Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সেলুলোজ: প্রকৃতির এক অনন্য উপহার

ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ই মানুষ সবকিছুর জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। শিল্প বিপ্লবের পর প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে কৃত্রিম উপায়েও অনেক প্রয়োজন মেটাতে শুরু করে। তবে শিল্প বিল্পব কৃত্রিম উপায়ে প্রয়োজন মেটাবার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যাও তৈরি করে। ফলে একপর্যায়ে বিজ্ঞানীরা আবারো প্রকৃতি থেকেই মানুষের প্রয়োজন মেটাবার তাগিদ অনুভব করেন।

প্রকৃতিতে যে উপাদানটি সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে সেলুলোজ। উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের মূল উপাদান এটি। ফলে গাছের কাণ্ড, পাতা, বাকল, ফুল, ফলের ছাল- সবকিছুতেই সেলুলোজ পাওয়া যায়। উদ্ভিদভেদে সেলুলোজের প্রাপ্যতা কম বেশি হতে পারে। কিন্তু যেখানেই গাছ আছে, সেখানেই থাকবে সেলুলোজ। ফলে সেলুলোজ বর্তমানে গবেষণাখাতের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। গাছ থেকে যেমন সেলুলোজ আহরণ করা হচ্ছে তেমনই পরিবেশের স্বার্থে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম সেলুলোজ নিয়েও গবেষণা করে চলেছেন।

রাসায়নিক গঠন ও প্রাপ্যতা

রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে সেলুলোজ একধরনের পলিস্যাকারাইড। এর রাসায়নিক সংকেত (C6H10O5)n। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য তুলার প্রায় ৯০% হচ্ছে সেলুলোজ। তুলার জাত এবং উৎপাদন স্থানের উপর নির্ভর করে একটু এদিক-সেদিক হতে পারে কিন্তু তুলার রাসায়নিক উপাদানের প্রায় পুরোটাই সেলুলোজ। গাছের জাতভেদে কাঠের প্রায় ৪০-৫০% থাকে সেলুলোজ। গাছের পাতায় থাকতে পারে ৫০-৬০% পর্যন্ত। আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল পাটে আছে প্রায় ৮০%। এছাড়া আখের ছোবড়ায় আছে ৭৫% এরও বেশি।

তুলার প্রায় ৯০% উপাদানই সেলুলোজ; Image Source: Wikimedia commons

প্রকৃতিতে শুরু থেকে থাকলেও গাছের বাকল থেকে প্রথম সেলুলোজ আলাদা করেন ফরাসি রসায়নবিদ অ্যানসেলম পায়েন। তিনি সেলুলোজকে আলাদা করার পাশাপাশি এর রাসায়নিক সংকেতও বের করেন। ১৯২০ সালে হারমান স্ট্যাওডিনজার বের করেন সেলুলোজ পলিমারের গাঠনিক সংকেত।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উপাদান থেকেই সেলুলোজ আহরণ করা হতো। ১৯৯২ সালে প্রথম কৃত্রিমভাবে সেলুলোজ তৈরি করা সম্ভব হয়। বর্তমানে বিভিন্ন জাতের ব্যাকটেরিয়া থেকেও কৃত্রিমভাবে সেলুলোজ উৎপাদন করা যায়। তবে ব্যাকটেরিয়া থেকে সেলুলোজের উৎপাদন পদ্ধতিগুলো এখনো গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ আছে।

উৎপাদন পদ্ধতি

তুলা কিংবা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সেলুলোজ আলাদা করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে এসিড হাইড্রোলাইসিস। তবে এসিড হাইড্রোলাইসিস করার পূর্বে সেলুলোজের সাথে থাকা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় উপাদান যেমন লিগনিন, পেকটিন, হেমিসেলুলোজ দূর করতে হয়।

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এসব দূর করার জন্য বিভিন্ন রকম পদ্ধতির কথা আছে। যেমন সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড কিংবা সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড আর ইউরিয়ার মিশ্রণ ব্যবহার করা। এরপর আলাদা করা অংশকে বিভিন্ন এসিড দিয়ে হাইড্রোলাইসিস করা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন এসিডের জন্য সেলুলোজের অভ্যন্তরীণ গঠনের বেশ পার্থক্য খেয়াল করা যায়। কোন ধরনের কাজে ব্যবহার করা হবে তার উপর নির্ভর করে ঠিক করা হয় কীভাবে সেলুলোজ আলাদা করা হবে।

ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপে দেখা বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেলুলোজ
ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপে দেখা বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেলুলোজ; Image source: Carbohydrate polymers

সেলুলোজ আলাদা করার পদ্ধতির উপর নির্ভর করে আলাদা করা সেলুলোজের আকার কেমন হবে। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রেতা কোম্পানিগুলো মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজ বিক্রি করে থাকে। এ ধরনের সেলুলোজের আকার সাধারণত কয়েক মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। এক মাইক্রোমিটার হচ্ছে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। এ ধরনের সেলুলোজকে এমসিসি বলা হয় সংক্ষেপে। এই এমসিসিকে আবার রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে কয়েক ন্যানোমিটার আকার দেওয়া সম্ভব হয়। আর ন্যানোটেকনোলজির যুগে এই ন্যানো আকারের সেলুলোজের চাহিদাই বেশি।

সেলুলোজের বিভিন্ন ব্যবহার

বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সহজেই সেলুলোজ পাওয়া যায়। সহজলভ্যতার কারণে এর ব্যবহার গত কয়েক দশকে ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে শুরু করে অনেক সূক্ষ্ম জিনিসপত্র তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে সেলুলোজ। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেলুলোজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার।

