উত্তরাখণ্ড, হিমালয়ের কোলজুড়ে থাকা এই রাজ্যের আরেক নাম দেবভূমি। কেউ এখানে আসেন অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগে আর কেউ এখানে আসেন ঈশ্বরের নৈকট্যের আশায়। দুর্গম এই পার্বত্য এলাকার একদিকে তিব্বত সীমান্ত অন্যদিকে নেপাল। ভূরাজনৈতিক আলাপ আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে চোখ মেলে তাকালে চারদিকেই চোখে পড়বে তুষার আচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণি, পর্বত থেকে নেমে আসা নদী, ঝর্ণা আর বিচিত্র প্রাণী। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা পর্বতের বুকে লুকিয়ে আছে এক সবুজ সাম্রাজ্য, পর্বতের ভাঁজে ভাঁজে আছে হাজারো প্রজাতির দুর্লভ লতাগুল্ম।
তবে এই চোখ জুড়ানো সবুজের মাঝে কাঁটা হয়ে আছে ‘চির পাইন’ গাছ। হিমালয়ের বিশেষ এই পাইন প্রজাতিটিকে ব্রিটিশরা শনাক্ত করে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা শুরু করে। চির পাইন থেকে পাওয়া যায় মূল্যবান রেজিন ও কাঠ। এর রেজিনের ব্যাপক ব্যবহার আছে আঠা, রাবার এবং উদ্ভিজ্জ তেল উৎপাদনে। বর্তমানে এই চির পাইনের বাণিজ্যিক বন বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে গেছে চার লক্ষ হেক্টরের বিশাল দুর্গম এলাকাজুড়ে। যার অনেক জায়গাতেই মানুষের বসতি কম, স্থানীয় নৃগোষ্ঠীরাই এই দুর্গম এলাকায় বসতি গেড়ে থাকছেন, বংশানুক্রমে কেউ শত শত বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে। কেউ আবার দাবানলের কবলে ছেড়েছেন পিতৃভিটা।
দাবানলের কবলে
দুর্গম এই বনভূমিতে দাবানলের অন্যতম প্রধান কারণ এর পাতা, যাকে পাইনের কাঁটাও বলা হয়, ইংরেজিতে ‘পাইন নিডলস’। পরিসংখ্যানের পাতায় একটু তাকালেই দেখা যাবে, বছরে উত্তরাখণ্ডের পাইন গাছেরা মিলে প্রায় ১৩ লাখ টন পাইন কাঁটা বিসর্জন দিয়েছে। শুকনো পাইনের কাঁটা মারাত্মকভাবে দাহ্য, এবং একবার কোনোক্রমে আগুনের সূত্রপাত হলে মাসের পর মাস ধরে বনাঞ্চল জ্বলতে থাকে। পাইনের বন ছাড়িয়ে আশেপাশের লতাগুল্ম, কাঁচা বনাঞ্চল এমনকি জনবসতি পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয় এই আগুন। এই আগুনের মাঝে জনবসতি পড়লে ভিটেমাটি ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় নেই। তাই দীর্ঘদিন যাবত শুকনো পাইনের কাঁটার মাঝেই অশুভ শক্তির সন্ধান করেছেন অনেকে।
এই দুর্গম পাইনের বনের মাঝে যাদের বসবাস তাদের অর্থনীতি, খাদ্য, কৃষি এই বনের সাথে নির্ভরশীল। বন থেকে খাদ্যদ্রব্য, ঔষুধী লতাপাতাও সংগ্রহ করেন অনেকে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় ১৮০০ জাতের ঔষুধী গুনাগুণ সম্পন্ন লতাগুল্ম এবং গাছগাছালি আছে। এর বাইরেও উত্তরাখণ্ডের পর্বত, নদী, হিমবাহ আর গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে আসেন প্রচুর পর্যটক, তাই কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্রিক সমবায় সমিতি, যেখানে স্থানীয়রা গাইড হিসেবে কাজ করতে পারে। উত্তরাখণ্ডের কিছু জায়গায় এই সমিতিগুলোর মাধ্যমে পর্যটকরা চাইলে স্থানীয়দের বাড়িতেই থাকতে পারেন, খাওয়া দাওয়া করতে পারেন।
