Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যারি মার্শাল: পেপটিক আলসারের মূল রহস্য উন্মোচনকারী একজন চিকিৎসক

চিরাচরিত সত্য কোনোকিছুকে সহজে প্রশ্নবিদ্ধ করে বদলে ফেলা কখনো সম্ভব নয়। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন অধ্যবসায়ের। যুগে যুগে বিজ্ঞান এরই প্রমাণ বহন করে এসেছে যে, একে প্রশ্নবিদ্ধ না করে কোনোকিছু হাছিল করা যাবে না। প্রতিষ্ঠিত পরম সময়, পরম ভর ও পরম দৈর্ঘ্য ধারণাকে ‘পরম’ তত্ত্বের আওতা থেকে বের করে এনে আপেক্ষিক তকমা পেতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েকশো বছর। অবশেষে একজন বিজ্ঞানী আভির্ভূত হন বিংশ শতাব্দীতে, তিনি আবার কোনো পদার্থবিদ নন, তিনি একজন অফিস ক্লার্ক; নাম তাঁর আলবার্ট আইনস্টাইন। অফিসে সময় দেবার পাশাপাশি লিখে ফেলেন জীবনের শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্র, পদার্থবিজ্ঞানকে টেনে নিয়ে যান অন্য এক চূড়ায়।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন; Image Source: biography.com

আবার যদি জ্যোতির্বিদ্যার কথা স্মরণ করা হয়, চিরাচরিতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে সত্যটি সবার মনে আসে তা হলো, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড অনবরত পরিক্রম করছে। একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয় ধর্মীয় কর্তাব্যাক্তিদের। একবিংশ শতাব্দীতে এসে কিন্তু সেই কর্তাব্যাক্তিদের উত্তরসূরীদেরকে হার মানতে হয়।

এসকল ঘটনায় কিছু সাধারণ ব্যাপার রয়েছে। যারাই কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্যকে বদলাতে চেয়েছেন, তারা এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছেন, শত বাঁধাতেও দমে যাননি, বরং বারবার প্রমাণ খুঁজে চলেছেন নিজ তত্ত্বের পক্ষে। স্রোতের বিরুদ্ধে চলতে গিয়ে অনেক কিছুই হারিয়েছেন হয়তো, তবু সেই প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে নতুন সত্য জাহির করে দিয়েছেন। তাদের সত্যকেও প্রশ্ন করা হয়, বরং বিজ্ঞান নিজেই উৎসাহ দেয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হোক যদি কারো মনে হয়, এতে ভুল রয়েছে।

এমন করে করেই তো এগিয়েছে বিজ্ঞান, আমরা পেয়েছি আজকের ডিজিটাল বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানের কর্তাগণ যে ধারণাকে ভিত্তি করে আছেন, কারো যদি মনে হয় তারা ভুল, তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যুক্তি ও প্রমাণ প্রকাশ করা বাঞ্চনীয়, কিছু একটা মনগড়া মত বলে দিয়ে তর্কের সৃষ্টি করাটা কিন্তু শোভা দেয় না।

স্রোতের বিরুদ্ধে চলা মানুষগুলোর সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তেমনি একজন মানুষ হলেন ব্যারি মার্শাল। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক।

আমাদের দেশের মানুষকে বিবেচনায় আনলে বলা যায় যে, ‘পেপটিক আলসার’ কিংবা ‘গ্যাস্ট্রাইটিস’ রোগটি সংখ্যায় ভয়াবহ, কিন্তু গুণে-মানে সাধারণ রোগ। আমরা ধরেই নিয়েছি যে, এই রোগ থাকবেই। একটু নিয়ম করে চললে এই সমস্যাগুলো তৈরিই হতো না। যা-ই হোক, এই ব্যাপারে বিস্তারিত অন্য কোনোদিন লেখা যাবে।

অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ব্যারি জেমস মার্শাল প্রমাণ করে দেখান যে, পেপটিক আলসার ব্যাকটেরিয়াঘটিতও হতে পারে। যেখানে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সত্য ছিলো পেপটিক আলসার হয়ে থাকে মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ঝালযুক্ত খাবার খাওয়া কিংবা পাকস্থলীতে অধিক অম্ল নিঃসরণের ফলে। এখানে সামান্য কৌতূহল সৃষ্টি হতে পারে পাঠকদের মনে যে, আলসার তো আলসার, এর পেছনের কারণ যেটাই হোক না কেন, আলসার বদলে যাবে না নিশ্চয়ই।

