Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর যে ক্ষতি করছে

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের চেয়েও বড় হুমকি বলে অভিহিত করেছিলেন। কনজারভেটিভ বিশ্বাসের অনেকে যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাকে অস্বীকার করেন। আর করেন বিলিয়ন ডলারের শিল্প-বাণিজ্যের বণিকেরা। যেহেতু বৈশ্বিক এই হুমকিকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ শিল্পকারখানা থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনা, তাই শিল্পপতিদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মেনে নেয়া মানে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলা। নানা অজুহাতে তাই তারা জলবায়ু পরিবর্তন ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা চালান। যদিও সময়ের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি ফল হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সাগর অম্লকরণ। উভয়ক্ষেত্রেই প্রধান অপরাধীর ভূমিকা রাখছে মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস। কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস পৃথিবীর চারপাশে একটি আবরণ তৈরি করে, যা ভেদ করে সূর্যালোক থেকে সৃষ্ট তাপ বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ১৮৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝড়ঝাপ্টার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে থাকে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, বিশ্বব্যাপী ঝড়ঝাপ্টার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্যাটেলাইট থেকে তোলা সাগরের ওপর সৃষ্ট হারিকেনের দৃশ্য; Image source: Shutterstock

অধিক উষ্ণতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে জমে থাকা পেরেনিয়াল (বছরের পর বছর ধরে অক্ষত) বরফ গলতে শুরু করেছে। তাত্ত্বিকভাবে, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সমস্ত বরফ গলে গেলে তা সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ২২০ ফুট বৃদ্ধি করতে সক্ষম!

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সাগরের ওপর বাতাসের দিক, ফলশ্রুতিতে সাগরস্রোতের দিক, পরিবর্তিত হয়ে উষ্ণ পানির স্রোত মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই উষ্ণ স্রোত অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত গ্লেসিয়ার ভেঙে (Calving) বরফখন্ডকে সাগরে নিয়ে আসছে। বরফখন্ড সাগরের পানিতে চলে এলে তার গলিত হবার হার বেড়ে যায়।

বছর কয়েক আগে দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত একটি গ্লেসিয়ার ভেঙে ৬৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুবিশাল বরফখন্ড আমান্ডসান সাগরে চলে আসে। গ্লেসিয়ার ভেঙে বরফখন্ড সাগরে চলে আসা একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গ্লেসিয়ার ভাঙার হার বৃদ্ধি পাবার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একমত। যদিও সাগরে ভাসতে থাকা বিশালাকৃতির বরফখন্ড সম্পূর্ণরূপে গলে যাওয়া হাজার বছরের ব্যাপার, তবে আপাতকালীন হুমকি হিসেবে তুলনামূলকভাবে ছোট বরফখন্ডগুলো, যাদের আয়ুষ্কাল কয়েক বছরের বেশি নয়, জাহাজ দুর্ঘটনার আশংকা বৃদ্ধি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১২ সালে বিখ্যাত আরএমএস টাইটানিক জাহাজ ডুবেছিল এমন একটি প্রকান্ড বরফখন্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগেই।

টাইটানিক মুভিতে দেখানো বরফখন্ডের সাথে টাইটানিক জাহাজের সংঘর্ষের দৃশ্য; Image source: Pinterest

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গ্লেসিয়ার কাভিংয়ের পাশাপাশি মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবার পরিমাণ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২ সালের গ্রীষ্মে উত্তর মেরুর বরফের পরিমাণ ছিল স্যাটেলাইট রেকর্ডের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। জলবায়ু পরিবর্তন ধারণাবিরোধীদের দাবির বিপরীতে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্যাটেলাইট রেকর্ডে সিজনাল বরফের পরিমাণ সর্বনিম্নে পৌঁছানোর ছয়টি রেকর্ডের মধ্যে সবগুলোই সংঘঠিত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে! এই উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলীয় বরফ শুধু গলছেই না, যেসব বরফ গলছে না সেগুলোর পুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে।

মেরু অঞ্চলের বরফ সূর্যালোক প্রতিফলিত করে পৃথিবীকে শীতল রাখতে সাহায্য করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে অধিক হারে বরফ গলে যাবার কারণে পৃথিবীর সূর্যালোক প্রতিফলনের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সূর্যালোক প্রতিফলনের ক্ষমতা কমে যাবার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে সাগরপৃষ্ঠ থেকে পানি বাষ্পীভূত হবার পরিমাণ বাড়ছে। উৎপন্ন জলীয়বাষ্প কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের মতো সূর্যতাপের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধরে রেখে পৃথিবীকে উষ্ণতর করতে ভূমিকা পালন করছে। মোটকথা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এমন এক প্রক্রিয়া যা দুষ্টচক্রের একের পর এক পর্যায় সক্রিয় করার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে পৃথিবীর ওপর।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রক্রিয়া যেভাবে সূর্যতাপ ধরে রেখে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে; Image source: The Wellesley News

