Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভূমিকম্পের নির্ভুল পূর্বাভাস দেয়া কি সম্ভব?

ভূমিকম্পকে অনেক সময়ই সবচেয়ে বিরল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা হয়, যা সাধারণত দীর্ঘদিন পর পর হয়ে থাকে। তবে এ ধারণা আংশিক সত্য। পৃথিবীতে প্রতিদিনই শতাধিক ভূমিকম্প হয়, যেগুলো এত দুর্বল যে আমরা টের পাই না। রিখটার স্কেলে ৩/৪ মাত্রার নীচের ভূমিকম্প অধিকাংশ সময়ই টের পাওয়া যায় না। 

তবে অন্যান্য দুর্যোগ থেকে ভূমিকম্প যেখানে আলাদা তা হলো- এটি শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। একুশ শতকের এই অগ্রসর বিজ্ঞানও নির্ভুলভাবে ভূমিকম্পের আগমনী সংকেত দিতে পারে না, যে কারণে তুরস্ক-সিরিয়ায় হয়ে যাওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে, এবং বাড়ছেই। কিন্তু ভূমিকম্পের মতো এমন প্রবল দুর্যোগ কেন নির্ণয় করা যায় না?

ভূমিকম্পের উৎপত্তি

কোনো কারণে পৃথিবী কম্পিত হলেই তাকে ভূমিকম্প বলা যায়। ধরন যতটা সহজ, কার্যকরণ ততটাও নয়। পৃথিবীপৃষ্ঠের নীচে ভূ-অভ্যন্তরে রয়েছে বৃহৎ কঠিন পাথরের স্তর, যেগুলো ফাটল দ্বারা বিভক্ত, এবং টেকটোনিক প্লেট নামে পরিচিত। 

Image Source: Caltech Science Exchange

পৃথিবীর উপরিতল মূলত ৭টি বৃহৎ টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত, যেগুলো একে অপরের সাথে স্থিতিস্থাপক অবস্থায় থাকে। যখন দুটি টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তন হয়, স্থিতিস্থাপকতা বিনষ্ট হয়, এবং একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখনই ভূমিকম্প হয়। টেকটোনিক প্লেটের এই ফাটলকে বলে ফল্ট। সহজেই অনুমেয় যে- বিশাল টেকটোনিক প্লেটগুলো কখন আন্দোলিত হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। 

ভূমিকম্পের আভাস দেয়ার প্রচেষ্টা

গবেষণা বলছে, ভূমিকম্পের কিছু সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো বিশ্লেষণ করে ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দেয়া সম্ভব হতেও পারে। উদাহরণস্বরূপ, ছোট-বড় সব ভূমিকম্পেই কম্পন একটি ধারা মেনে চলে। কম্পন প্রথমে বাড়তে থাকে, এবং বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আবার ধীরে ধীরে কমে যায়। তবে কম্পনের বৃদ্ধি অংকের সাধারণ গণনার মতো হয় না, বরং গুণিতক আকারে বৃদ্ধি পায়। যে কারণে রিখটার স্কেলে প্রতিটি এককের চেয়ে তার পরবর্তী একক ১০ গুণ শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ১ মাত্রার ভূমিকম্প যতটুকু কম্পন সৃষ্টি করে, ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তার ১০ গুণ শক্তিশালী। 

কিছু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। ভূ-অভ্যন্তরে অত্যধিক চাপে পাথরের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাটল (মাইক্রো ফিশার) তৈরি হয়, যা পাথরে পানির ব্যাপ্তিযোগ্যতার পরিবর্তন ঘটায়। ফলে সেখানকার হাইড্রোকেমিস্ট্রিতেও পরিবর্তন আসে যা থেকে ভূমিকম্পের আগমনী বার্তা পাওয়া সম্ভব। 

আবার কিছু ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পূর্বে কিছু খনিজ পদার্থে রেডনের পরিমাণের তারতম্য ঘটে। এই তারতম্য কোনো নির্দিষ্ট ধারা বজায় রেখে ঘটে না বলে ভূমিকম্পের সাথে এর কোনো সংযোগ স্থাপন করা এখনও সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, টেকটোনিক পাথরে তৈরি হওয়া ক্ষুদ্র ফাটলগুলো দিয়ে রেডন গ্যাস ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে, যা থেকে ভূমিকম্প সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এ ব্যাপারে সন্দিহান, কেননা পাথরের ক্ষয়, ভূমিধস বা ভূগর্ভস্থ পানিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণেও এরূপ রেডন গ্যাস তৈরি হতে পারে। 

ভূমিকম্প নির্ণয়ের আরেকটি উপায় হলো তড়িৎচুম্বক শক্তি। কিছু পাথর প্রচণ্ড চাপে ভেঙে পড়বার পূর্বে তড়িৎচুম্বক শক্তি বিকিরণ করে। এই শক্তি পরিমাপ করেও ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটে সঞ্চিত শক্তির আভাস পাওয়া সম্ভব। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘Foreshock’ বা বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কম্পন, যেগুলো ধরতে পারলে আসন্ন শক্তিশালী ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব।

