Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলবায়ু পরিবর্তন বাড়িয়ে দিতে পারে আত্মহত্যা হার

জলবায়ু পরিবর্তন- একবিংশ শতাব্দীর বহুল উচ্চারিত দু’টি শব্দ। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী, সচেতন সমাজ সংস্কারক এবং পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাদের উদ্বেগপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফল কী হতে পারে সেটাও তারা মতামতের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। কিন্তু চিত্র বদলাচ্ছে না। উন্নত দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। জাতিসংঘ সম্মেলন কিংবা জলবায়ু সম্মেলন – যেকোনো সম্মেলনে উন্নত দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের কাছ থেকে সম্মতি এবং আশারবাণী শোনা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা যেন কম হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে তারা কাজ করবেন, নিজেদের দেশে থেকে নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ কমিয়ে আনবেন – এমন অনেক অ্যাজেন্ডা দেন। কিন্তু এসব কথা শুধু বলা পর্যন্তই, আর ফল তো দেখতেই পাওয়া যায়।

এদিকে জলবায়ু গবেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। যেহেতু কোনো কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না, তাই তারা জলবায়ু পরিবর্তন হলে কী কী দুর্যোগ মানবজাতিকে পোহাতে হতে পারে সেগুলো সম্বন্ধে জানানোর চেষ্টা করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা জানি যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে, পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে চলে যাবে, মানবজাতির একটি পুরো অংশ স্থায়ী সমস্যার মুখে পড়ে যাবে। এসব সমস্যা হচ্ছে অনেক বড় পরিসরের সমস্যা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে মানুষের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা। এসব সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষও ওয়াকিবহাল নয়। আজকের লেখায় এসব সমস্যা নিয়েই আলোচনা করা হবে।

 জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে মানুষের মানসিক দিক দিয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে; Image Source: Media India Group

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাদের গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই আত্মহত্যার হার বেড়ে যেতে পারে বর্তমান সংখ্যা থেকে আরও প্রায় ১০,০০০। ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। কিন্তু কথাটি অনেকাংশেই সত্য। কারণ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আত্মহত্যার হার গরমকালেই বেশি হয়ে থাকে। এই তথ্যটি উদঘাটন করার পর বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটি নিয়ে আরেকটু গভীরে অনুসন্ধানের দিকে মন দিলেন।

তখনই ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়, এখানে জলবায়ু পরিবর্তনেরও সংযোগ আছে। Nature Climate Change নামক একটি জার্নালে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পায় যার শিরোনাম ‘Higher temperatures increase suicide rates in the United States and Mexico’। এই পেপারটিতে প্রধানত তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন শহরের গত কয়েক যুগের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, যদি কোনো এক মাসের কোনো এক দিনেরর তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে আত্মহত্যা করার প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ০.৭ শতাংশ এবং মেক্সিকোতে প্রায় ২.১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের মানসিকতার উপরও; Image Source: News Nation

জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক প্যানেল থেকে জানা যায় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তাপমাত্রা ২.৫ ডিগ্রি এবং মেক্সিকোর তাপমাত্রা ২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। যদি সত্যিই এরকম হয় কিংবা তাপমাত্রা এই ভবিষ্যদ্বাণীর কাছাকছিও যায় তাহলে আত্মহত্যার পরিমাণ নয় হাজার থেকে চল্লিশ হাজার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।

এই প্রবন্ধে এরকম হওয়ার পেছনে কিছু কারণের কথা উল্লেখ এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম কারণ হিসেবে গবেষকরা উল্লেখ করেন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন দেখা যায়। তাপমাত্রার বৃদ্ধি কিংবা হেরফেরের কারণে তাপীয় নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যেকারণে রক্ত যেভাবে প্রবাহ হওয়া উচিত ঠিক সেভাবে মস্তিষ্কে প্রবাহিত হয় না। এসময় শরীর নিজেদের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায়। তবে এই পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