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি ভয়াবহ ফল হচ্ছে ওশান অ্যাসিডিফিকেশান বা সাগর অম্লকরণ। সমুদ্রবিজ্ঞানীরা একে, যথাযোগ্যভাবে, “The evil twin of global warming” বা “বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মন্দ জমজ” বলে থাকেন। পাশাপাশি এটি “The other CO2 problem” নামেও পরিচিত। সাগর অম্লকরণের জন্যও দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দোষে দুষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস।

কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি পানির সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বনিক এসিড (H2CO3) উৎপন্ন করে। এই কার্বনিক এসিড (প্রকৃতপক্ষে, বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হাইড্রোজেন আয়ন) দ্রাবক পানির অম্লত্ব বাড়িয়ে দেয়। একই ব্যাপার ঘটে সাগরে।

পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অবস্থিত কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের এক-চতুর্থাংশ সাগর শোষণ করে নেয়। এই গ্যাস সাগরের পানির সাথে বিক্রিয়া করে তার অম্লত্ব বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাগরে বসবাসরত জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। একইসাথে, হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের খাদ্যের যোগান। যেমন, সাম্প্রতিক সময়ে, পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ, বিশেষত চিংড়ি (বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিংড়ি অবশ্য মাছ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত নয়), পাবার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাসের পরিমাণ এতটাই প্রকট যে দীর্ঘদিনের ব্যবসা গোটানোর চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে!

ওশ্যান অ্যাসিডিফিকেশানের ফলে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রাণীর খোলস সাগরের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়;
Image source: Ocean Science

বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, শিল্পায়নের উত্থানপূর্ব সময় থেকে, অর্থাৎ ১৭৬০ সালের দিক থেকে, এখন পর্যন্ত সময়ে সাগরের পানির পিএইচ (pH) ০.১ একক হ্রাস পেয়েছে। পিএইচ হচ্ছে অম্লত্ব পরিমাপের একক। এই এককের স্কেল লগারিদমিক হওয়ায় হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এর ঘনত্ব হিসেবে সাগরের পানির অম্লত্ব বৃদ্ধির এই পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে ২৯%! শিল্পায়নপূর্ব সময়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ (মোল ফ্র্যাকশান) ছিল ২৮০ পিপিএম, গত বছর যা ৪০০ পিপিএমের রেকর্ড স্পর্শ করেছে। শতকরা হিসেবে এ বৃদ্ধির পরিমাণ ৪০%!

বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, বর্তমান সময়ে শিল্পকারখানাগুলো যে হারে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করছে তা কমানো সম্ভব না হলে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মোল ফ্র্যাকশান ১০০০ পিপিএম ছাড়িয়ে যাবে, যা সাগরের পানির অম্লত্ব বাড়িয়ে দেবে ১০০-১৫০%! আবার, গাছেরা সালোকসংশ্লেষণের কাঁচামাল হিসেবে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস ব্যবহার করে থাকে বিধায় বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীতে গাছপালার পরিমাণ এমনভাবে বাড়তে পারে যা পৃথিবীর জন্য স্বাভাবিক নয়। এককথায়, কিছু ব্যতিক্রম, যেমন- ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের কথিত গ্রহাণুপাত ইত্যাদি, ঘটনা ব্যতিরেকে, পৃথিবী তার সাড়ে চার বিলিয়ন বছর বয়সে যতটুকু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, শুধুমাত্র মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে গত ৩০০ বছরে মোকাবেলা করছে তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন!

বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধির মাত্রা ও হার আশংকাজনক; Image source: NOAA

জলবায়ু পরিবর্তন আজ এক অমোঘ বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আজ পৃথিবীকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সাগর অম্লকরণ নামক যুগ্মাঘাত (double whammy) মোকাবেলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চূড়ান্ত প্রভাব বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিধা ও মতভেদ থাকলেও এর ফলে পৃথিবীকে নেতিবাচক বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হবার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কোনো দ্বিমত নেই।

ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখতে শুরু করেছে পৃথিবী। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক আচরণ, পৃথিবীর ১০ কিলোমিটার উপর দিয়ে বয়ে চলা ঋতুচক্র প্রভাবকারী জেট স্ট্রিমের আকার পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সাগর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, সাগর অম্লকরণ- এসব আজ বিতর্কাতীত বাস্তবতা। বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের জন্য আতংকের ব্যাপার হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির দেশগুলো।

বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২১০০ সালের মধ্যে সাগরের পানির উচ্চতা ৩ ফুটের বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা প্লাবিত করবে বাংলাদেশের মতো নিম্নভূমির দেশগুলোর উপকূলীয় অঞ্চলকে। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিভূমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে খরা ও চরম তাপমাত্রা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বেড়ে গেছে সাইক্লোনের পরিমাণ। অর্থাৎ, সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি হোক কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সব দিক থেকেই আক্রান্তদের তালিকায় শুরুর দিকে আছি আমরা। তাই মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্যোগের অন্যতম ভিকটিম হিসেবে আমাদেরই উচিত সবার আগে সচেতন ও সোচ্চার হবার।

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ; Image source: Maplecroft

This Bangla article describes the bad impacts of climate change upon us. Necessary references have been hyperlinked.

Featured image: Lifegate

Related Articles