একটা সময় যুদ্ধ হতো ঘোড়ায় চড়ে কিংবা তরবারি হাতে। কালের পরিক্রমায় যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন এসেছে। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসে মধ্যযুগের মতো সম্মুখযুদ্ধের কথা ভাবা যায় না। এখনকার যুদ্ধকে একরকম প্রযুক্তির লড়াই বলা যায়। যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যত ভালো, সেই দেশের সেনাবাহিনী প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তত বেশি উন্নত।
মধ্যযুগের ইতিহাসে বলে, সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা যুদ্ধজয়ের পেছনে বৃহৎ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। তবে আজকের যুগে শুধুমাত্র বৃহৎ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কোনো দেশ সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। সামরিকভাবে সক্ষম হতে হলে প্রয়োজন সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন।
একবিংশ শতাব্দীতে মিলিটারি প্রযুক্তিতে এমনই এক অন্যতম হাতিয়ার ড্রোন। ড্রোন হলো এমন একটি চালকবিহীন আকাশযান, যা কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একে যুদ্ধক্ষেত্রে তুরুপের তাস বলা যায়। বিশেষ প্রযুক্তির উন্নত ড্রোনগুলো সহজেই রাডার ফাঁকি দিয়ে শত্রুঘাঁটিতে হামলা করে মুহুর্তেই যুদ্ধের মোড় বদলে দিতে পারে। তবে ড্রোনের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। এটি যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণের কাজে ব্যবহৃত হয়, তেমনই এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের উপর গোপন নজরদারিও করা যায়। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরাখবর নেওয়া, দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় সাহায্য পৌঁছানো, সিনেমার দৃশ্য ধারণ, ফটোগ্রাফি ইত্যাদির কাজেও আজকাল ড্রোনের ব্যবহার বহুল প্রচলিত।
আজ আলোচনা করা হবে ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো নামের একটি বিশেষ ড্রোনের ব্যাপারে। এটি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ড্রোনগুলোর একটি। প্রথম দেখাতে যে কেউ একে বাচ্চাদের খেলনা ভেবে ভুল করতে পারে। তবে শত্রুপক্ষের কাছে এ যেন এক ভয়ংকর গুপ্তচর!
ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো
হলিউডের মুভিগুলোতে হরহামেশাই ক্ষুদ্রাকৃতির স্পাই ড্রোন দেখা যায়। কিন্তু শুধু সিনেমাতেই না, বাস্তবেও সেসবের অস্তিত্ব আছে।
আমেরিকার বৃহৎ সামরিক সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠান ফ্লির সিস্টেম (Flir System)-এর অধীনে নরওয়ের প্রক্স ডায়নামিক (Prox Dynamic) ২০০৮ সালে ক্ষুদ্রাকৃতির চালকবিহীন ড্রোন নিয়ে কাজ শুরু করে। প্রায় ৩ বছর চেষ্টার পর তারা ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো সফলভাবে তৈরিতে সক্ষম হয়। ২০১২ সালে এসে প্রক্স ডায়নামিক ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানোর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো ড্রোনটি দেখতে একদম খেলনা হেলিকপ্টারের মতো। লেটেস্ট মডেলের ৬.৬ ইঞ্চি লম্বা এই ড্রোনটির ওজন মাত্র ৩৩ গ্রাম হওয়ায় খুব সহজেই একে পকেটে বহন করা যায়। একটি কন্ট্রোলার ডিভাইসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২ কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যাটারিতে ফুল চার্জ থাকাবস্থায় ঘন্টায় সর্বোচ ২১ কিলোমিটার বেগে টানা ২৫ মিনিট উড়তে পারে ড্রোনটি। ওড়ার সময় শব্দ এতটাই কম হয় যে, সর্বোচ্চ ১০০ মিটার উচ্চতায় ওড়ার সময় ড্রোনটি দেখে অনেকেই একটি ছোট পাখি ভেবে ভুল করতে পারেন।
একটি ব্ল্যাক হর্নেট সর্বনিম্ন -১০ ডিগ্রি থেকে সর্বোচ্চ +৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, জিপিএস কাজ করে না এমন জায়গাতেও উড়তে পারে অনায়াসে। ফলে এর মাধ্যমে কোনো দুর্গম গুহায় ওত পেতে থাকা শত্রুপক্ষ বা আটকে পড়া শ্রমিক কিংবা অভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
এতে রয়েছে ৩টি বিশেষ ধরনের উন্নতমানের ক্যামেরা, যেগুলো দিনে এবং রাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সক্ষম। এর একটি বিশেষ সুবিধা হলো, যদি শত্রুপক্ষের কাছে কোনোভাবে ধরা পড়ে যায়, তবে শত্রুপক্ষের বোঝা সম্ভব নয় এর মাধ্যমে তাদের কোন কোন তথ্যগুলো ফাঁস হয়েছে। কারণ ব্ল্যাক হর্নেটকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, এটি কেবল কন্ট্রোলার ডিভাইসেই লাইভ ভিডিও ও স্থিরচিত্র প্রেরণ করে থাকে, ড্রোনটির আলাদা কোনো স্টোর নেই যেখানে ভিডিও সংরক্ষিত থাকবে।
