ত জীবনে যখন হাঁপিয়ে উঠেন, তখন আনমনে ভাবতে থাকেন, কেমন হতো যদি কল্পকাহিনীর শীতনিদ্রার মতো এক ঘুমে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়া যেত? কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয় না। শুধু সত্য হয়ে থাকে কল্পনার রঙ্গমঞ্চে।

কেমন হতো যদি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতাম বছরের পর বছর; Image Source: Pixilart

কথাটা মানুষের ক্ষেত্রে কল্পনার ফানুস হলেও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে চিরন্তন সত্য। বিশেষ করে, শীতল রক্তের প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই শীতনিদ্রা হচ্ছে স্বাভাবিক ঘটনা। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জোরে বহু শীতল রক্তের প্রাণী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বৈরী পরিবেশে। সেই সাথে আমরাও কল্পনার ঘোরে বসে নেই। মানুষও চেষ্টা করছে কল্পকাহিনীর শীতনিদ্রাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে। কিন্তু সেটা কতদূর হলো? চলুন আজকের আলোচনায় এই শীতনিদ্রা নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক।

কী এবং কীভাবে?

শীতনিদ্রা শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে আরো দুটো শব্দ- শীত ও নিদ্রা। এর থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায় শীতনিদ্রার মানে কী। কিন্তু এর গুরুত্ব প্রাণীজগতে টিকে থাকার জন্য অনেক বেশি। শীতকালে যখন প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে যায়, কোথাও খাবারের দেখা মেলে না, তখন এই বৈরী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রাণীজগতে আবির্ভূত হলো শীতনিদ্রা। শুনতে সহজ মনে হলেও ব্যাপারটি একটু জটিল। হুট করে কোনো প্রাণী শীতনিদ্রায় তলিয়ে যেতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক প্রস্তুতি।

রুক্ষ শীতে আচ্ছন্ন প্রকৃতি; Image Source: Hike

প্রজাতিভেদে শীতনিদ্রার মাত্রা রকমফের হতে পারে, তবে সব প্রাণীই নিদ্রায় যাওয়ার পূর্বে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এর সাথে দেহের তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং বিপাক প্রক্রিয়ার মাত্রা লোপ পায়। নির্বিঘ্নে পুরো শীত কাটিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি নিরাপদ আশ্রয়। প্রজাতি অনুযায়ী একেক প্রাণী একেক স্থানে এই আশ্রয় খুঁজে পায়। সেটা মাটি খুঁড়ে তৈরি করা, কোনো গুহায় লুকিয়ে কিংবা গাছের ফাঁপা গুঁড়িতে দখল নিয়ে হতে পারে। নিদ্রাকালীন সময়ে প্রাণীরা কোনো ধরনের খাবার গ্রহণ করে না। এসময়ে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য কয়েক দিন আগে থেকে প্রাণীরা প্রচুর পরিমাণে স্নেহ ও তেল জাতীয় পদার্থ খেয়ে থাকে। শীতনিদ্রা সাধারণত শীতকালে ঘটে থাকলেও কোনো কারণে যদি প্রাণীর খাবার ঘাটতি হয় বা এর বাসস্থানে দ্রুত তাপমাত্রা পতন ঘটে বা প্রাণীর দেহে হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে তাহলে জরুরি ভিত্তিতে শীতনিদ্রা ঘটতে পারে। শীতনিদ্রার সময় প্রাণী একবারও মলমূত্র ত্যাগ করে না। এবার একটি মজার তথ্য জানা যাক। শীতনিদ্রা আপাতদৃষ্টিতে প্রাণীর দীর্ঘ শীতকালীন ‘নিদ্রা’ হিসেবে মনে হলেও সবসময় এটা নিদ্রা নয়। গবেষকদের মতে, অনেক প্রাণী সংক্ষিপ্ত শীতনিদ্রায় লিপ্ত হয় যাকে ‘টরপর’ (Torpor) বলা হয়। টরপর অর্থ দৈহিক এবং মানসিক নিষ্ক্রিয়তা। তাই অনেক ক্ষেত্রে আমরা যেটাকে অলস নিদ্রা মনে করছি, সেটা টরপর ছাড়া কিছুই নয়। টরপরে থাকা প্রাণীকে খুব সহজে জাগিয়ে তোলা যায়। কোনো জোরালো শব্দ শুনলেই এরা উঠে বসবে। কিন্তু শীতনিদ্রায় থাকা প্রাণীদের নিদ্রা তুলনামূলক গাঢ় হয়।