বৈজ্ঞানিক কার্যকরণের বাইরে প্রাচীনকাল থেকে পশুপাখির আচরণ দেখে ভূমিকম্পের আভাস পাওয়ার ব্যাপারটি প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আগে পশুপাখি অস্বাভাবিক আচরণ করে; এরকম বেশ কিছু প্রমাণও রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা চলছে, তবে এটাও খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য পন্থা নয়। 

ভূমিকম্প হবে জানা যাচ্ছে, কখন হবে জানা যাচ্ছে না

আলোচিত এ উপায়গুলো অনির্ভরযোগ্য হলেও একটি ব্যাপার বহু আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত যে, সক্রিয় ফল্ট লাইনগুলোয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবেই। যদি আমরা সাম্প্রতিক তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে- ইস্ট আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইনে ১৯৭০ সালের পর থেকে কেবল তিনটি ৬ বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। আনাতোলিয়া, আরব এবং আফ্রিকা- তিনটি টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থলে তাই একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হবারই কথা ছিল। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী এই ভূমিকম্পের কেন পূর্বাভাস দেয়া গেল না?

Image Source: BBC

আমরা যখন গবেষণাগারে ভূমিকম্পের সিমুলেশন পরীক্ষা চালাই, আমরা অনেক প্রকার ফাটল এবং ভূমিকম্পের নিয়ামক দেখতে পাই। কিন্তু প্রকৃতিতে এ ব্যাপারগুলো অনেক বেশি অনিশ্চিত, যে কারণে আমরা বড় ভূমিকম্প ঘটার আগেই এগুলো দেখতে পাই না,” সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস মেরুন। 

বড় ভূমিকম্পের পূর্বে প্রাথমিক ছোট কম্পনের সিসমিক সিগন্যাল ধরতে না পারার কারণ হিসেবে মেরুন অত্যধিক শব্দদূষণকে দায়ী করেন। পৃথিবীজুড়েই রয়েছে অসংখ্য টেকটোনিক ফল্ট যেগুলো আসলে প্রতিনিয়তই চলনশীল এবং ভূ-অভ্যন্তরে প্রচণ্ড শব্দ ও শক্তি বিকিরণ তৈরি করে। তবে ভূগর্ভস্থ খনিজ, গ্যাস এবং পৃথিবীর কেন্দ্রের গলিত লার্ভার কারণে এসব সিসমিক সিগন্যাল শনাক্ত করা কঠিন। পাশাপাশি, মানবসৃষ্ট শব্দদূষণ তো আছেই। 

মূলত, একটি ভূমিকম্পের সফল ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য তিনটি তথ্য প্রয়োজন- কোথায় হবে, কখন হবে এবং কত মাত্রার হবে। গত শতাব্দী থেকেই নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা চলছে এ বিষয়ে, তথাপি এমন কিছুই আবিষ্কৃত হয়নি যার মাধ্যমে এই তিনটিই সঠিকভাবে বলা সম্ভব।

এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের পূর্বাভাসে বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সাফল্য হলো ‘হ্যাজার্ড ম্যাপ’। কোনো একটি নির্ধারিত অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে (মাত্রা নির্ধারিত নয়) ভূমিকম্প হতে পারে- এরূপ আভাস দিতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এতে ঐ অঞ্চলে প্রাথমিক সতর্কতা, যেমন- দুর্বল স্থাপনা শনাক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু তা ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা দূর করে না। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই কি পারবে পূর্বাভাস দিতে?

ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাসের প্রচেষ্টায় সর্বশেষ সংযোজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স)। অসংখ্য সিগন্যালের মাঝে প্রয়োজনীয় সিগন্যালগুলো একটি প্যাটার্নের মাধ্যমে ধরতে সক্ষম হবে এআই। আর এআইকে প্রশিক্ষণ দিতে এ বিষয়ক গবেষণাও চলছে। এক্ষেত্রে ছোট ছোট গ্রানাইট ব্যবহার করে গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে সেগুলোর উপর চাপ তৈরি করা হয়, এবং একসময় সেগুলো টেকটোনিক প্লেটের মতো ঘর্ষণ তৈরি করে যা থেকে ক্ষুদ্র কম্পন হয়। একে বলা হয় ‘ল্যাবকোয়াক’। 

এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো স্থিতিস্থাপক তরঙ্গ যা টেকটোনিক ফাটলের মধ্য দিয়ে বিকিরিত হয়, এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে শনাক্ত করা সম্ভব। এই তরঙ্গ শনাক্ত করার মাধ্যমে টেকটোনিক ফাটলের ক্রমশ ভেঙে পড়া এবং ভূকম্পনের পূর্ববর্তী ক্ষুদ্র কম্পনগুলো শনাক্ত করে কখন ফল্ট লাইনের স্থিতিস্থাপকতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। তবে গবেষণাগারে এটা করা গেলেও প্রায়োগিকভাবে এখনই করা যাচ্ছে না। এছাড়াও, শতভাগ নির্ভরযোগ্য না হলে কোনো একটি বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া ব্যয়বহুল এবং ঝামেলাপূর্ণ।

তথাপি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোজন দ্রুতই কোনো সমাধান এনে দিতে পারে, ভূমিকম্পের মতো জানমাল বিনাশী দুর্যোগ মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

Language: Bangla
Topic: Can Earthquake be predicted correctly?
References: Hyperlinked inside
Feature Image: General Electric

Related Articles