ব্যারি মার্শাল; Image Source: jonas-toelle.com

চিকিৎসাবিজ্ঞান কাজ করে থাকেন রহস্যময় পদ্ধতিতে। চিকিৎসাবিজ্ঞান যদি জানতে পারে একটি রোগের কারণ, তাহলে সেই কারণটিকেই সমূলে উদঘাটনের মাধ্যমে রোগটি ভালো করে থাকে। ঝালযুক্ত খাবার কিংবা অধিক অম্ল নিঃসরণে হওয়া আলসার থেকে ব্যাকটেরিয়াঘটিত আলসার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য সুখবর। কারণ কষ্ট করে যদি একবার জেনে নেয়া যায় ব্যাকটেরিয়ার নাম-পরিচয়, তাহলেই সেখানে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে ব্যাকটেরিয়া মুক্তি ঘটানো সম্ভব হবে। অতঃপর যেটুকু ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেই লক্ষ্যে চিকিৎসা দেয়া যাবে।

পেপটিক আলসারকে সমূলে উদঘাটন করাটাও খানিকটা গল্পের মতো, সৃষ্টিকর্তা নিজেই যেন তাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। বাকি পথ স্রোতের বিপরীতে তিনি চলেছেন, কষ্ট হয়েছে, সবার কাছে বিরুদ্ধাচরণমূলক বক্তব্য ছাড়া কিছুই পাননি।

আশির দশকে তিনি এমবিবিএসের পর ইন্টার্ন শেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হবার লক্ষ্যে পড়াশোনা শুরু করেন। এজন্য দ্বিতীয় কুইন এলিজাবেথ মেডিকেল সেন্টার ছেড়ে চলে যান রয়্যাল পার্থ হাসপাতালে। এখানে যাবার মূল কারণ ছিলো, ওপেন হার্ট সার্জারির ব্যাপারে আরো বিস্তারিত পড়াশোনা করা।

রয়্যাল পার্থ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় ডিউটি রুটিন অনুযায়ী তাকে আসতে হয় ‘গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগে’। এই ছিলো তার জীবনের মোড় ঘুরে যাবার মুহূর্ত। তিনি হয়তো কার্ডিওলজিতে ক্যারিয়ার গ্রহণ করতেন, তার বদলে পেয়ে যান জীবনের লক্ষ্য।

রবিন ওয়ারেন; Image Source: Wikipedia

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগে কাজ করতেন একজন প্যাথোলজিস্ট; রবিন ওয়ারেন। রবিন তাকে দেখান যে, তিনি কিছু আলসার রোগীর বায়োপসি করতে গিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান। ব্যাপারটি অদ্ভুত, কারণ পাকস্থলীতে প্রচন্ড মাত্রায় অম্লীয় পরিবেশ বিরাজ করে, সেখানে কোনো ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকবার কথা নয়।

ঘটনাটি ব্যারির কাছে আগ্রহের মনে হয়, তিনি তার বিভাগীয় প্রধান টম ওয়াটারসকে জিজ্ঞাসা করেন যে, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগে একটি ব্যক্তিগত গবেষণা শুরু করতে পারবেন কিনা। টম ওয়াটারসের অনুমতি পেয়ে ব্যারি মার্শাল, রবিন ওয়ারেনকে সাথে নিয়ে শুরু করেন তার গবেষণা।

খুব দ্রুতই ব্যারি এবং রবিন আবিষ্কার করেন যে, যেসকল রোগী গ্যাস্ট্রাইটিস ও পেপটিক আলসারে আক্রান্ত, তাদের সবার পাকস্থলীর বায়োপসিতে একই ধরনের ব্যাকটেরিয়া দেখতে পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অনেকটা সর্পিলাকার। মার্শাল অনুভব করেন যে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো যদি আলসার তৈরির প্রধান কারণ হয়ে থাকে তাহলে তৎকালীন আলসার চিকিৎসায় বিপর্যয় চলে আসবে, সবধরনের আলসার চিকিৎসাব্যবস্থা বদলে ফেলে এর পরিবর্তে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। সর্পিলাকার এই নতুন ব্যাকটেরিয়ার নামকরণ করা হয় ‘হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি’।

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি; Image Source: thingsitellmymom.com

তৎকালীন আলসার চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তনের এ তো কেবল শুরু, ব্যারি মার্শাল শুধু প্রশ্ন তুলেছেন। সর্বজনের স্বীকৃতি পেতে তাকে পেরোতে হবে অনেক লম্বা রাস্তা।