টরপর পূর্ণাঙ্গ শীতনিদ্রার চেয়ে হালকা হয়; Image Source: Twitter

কারা শীতনিদ্রায় যায়?

শীতনিদ্রায় যাওয়া প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ভালুক, মৌমাছি, শামুক, সাপ, কাঠবিড়ালি, গ্রাউন্ডহগ, প্রেইরী কুকুর, বাদুড়, ব্যাঙ ইত্যাদি। এছাড়া কমন পুরউইল নামক পাখির ক্ষেত্রেও শীতনিদ্রা দেখা যায়। ধরে ধরে সবগুলো প্রাণী সম্পর্কে বলতে গেলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে, তাই খুব সংক্ষেপে সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটি প্রাণীর শীতনিদ্রা সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।

প্রথমেই আসি ভালুকের কথায়। শীতপ্রধান দেশে মানুষ শীতনিদ্রা কথাটি শুনলেই বলে উঠবে ভালুকের কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা পূর্ণাঙ্গ শীতনিদ্রায় যায় না। এরা টরপরপন্থী। এদের নিদ্রা গড়ে ৬ মাসের মতো দীর্ঘ হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে এরা খাবার না গ্রহণ করলেও স্ত্রী ভালুক বাচ্চা প্রসব করতে পারে। এদের দেহে তাপমাত্রার পতন অন্যান্যদের তুলনায় কম হয়, তাই এরা জেগে উঠলে দ্রুত দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। বসন্তের সময় যখন গাছে নতুন পাতা গজায়, তখন ভালুকরা তাদের গুহা থেকে বেড়িয়ে আসে। এ সময় এদের দেহে প্রচণ্ড ক্ষুধার উদ্রেক হয় বিধায় এরা হিংস্র হয়ে পড়ে।

গুহায় শীতনিদ্রারত ভালুক; Image Source: Animal Sake

তারপর আসা যাক বাদুড়ের কথায়। ধারণা করা হয়, সেই ডাইনোসরের আমল থেকে পৃথিবীতে টিকে আছে একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড়। এদের শীতনিদ্রা পূর্ণাঙ্গ। এরা এতটা গভীর নিদ্রায় থাকে যে, দেখলে মনে হয় মৃত বাদুড় ঝুলে আছে। এরা তখন প্রতি ঘণ্টায় একবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এদের শীতনিদ্রার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন হয় না। গুহা, গাছের গুঁড়ি, পুরাতন খনি, কুয়া ছাড়াও এরা দরকার পড়লে মানুষের বাসস্থানেও শীতনিদ্রায় ডুব দিতে পারে। এরা বেশিরভাগ সময় দলগতভাবে এই নিদ্রা ঘটায়। শীতকালে ব্যাঙরাও নিদ্রায় যায়। এরা দেহে গ্লুকোজ জমা করে রাখে যা তাদেরকে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ডাঙায় পাথুরে এলাকা এবং গর্তে শীতনিদ্রা ঘটালেও কিছু কিছু ব্যাঙ পানির ভেতর শীতনিদ্রায় লিপ্ত হয়। ব্যাঙের শীতনিদ্রা অনেক সময় সুদীর্ঘ হয়। বিজ্ঞানীদের জরিপ থেকে জানা যায়, কিছু কিছু ব্যাঙ প্রায় তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত শীতনিদ্রায় সুপ্ত ছিল।