দাবানলের আঘাত আসলে স্থানীয়দের পুরো এলাকা ছেড়ে পালাতে হয়, সহায় সম্বল অনেকটা পেছনে ফেলেই। আবার সবকিছুই গড়ে তুলতে হয় নতুন করে।
কাঁটায় সমাধান
দাহ্য পাইনকে কোনোভাবে কাজে লাগানো গেলেই এই সমস্যার একটি আপাত সমাধান পাওয়া যাবে। উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলে রজনীশ জেইন নামের এক ব্যক্তি প্রথম কাজ শুরু করেন, তার লক্ষ্যই ছিল পাইনের কাঁটাকে মূল্যবান কিছুতে পরিণত করা যায় কিনা। যেহেতু শুকনো পাইনের কাঁটা দাহ্য তাই যদি এটি থেকে ব্যবহারযোগ্য নিরাপদ জ্বালানি তৈরি করা গেলে একসাথে কয়েকটি সমস্যার সমাধান করা যাবে।
জ্বালানির জন্য পাহাড়ি জনপদ বেশিরভাগই কাঠ কয়লা কিংবা কেরোসিনের উপর নির্ভর করে। তাছাড়া ঘরের আলো কিংবা অন্য কাজেও জ্বালানি তেল আনতে হয়, যে জনপদ যত দুর্গম সেখানে জ্বালানি তেলের দামও তত বেশি। রজনীশ জেইন পাইনের কাঁটাকে ‘বায়োম্যাস গ্যাসিফিকেশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জ্বালানিতে রূপান্তরিত করা যায় কিনা তা নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
প্রক্রিয়াটি কী?
ধানের তুষ, শুকনো পাতা, শুকনো নারিকেলের ছোবড়ার মতো উচ্চ দাহ্য বস্তুকে বলা হয়ে থাকে 'সলিড বায়োমাস'। গ্রীষ্মের রোদে খটখটে হয়ে শুকিয়ে যাওয়ার পর ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ছাড়াও আফ্রিকার স্বল্পোন্নত বিভিন্ন এলাকায় এটিকে সরাসরি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সেখানে আগুনের তাপে দ্রুত বায়োমাসকে পুড়িয়ে ফেলার ফলে আসলে যতটুকু শক্তি পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় না। আর তখন এটি শুধুমাত্র রান্নাবান্নার কাজেই ব্যবহার করা যায়। নগরায়নের সাথে সাথে সেই সুযোগটিও কমে আসছে অনেক ক্ষেত্রে। কারণ এই বায়োমাস পুড়ালে প্রচুর কালি তৈরি হয় যা আশেপাশের পরিবেশকেও নষ্ট করে। তাই নাগরিক জীবনেও জীবাশ্ম জ্বালানির উপর প্রভাব বাড়ছে।
তাই স্বল্পমূল্যের এই বায়োমাসকে যদি এমন কোনো ব্যবস্থায় নিয়ে আসা যায় যেখানে কম অক্সিজেনের উপস্থিতিতে উচ্চ তাপমাত্রায় বায়োমাসকে উত্তপ্ত করে গ্যাস উৎপাদন করা যাবে। সেই গ্যাসকে ব্যবহার করা যাবে জ্বালানীর কাজে এবং অদাহ্য কার্বন কালিকেও আলাদা করে নেওয়া যাবে। এখান থেকেই জন্ম নেয় ‘বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের’ মূল ধারণার। সহজে বলতে চাইলে বায়োমাসকে জ্বালানি উপযোগী গ্যাসে রূপান্তর করা হবে, সেই গ্যাস দিয়ে চালানো যাবে জেনারেটর কিংবা অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।
বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের এই ধারণা নিয়ে সুইডেন, জার্মানি, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ভারত, কাজ হয়েছে বিভিন্ন দেশে। দেশ অঞ্চলভেদে বায়োমাসের ধরনও আলাদা, যেমন ভারতের কর্ণাটকের ত্রিশটি বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের ইউনিট কাজ করছে। সবগুলোই কাজ করছে কৃষিক্ষেত্র এবং বনাঞ্চল থেকে স্বল্পমূল্যে পাওয়া বায়োমাস নিয়ে।