চিকিৎসক সম্প্রদায় ব্যারির এই নতুন আনকোড়া তত্ত্ব মানতে চাইলো না, ব্যারির কাছে পাল্টা প্রশ্ন রাখা হলো, পাকস্থলীতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়াটাই নিশ্চিত করে না যে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলোই আলসার এবং গ্যাস্ট্রাইটিসের জন্য দায়ী। তাছাড়া এটাও সুপ্রতিষ্ঠিত, পাকস্থলীর পরিবেশ এতটাই অম্লীয় যে, এখানে কোনো ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকারই কথা না।

যদিও ইতোমধ্যেই ব্যারি মার্শাল অ্যান্টিবায়োটিক ও বিসমাথ প্রয়োগে বেশ ক’জন আলসার রোগীকে সারিয়ে তুলেছিলেন, তবু তার আবিষ্কার স্বীকৃত হয়নি চিকিৎসক সমাজে। তাকে জানানো হয়, ব্যাক্টেরিয়া যদি জীবিত থেকেই থাকে, তবে সেগুলো কোনো ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া নয়। কেননা খাদ্য পরিপাকের জন্য অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়া অতীব প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। তেমনি উপকারী কোনো ব্যাক্টেরিয়া হয়তো পাকস্থলীতে পাওয়া গেছে। এই মন্তব্যে কিন্তু ব্যারি দমে যাননি, নিজের ধারণায় অটল রইলেন।

তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে তর্ক করে লাভ কিছু হবে না, তাকে আরো প্রমাণ যোগাড় করতে হবে নিজ আবিষ্কারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে। প্রমাণ যোগাড় করতে তাকে কোনো গিনিপিগ নির্বাচন করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তিনি যদি কোনো অবুঝ প্রাণীতে এই পরীক্ষা চালান, চিকিৎসক সম্প্রদায় এখানেও খুঁত বের করতে পারে, কোনো সুস্থ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় এই ব্যাক্টেরিয়া সেবন করতেও চাইবে না।

সকল দিক বিবেচনায় রেখে, ব্যারি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, নিজের আবিষ্কারকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি নামক ব্যাক্টেরিয়া সেবন করবেন। যদি দেখা যায়, এর ফলে তিনি গ্যাস্ট্রাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে যদি এ অবস্থা থেকে তিনি পরিত্রাণ পেতে পারেন; কেবল তখনই নিজ আবিষ্কারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন।

মাত্র ৩২ বছর বয়সে, ব্যারি এই নতুন আবিষ্কৃত ব্যাক্টেরিয়া মিশ্রিত পানি পান করে নেন। ধীরে ধীরে তার পাকস্থলীতে গ্যাস্ট্রাইটিসের সূচনা হয়, পাকস্থলীয় ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। পাকস্থলীর বায়োপসিতে ঘুরে-ফিরে আবারো জীবিত হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর তিনি শুরু করেন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন।

ব্যারি মার্শালের এই গবেষণার ফলাফলকে ভিত্তি করেই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে গ্যাস্ট্রাইটিস এবং আলসার চিকিৎসা। ১৯৯৪ সালের দিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, গ্যাস্ট্রাইটিস এবং আলসার নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনই হবে মোক্ষম পদ্ধতি।

অনেকগুলো কারণ, যুক্তি ও পূর্ব চিকিৎসাব্যবস্থা ছিলো, ব্যারি পারতেন চিকিৎসক সম্প্রদায়কে মেনে নিয়ে পিছিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি গ্যাস্ট্রাইটিস ও আলসার রোগীদের পরীক্ষার ফলাফল দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন, মনে এতটাই বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিলো যে, কোনোকিছু তাকে নিজের ধারণা থেকে সরাতে পারেনি। তিনি ছুটছিলেন তার তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, বিশ্বাস ছিলো এই ব্যাক্টেরিয়া তত্ত্বে। নিজের সুস্থ-স্বাভাবিক শরীরকে দিয়েই পরীক্ষা করেছেন। এই অধ্যবসায় এবং একাগ্রতার ফলাফল অবশেষে তার হাতে ধরা দিয়েছে।

Image Source: Youtube

এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের দরুণ ২০০৫ সালে ব্যারি মার্শাল ও রবিন ওয়ারেন যুগ্মভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগে নোবেল পুরষ্কার পান।

Related Articles