দলবদ্ধভাবে শীতনিদ্রায় বাদুড়; Image Source: John Misachi

পতঙ্গের মধ্যে শীতনিদ্রায় যাওয়া সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে মৌমাছি। তবে এদের শীতনিদ্রা অনেকটা ক্ষমতাপ্রীতির নিদর্শন। মৌমাছির মৌচাকে রাণী, শ্রমিক ও পুরুষ মৌমাছি থাকে। এদের মধ্যে শুধু রানী মৌমাছি শীতনিদ্রার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করে এবং বাকিরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। নিদ্রার পূর্বে রানীী প্রচুর পরিমাণ সুধা পান করে দেহে জমা রাখে। অতিরিক্ত শীত পড়লে এদের দেহে গ্লিসারল উৎপন্ন হয় যা এদেরকে বরফে জমে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। পাখিদের মধ্যে কেবল একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শীতনিদ্রা দেখা গেছে। কমন পুরউইল পাখি গাছের গুঁড়ি কিংবা পাথরের আড়ালে চার মাসের জন্য শীতনিদ্রায় যায়। অন্যান্য পাখিদের ক্ষেত্রে কদাচিৎ শীতনিদ্রার প্রয়োজন পড়ে এবং সবক্ষেত্রেই সেটা টরপর পদ্ধতিতে হয়ে থাকে।

কমন পুরউইল পাখি; Image Source: Christian Nunes/City of Boulder CC

শুধুই কি শীতকালে এই নিদ্রা ঘটে?

শীতনিদ্রা শব্দটি বলছে এটি শুধু শীতকালে সম্ভব। কিন্তু সেটা সবসময় সত্য নয়। বরং গ্রীষ্মকালেও প্রাণীদের এই শীতনিদ্রায় যেতে দেখা গেছে। ইংরেজিতে এই গ্রীষ্মকালীন শীতনিদ্রাকে বলে Estivation। গ্রীষ্মকালে যখন অতিরিক্ত গরমে সবকিছু শুকিয়ে যায়, তখন অনেক প্রাণী পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে মারা পড়ে। এই বৈরী পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রাণীরা এই গ্রীষ্মনিদ্রা ঘটাতে পারে। তবে এই নিদ্রা টরপরের মতো অনেকটাই হালকা ধাঁচের হয়। সুবিধাজনক আবহাওয়ায় মাত্র দশ মিনিটের মাথায় প্রাণী এই নিদ্রা ত্যাগ করে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতে। শীতনিদ্রার মতো এই গ্রীষ্মনিদ্রাও প্রাণীর দেহে পানি এবং শক্তি সংরক্ষিত রাখে।

গ্রীষ্মকালেও অনেক প্রাণী নিদ্রায় যায়; Image Source: Ferdinand Bada

অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে শামুক, গুবড়ে পোকা, মধু পিঁপড়া, বগং মথ, আলফা আলফা উইভিল, অস্ট্রেলিয়ান কাঁকড়া এবং মেরুদণ্ডীদের মধ্যে মরু কচ্ছপ, স্যালামাণ্ডার, ক্যালিফোর্নিয়ান লাল পেয়ে ব্যাঙ, আফ্রিকান লাংফিশ, মালাগাছি লেমুর, পূর্ব আফ্রিকান কাঁটাচয়া প্রাণীর মধ্যে এই গ্রীষ্মকালীন নিদ্রা দেখা যায়।

মানুষ কেন শীতনিদ্রালু প্রাণী নয়?