ব্ল্যাক হর্নেটের কন্ট্রোল অপারেটর ডিভাইস থেকে একাধিক ড্রোন একইসাথে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আবার চাইলে দুজন অপারেটর একইসাথে একটি ড্রোন থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এটি যেমন কন্ট্রোলার ডিভাইস দিয়ে কোনো ব্যবহারকারী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তেমনই কন্ট্রোলার ডিভাইসে ম্যাপ যুক্ত করে দিলে সেই ম্যাপ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবেও উড়তে পারে।
ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানোতে বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ড্রোনটির ব্যবহারকারী চমৎকার কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেমন: কোনো কারণে যদি কন্ট্রোলার ডিভাইসের সাথে ড্রোনটির যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটে, তবে এটি যেখান থেকে ওড়ানো হয়েছিল ঠিক সেই জায়গাতে চলে আসবে। তাছাড়া এটি ওড়ানোও বেশ সহজ, মাত্র ৩০-১২০ সেকেন্ডে সময় নেয় যেকোনো মিশনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে।
অন্যান্য ড্রোনের চেয়ে খরচ তুলনামূলক কম হওয়াতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানোর বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে। হওয়াটাও স্বাভাবিক, কারণ দুর্গম অঞ্চল বা দুর্ধর্ষ শত্রু অবস্থানের উপর গোপন নজরদারিতে এটি অতুলনীয়।
ব্যবহার
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ২০০২ সালের পর আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ শুরু করে, তার সমাপ্তি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এসে। প্রায় ১২ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধরত ব্রিটিশ সেনারা বিভিন্ন সময় আফগানিস্তানের আল-কায়দা এবং তালেবানদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তাদের অধীনে সংঘটিত অপারেশনগুলোর সাংকেতিক নাম ছিল 'অপারেশন হেরিক'। ২০১২ সালের পর সার্ভিসে আসা ব্ল্যাক হর্নেট ড্রোনগুলো ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয় অপারেশন হেরিকের প্রায় প্রতিটি মিশনে।
আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন যুদ্ধের ফলে অধিকাংশ শহর ধ্বংসের স্তুপে পরিণত হয়। ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোতে হরহামেশাই ওত পেতে থাকত তালেবান কিংবা আল-কায়েদার যোদ্ধারা। তাই ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো ড্রোনটি আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের কাছে যেনে তৃতীয় চক্ষুতে পরিণত হয়।
কোনো অপারেশনে যাওয়ার আগে এর সাহায্যে সহজেই শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একজন সৈন্যের পরবর্তী পজিশন নেওয়াসহ আফগান সিভিলিয়ানদের মাঝে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের শনাক্ত করার কাজে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো।
এই ড্রোনের মাধ্যমে যে কেবল পরিষ্কার লাইভ ভিডিও বা স্থিরচিত্রই পাওয়া যায় তা নয়, এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের পুঁতে রাখা মাইনও শনাক্ত করা যায়।
ছোট একটি ড্রোনের এত বেশি সুবিধার কারণেই ব্রিটিশ সেনাদের কাছে ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো আফগানিস্তানে যুদ্ধ-সরঞ্জামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি কার্যকর ন্যানো ড্রোন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেও এর কদর বৃদ্ধি পায়।
প্রক্স ডায়নামিক এই ড্রোনটির বাণিজ্যিক উৎপাদন করলেও এটি কেবল কোনো দেশের সরকারই কিনতে পারবে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিনতে চাইলে সেক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন। কারণ এতে বিভিন্ন নিরাপত্তাজনিত ব্যাপার রয়েছে।
বর্তমানে আমেরিকার স্পেশাল ফোর্স, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে ও ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশের সেনাবাহিনী ব্ল্যাক হর্নেট ন্যানো ড্রোনটি ব্যবহার করছে।
This is a Bengali article discussing the Black Hornet Nano in details.
Reference:
1. PD-100 Black Hornet Nano Unmanned Air Vehicle
2. Microdrones for military. Black Hornet for Polish Commando Unit
4. Black Hornet Personal Reconnaissance System (PRS)
5. The Black Hornet Is A $195,000 Spy Plane That Fits In Your Hand
6. FLIR-owned Prox Dynamics brings night vision to tiny drone
7. Top 5 Advancements in the FLIR Black Hornet 3 Nano-UAV
9. The Pocket-Sized Black Hornet Drone Is About To Change Army Operations Forever
10. The eight inch spy in the sky: Tiny 'Black Hornet' helicopters snoop in Afghanistan
11. Miniature surveillance helicopters help protect front line troops
Feature Image Source: Wikipedia