Image Source: medicalnewstoday.com

গরমের সময় মানুষের মনোবৃত্তি কেমন হয়, কীভাবে তারা সাড়া দেয় এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সেটা বোঝার জন্য গবেষকরা একটি অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করেন। প্রচণ্ড গরমে মানুষ টুইটারে কীভাবে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সেটার উপর একটি জরিপ তারা করেন। সেই জরিপে উঠে আসে যেসব মাসে পরিবেশের তাপমাত্রা বেশি থাকে সেসময় টুইটারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা শব্দ হচ্ছে “lonely”, “trapped”, “suicidal” ইত্যাদি। প্রত্যেকটি শব্দই বিষাদগ্রস্থতার দিকে ইঙ্গিত করছে। এই সময়ের মধ্যে টুইটে ব্যবহার করা মোট শব্দের মধ্যে প্রায় ১.৩৫ শতাংশ শব্দ ছিল এই তিনটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে গবেষণা করা হয় সেটা হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ে বা পড়তে পারে। এর প্রভাবে যে মানসিক সমস্যাও হতে পারে, সেই সম্পর্কে কখনও গবেষণা করা হয়নি, বিশেষ করে আত্মহত্যার বিষয়টি একদমই নতুন। এর আগে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অন্য একটি গবেষণা করেন যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমাজে সহিংসতা বাড়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখেন। তাদের গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে, অতিরিক্ত গরম তাপমাত্রার কারণে মানুষের মধ্যে হিংসাত্মক আচরণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

অতিরিক্ত গরম তাপমাত্রার কারণে মানুষের মধ্যে হিংসাত্মক আচরণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে; Image Source: Climate Tracker

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই যদি ক্রমাগত পরিবেশের তাপমাত্রা তারতম্যের মধ্যে একটি শিশু বড় হয় তাহলে বড় হতে হতে তার শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যেতে পারে, যা তার পরবর্তী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত গরম মানুষের আয়ও কমিয়ে দিতে পারে।

Proceedings of National Academy of Sciences এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি প্রতিদিনের গড় তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হয় তাহলে বয়স ত্রিশের কোঠায় পৌঁছলে তাদের আয় ০.১ শতাংশ কমে যায়। তবে গবেষণাটিতে সব শিশুদের ক্ষেত্রেই যে এমন হবে সেটা দাবি করা হয়নি। শুধুমাত্র যারা গরমের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল তাদের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকগণ।

Image Source: USA Today

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলে আরও কিছু কথা না বললেই নয়। যেমন অতিরিক্ত গরম প্রকৃতির অধঃপাতন যেমন বৃষ্টি, তুষারপাত, বরফ ইত্যাদির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেই। কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে এই পরিবর্তন যার ফলে মানুষের স্বাস্থ্য এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তার আশঙ্কাও রয়েছে। যদি এমনটি হয় তাহলে খাদ্য সমস্যা এবং দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পেতে মানুষের ভিতর হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হতে পারে।

জার্মানির ইতিহাস থেকে আমরা এই বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি। হিটলার খাদ্য সমস্যা নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকতেন। তার ধারণা ছিল বাস্তুসংস্থান তার সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারে। সেজন্য ইউক্রেনের উপর তার লোভ ছিল। কারণ ইউক্রেনের জমি ছিল উর্বর এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য একদম আদর্শ। যদিও প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে জার্মানিতে কখনোই খাদ্যাভাব দেখা দিত না। কিন্তু হিটলার বিশ্বাস করতেন যে, প্রযুক্তির উন্নয়ন কৃষিকাজে সাহায্য করতে পারে না, এটা পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর। আর এই ভয় থেকেই কিন্তু ইউক্রেনে হামলা করে এক হিংসাত্মক মনোভাবের নতুন নজির তৈরি করেছিলো হিটলার। কয়েক হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো নাৎসি বাহিনীরা।

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মানবজাতির টিকে থাকার সাথে জড়িত এই জলবায়ু। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের লাগাম টেনে ধরতে হবে। প্রকৃতি হয়তো মানুষকে টিকে থাকার আরও সুযোগ দিবে যেমনটি আগেও দিয়েছিলো, কিন্তু সেই সুযোগ দেয়ার আগে হয়তো বিরাট এক ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করবে প্রকৃতি। জলবায়ুর পরিবর্তন প্রকৃতির জন্য বিরাট এক ক্ষতি। প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য নিজের মতো কাজ করবে। আর মানুষ প্রকৃতির অংশ হয়ে যদি প্রকৃতির ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে মানুষকেই তার ফল ভোগ করতেই হবে।                                        

ফিচার ইমেজ – USA Today

Related Articles