বিবর্তনের চক্রে বহু প্রাণীর মাঝে শীতনিদ্রার বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ মানুষের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। এর পেছনে কারণ কী? বিজ্ঞানীরা এর পেছনে দুটো কারণকে দায়ী করেছেন। মানব বিবর্তন ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় আমাদের পূর্বপুরুষরা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে বসবাস করতো এবং তাদের মাঝে শীতনিদ্রার কোনো নিদর্শন দেখা যায়নি। মানুষ মাত্র বিগত সহস্রাব্দে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করেছে। মাত্র এই কয়েক হাজার বছরে মানুষের মাঝে বড় ধরনের বিবর্তন ঘটা প্রায় অসম্ভব বলা যায়, কারণ বিবর্তনের জন্য এটা খুব কম সময়।

মানুষ শীতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সেই আদিম যুগ থেকে; Image Source: Alex Hibbert

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ধরা হয় মানুষের চমৎকার অভিযোজন ক্ষমতাকে। মানুষ শীতকে পরাস্ত করতে প্রয়োজনীয় আগুন, বস্ত্র, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসছে। দীর্ঘ শীতে পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহের জন্য মানুষ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করছে। যার ফলে মানুষের দেহে শীতনিদ্রার কোনো প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।  

জাপানের অলৌকিক ঘটনা!

২০০৬ সালে জাপানের বুকে ঘটে গেলো এক অলৌকিক কাণ্ড! সেবার শীতের সময় এক জাপানি হাইকার পাহাড়ি অঞ্চলে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো প্রায় ২৪ দিন পর তুষারাবৃত অবস্থায়। মাত্র ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টানা ২৪ দিন থাকার পর কারো বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই হাইকার বেঁচে থাকলেন। কিন্তু কীভাবে? দেখা গেলো এই ২৪ দিন সময়ে তার দেহের সব বিপাক ক্রিয়া একেবারে শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছিলো। বলতে গেলে তার দেহ যন্ত্রের মতো ‘সুইচ অফ’ হয়ে ছিলো। তার দেহের তাপমাত্রা প্রায় ২১ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে পুনরায় সুস্থ করে তোলা হয়।

মিতসুতাকা উচিকোশি; Image Source: Finans

মিতসুতাকা উচিকোশি নামক সেই হাইকারের ঘটনা শুনে সবার মনে একই প্রশ্ন উঠে আসলো, তিনি কি শীতনিদ্রার মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন? এর মানে কি দাঁড়ায়, মানুষের মাঝেও শীতনিদ্রা সম্ভব? সেটার উত্তর এখনও বিজ্ঞানীরা জানেন না। জনাব উচিকোশির ন্যায় মাত্র কয়েকজন সৌভাগ্যবান এখন পর্যন্ত এভাবে প্রাণে বেঁচেছেন, যা দৈবাৎ ঘটে থাকে। তবে ‘দৈবাৎ’ শব্দের উপর ভিত্তি করে মানুষের গবেষণা থেমে নেই।

জাপানের হাইকার ঘটনার এক বছর পূর্বে সিয়াটলে ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত কোষ বিজ্ঞানী মার্ক রথ হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস দিয়ে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে কৃত্রিম শীতনিদ্রা আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। তিনি ল্যাব ইঁদুরের উপর অতিরিক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেন, যা প্রাণীর দেহের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়, দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। এভাবে ইঁদুরটি কৃত্রিম শীতনিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা বাদে তিনি হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস বদলে দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস প্রয়োগ করেন। এবার ইঁদুরটি পুনরায় জ্ঞান ফিরে পায় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। পরবর্তীতে ইঁদুরের দেহে কোনোরূপ অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি।

ল্যাব ইঁদুরের উপর প্রয়োগ করা হয় হাইড্রোজেন সালফাইড; Image Source: Video Blocks

পরবর্তীতে তারা ইঁদুর থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে গোলকৃমির উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা শুরু করেন। কারণ হিসেবে রথ জানান,

“হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের প্রতি একটি গোলকৃমির প্রতিক্রিয়া ঠিক মানুষের মতো হয়। যদি একজন মানুষকে অতিরিক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস দেওয়া হয়, সে খুব দ্রুত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। এরপর যদি তাকে বিশুদ্ধ বাতাস দেওয়া হয়, তাহলে সে জ্ঞান ফিরে পাবে। তবে সেটা না করা হলে মানুষটি মারাও যেতে পারে।”  