২০০৭ সালে রজনীশ চেষ্টা করছিলেন এ কাঁটা বায়োমাস হিসেবে ব্যবহার করে বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। শুরুতেই সরকারি দপ্তরে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সবার ধারণা ছিল, পর্যাপ্ত পাইন কাঁটাই পাওয়া যাবে না এই কাজ করার জন্য, গ্রামবাসীরাও খুব একটা আস্থা রাখতে পারেনি এই চিন্তায়।
শেষপর্যন্ত পাইনের কাঁটা নিয়ে তাকে বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের প্ল্যান্ট স্থাপনে সহায়তা করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রথমে বিফল হলেও, চেষ্টা করে রজনীশ বুঝতে পারলেন পাইনের কাঁটা শুকিয়ে একে ছোট ছোট অংশে কাটলে এর থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। ২০০৯ সালে পাইনের কাঁটায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজটি সফল হয়, যার প্রাথমিক ক্ষমতা ছিল নয় কিলোওয়াট-ঘণ্টা। এবং এই প্রক্রিয়ার ফলে অবশিষ্ট হিসেবে যে হাই-কার্বন পাউডার পাওয়া যাবে, তা দিয়ে কার্বন-চাকতি তৈরি করা যাবে। এই কার্বন চাকতি গ্রামীণ পরিবেশেই রান্নার কাজে সাধারণ মাটির চুলায়ও ব্যবহার করা যাবে।
রজনীশ জেইন এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘Avani Bio Energy’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে। বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইন কাঁটা সংগ্রহ করে দিচ্ছে গ্রামের মানুষজন, বিনিময়ে কেজিপ্রতি দুই রুপি দিচ্ছেন তিনি। শুধুই পর্যটন নির্ভর অর্থনীতিতে একটি বিকল্প কর্মসংস্থানের যোগ হওয়ায় এর মাধ্যমে মধ্যবয়স্ক কর্মহীন মানুষেরা কাজে যুক্ত হতে পারছে। তবে এই পাইন কাঁটা সংগ্রহের ব্যাপারটি পুরোটাই এখনো সম্পূর্ণ মানুষের শ্রমের উপর নির্ভরশীল এবং এখনো অনেক দুর্গম এলাকা রয়ে গেছে যেখান থেকে এই পাইন কাঁটা সংগ্রহ করে বয়ে নিয়ে আসা কঠিন। তাই আলাদা আলাদা করে ২৫ কিলোওয়াট ঘণ্টার সাতটি প্ল্যান্ট চালু করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। এবং সবগুলোতেই গ্রামীণ স্থানীয় উদ্যোক্তারাই তাদের নিজেদের মতো করে কাজ করছেন।
পাইনের কাঁটা যেহেতু কমে গেছে, শুষ্ক মৌসুমে বনের দাবানলও কমে এসেছে অনেকাংশে, যদিও তা এখনো শূন্যের কোঠায় নেমে আসেনি। তবুও কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রামীণ জনপদ, সেখানে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের একটুখানি ছোঁয়া, পাইন কাঁটা সংগ্রহ করে হয়েছে বিকল্প কর্মসংস্থান।
This article is about the utilization of pine needles in the Himalayan region to produce electricity, which will save the forest from potential wildfire. All the sources are hyperlinked in the article.
Featured image source: BBC/ Alamy