সেলুলোজ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় কাগজ তৈরিতে। কাগজ তৈরির জন্য গাছের কাণ্ডের মণ্ড ব্যবহার করা হয়। আর এর মূল উপাদানই হচ্ছে সেলুলোজ। সম্প্রতি কৃত্রিম উপায়ে সেলুলোজ তৈরির প্রক্রিয়ার উপর বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে যেন নিত্য ব্যবহার্য বস্তু কাগজ তৈরিতে আর গাছ কাটতে না হয়। প্রকৃতিকে তার জায়গায় রেখেই যেন কাগজ তৈরি করা যায় সেদিকেই বিজ্ঞানীরা মননিবেশ করছেন।

বিজ্ঞানীরা এমন কিছু নিয়ে ভাবছেন যেন কাগজ তৈরি করতে গাছ কাটতে না হয়; Image source: hobbycraft.com

কাগজশিল্পের পরেই সেলুলোজ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বস্ত্রশিল্পে। যেকোনো কাপড় তৈরির জন্য তুলা, লিনেন, প্রভৃতি ব্যবহার হয়। তুলার মূল উপাদান তো সেলুলোজই। এছাড়াও সেলুলোজকে কৃত্রিম সিল্ক বা রেয়নে রূপান্তর করার পদ্ধতি সেই ১৮৯০ সালেই আবিষ্কার হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে আমরা সারাদিন কোনো না কোনোভাবে সেলুলোজকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করি।

সিনেমার কথা বলতে গিয়ে প্রায় সময়ই বলা হয় ‘সেলুলয়েডের ফিতা’। ডিজিটাল যুগের আগে এই সেলুলয়েডের ফিতাই ছিল স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিও ধরে রাখার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৮৭০ সালে সেলুলোজ থেকেই তৈরি করা হয় সেলুলয়েড। সরাসরি না হলেও পরোক্ষপভাবে অসংখ্য মানুষের বিনোদনে সাহায্য করেছে সেলুলোজ।

সেলুলয়েডের ফিতা তৈরি হতো সেলুলোজ থেকে; Image source: Film review London

জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ আর এ ধরনের জ্বালানি অনবায়নযোগ্য হবার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা বিকল্প জ্বালানির খোঁজ করছেন। এক্ষেত্রে জৈব জ্বালানি বেশ ভালো একটি বিকল্প হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে অনেক জায়গায় গরু-ছাগলের বিষ্ঠা থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হয়ে থাকে। একইভাবে সেলুলোজ থেকেও জৈব জ্বালানি পাওয়া সম্ভব। জেব্রার বিষ্ঠায় একধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে যা সব ধরনের সেলুলোজকে বিউটানলে পরিণত করে পারে। এ কারণে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ পদ্ধতিতে সেলুলোজ ব্যবহার করে জ্বালানি সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সেলুলোজ ব্যবহার হতে পারে ঘরবাড়ি তৈরিতেও। পানি কিংবা আগুনরোধী একধরনের পদার্থ তৈরি করা সম্ভব সেলুলোজ থেকে যা কৃত্রিম প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে নির্মাণকাজে ব্যবহার করা সম্ভব। আর প্রাকৃতিক উপাদান বলে পরিবেশ দূষণের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হয় না এক্ষেত্রে। বাণিজ্যিকভাবে খুব বেশি ব্যবহার না হলেও সেলুলোজের তৈরি এ ধরনের নির্মাণ উপাদানকে ভবিষ্যতের নির্মাণসামগ্রী হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে বর্তমানে।

সেলুলোজ হতে পারে ভবিষ্যতের জ্বালানি; Image source: greenchem.com

চিকিৎসাখাতেও রয়েছে সেলুলোজের ব্যবহার। সেলুলোজ দিয়ে হাইড্রোজেল ও অ্যারোজেল তৈরি করা হয়ে থাকে। পুড়ে যাওয়া ও ক্ষত চিকিৎসার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয় হাইড্রোজেল ও অ্যারোজেলকে। এসবের ভেতর অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল কিংবা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটারি ওষুধ দিয়ে একধরনের ড্রেসিং তৈরি করার চেষ্টা চলছে যাতে রোগীকে বারাবার ড্রেসিং খুলে পরিষ্কার করতে না হয়। এতে রোগীর খরচ ও কষ্ট দুই-ই কমবে।

ন্যানো আকারের সেলুলোজ বিভিন্ন পলিমারের সাথে খুব অল্প পরিমাণে মিশিয়ে কম্পোজিট তৈরি করা হয়। এতে মূল পলিমারের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। ফলে অনেক পলিমার যেগুলো সক্ষমতার কারণে ব্যবহার অযোগ্য ছিল সেগুলো এখন সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে।

সেলুলোজের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে দিন দিন এর উপর গবেষণার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। গবেষণা জার্নালগুলোতে খোঁজ করলে দেখা যাবে প্রায় প্রতিটিতেই সেলুলোজ নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের দেশের জন্য একটি সুবিধা হচ্ছে, যে তিনটি উদ্ভিদ থেকে সেলুলোজ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অর্থাৎ তুলা, পাট আর আখ, সেই তিনটিই আমাদের দেশে বেশ ভালো উৎপাদন হয়।

সরকারি অনুদানের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে যদি সেলুলোজের উপর গবেষণার জন্য অনুদান দেওয়া হয়, আমাদের দেশীয় গবেষকরা নিশ্চিতভাবে শত বাঁধার মাঝেও অনেক ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে। এ ধরনের গবেষণাগুলো শুরুর দিকে কোনো বাহ্যিক ফল দিতে না পারলেও দীর্ঘদিনের প্রেক্ষাপটে একসময় এগুলো থেকে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারবে।

ফিচার ইমেজ- Resource for the future

Related Articles