এই পরীক্ষা এখন পর্যন্ত মানুষের দেহে প্রয়োগ করা হয়নি। সামান্য অসাবধানতায় খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে সেটা রথের শেষ বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। বিজ্ঞানী রথ নিজেও স্বীকার করেছেন, মানুষের জন্য আরো নিরাপদ পদ্ধতি আবিষ্কার না হলে তা প্রয়োগ করার ঝুঁকি নেওয়া হবে না।

থেরাপিউটিক হাইপোথার্মিয়া

শীতনিদ্রা শুধু অন্য প্রাণীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে অনুকরণ করার প্রচেষ্টা নয়। বরং শীতনিদ্রাকে আয়ত্ত করতে পারলে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিপ্লব রচিত হবে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ অন্যান্য হৃদরোগজনিত সমস্যার চিকিৎসায় শীতনিদ্রা বেশ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এজন্য হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো গ্যাস ব্যবহারের মুখাপেক্ষী নন তারা। তারা ভাবছেন অন্য বিকল্পের কথা, যেটা থেরাপিউটিক হাইপোথার্মিয়া নামে পরিচিত।

চিকিৎসাক্ষেত্রে শীতনিদ্রা বিপ্লব ঘটাতে পারে; Image Source: SinaiEM

এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির দেহের সংবহনতন্ত্রে বিশেষ শীতল স্যালাইন খুব সতর্কতার সাথে প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে ব্যক্তির দেহের তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায় এবং বিপাক ক্রিয়ার হার হ্রাস পায়। অনেক ক্ষেত্রে স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে বরফ প্যাকেট এবং শীতলক ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে মানবদেহ ক্ষণস্থায়ী শীতনিদ্রা বা টরপর অবস্থায় চলে যায়। এটি হাইড্রোজেন সালফাইডের ন্যায় মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না। এভাবে টানা ১৪ দিন এক ব্যক্তিকে টরপর অবস্থায় অচেতন রাখার রেকর্ড রয়েছে। এই প্রতিবেদন দেখে হয়তো ভাবছেন, আমরা বোধহয় শীতনিদ্রাকে প্রায় জয় করে ফেলেছি। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। বিষয়টি এখনও চিকিৎসাখাতে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্ম অনুমোদিত নয়। এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে কি না, তা এখনও গবেষণাধীন রয়েছে।

শীতনিদ্রাই হতে পারে মহাকাশ জয়ের চাবি; Image Source: Aliens Film Archive

পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে লেগে যায় প্রায় নয় মাস। এই সময়ে একজন নভোযাত্রীর মহাকাশযানে সুস্থভাবে টিকে থাকার জন্য বিশুদ্ধ বায়ু, খাদ্য এবং পানি গ্রহণ করার প্রয়োজন পরে। কয়েক বছর পর মানুষ মঙ্গল থেকে আরো দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করার জন্য প্রচেষ্টা করবে। সেখানে ভ্রমণ করতে হয়তো বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। এত দীর্ঘ সময় ধরে দৈহিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থেকে ভ্রমণ করা বেশ কঠিন। তাছাড়া যেসব স্থানে ভ্রমণ করতে শত বছরের মতো লেগে যেতে পারে, সেখানে এক আয়ুষ্কালে মানুষের ভ্রমণ করার কোনো উপায় নেই। এসব সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান হতে পারে শীতনিদ্রা। কিন্তু ঠিক কবে নাগাদ আমরা একে জয় করতে পারবো, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা সুসংবাদ পাবো। আপাতত সেটারই অপেক্ষা।

This is a Bangla article about animal hibernation and the future of our space odyessey. It simultaneously asks and answers a vital question- Can we acquire artificial hibernation just like we have seen in science fictions movies?

Reference: All the references are hyperlinked. 

Feature Image: BroBile

Related Articles