Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হরেক রকম মেঘের গল্প

পল্লীকবি জসীমউদ্দিন নক্সী কাঁথার মাঠে বর্ণনা করেছেন হরেক রকম মেঘের কথা। কত নামেই না গ্রাম বাংলার মানুষ ডাকে তাকে। কালিয়া মেঘ, প্রভাতী মেঘ, কাজল মেঘ, ধূলট মেঘ, তুলট মেঘ, আড়িয়া মেঘ, হাড়িয়া মেঘ, সিঁদুর মেঘ, কানা মেঘ, কালো মেঘ, কুড়িয়া মেঘ, ফুলতোলা মেঘ- আরও কত কি! বারিবাহন, জলধর, কাদম্বিনী, জীমূত, ঘন, বারিবাহ, নীরদ, সংবর্তক, জলদ, বারিদ, পয়োদ, অভ্র, পর্জন্য, পয়োমূক- আরো কতশত ডাকনাম! কতগুলো গ্রামবাংলার ভাষায় প্রবাহমান সুপ্রাচীনকাল থেকে, আবার কতগুলো শিক্ষিতজনদের দেওয়া। শুধু ডাকেই নয়, পল্লীর মানুষেরা চিনতেন মেঘকে, বুঝতে পারতেন মেঘের ভাষা। প্রবীণেরা তাই মেঘ দেখেই আবহাওয়ার আভাষ পেয়ে যান। আমাদের প্রতিদিনকার আকাশের সঙ্গী হরেক রকম মেঘের বৃত্তান্ত নিয়েই আমাদের আজকের আলাপ।

মেঘেদের নিবাস বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তর ট্রপোস্ফিয়ারে। তাদের মধ্যে যাদের উচ্চতা মোটামুটি ৬,০০০ ফুটের মধ্যে তাদের বলা হয় স্তর মেঘ বা স্ট্র্যাটাস (Stratus)। এই স্ট্র্যাটাস শব্দের আদিরূপ ‘Strata’ যার অর্থ স্তর। এদের বিশেষ কোনো আকৃতি নেই, বরং ধূসর বর্ণের চাদরের মতো ছেয়ে থাকে পুরো আকাশ জুড়ে।

স্ট্র্যাটাস বা স্তর মেঘ

স্ট্র্যাটাস বা স্তর মেঘ। এ মেঘ থেকে মৃদু বৃষ্টিপাত, তুষারপাত হয়; ছবিসূত্র: freebigpictures.com

শরতের আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে থাকতে দেখা যায়। এদের নিচের অংশ সমতল, আর উপরের দিকে ছোট ছোট মেঘ খণ্ড স্তুপ করে রাখা বলে মনে হয়। এ কারণে এদের নাম স্তুপ মেঘ বা কিউমুলাস (Cumulus)। কিউমুলাস অর্থ স্তুপ। অনেক সময় বহু স্তুপ মেঘ খণ্ড একত্রে জমা হয়ে প্রকাণ্ড মেঘের পাহাড় গড়ে। তখন তাদের নাম হয় কিউমুলোনিম্বাস (Cumulonimbus)। কিউমুলাস মেঘে সাধারণত বৃষ্টি না হলেও কিউমুলোনিম্বাসে তীব্র বৃষ্টিপাত, ঝড় এমনকি টর্নেডোও হতে পারে।

কিউমুলাস বা স্তূপ মেঘ

কিউমুলাস বা স্তুপ মেঘ; ছবিসূত্র: epod.usra.edu

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। সব মেঘে কিন্তু বৃষ্টি হয় না। যেসব মেঘে বৃষ্টি হয়, তাদের বলে নিম্বাস। লাতিন শব্দ Nimbus এর অর্থ ‘বৃষ্টি মেঘ’। কিন্তু নিম্বাস বা ‘বৃষ্টি মেঘ’ মেঘের কোনো প্রকার না, এটা মেঘের একটা অবস্থা।

বৃষ্টি ঝরাতে থাকা নিম্বোস্ট্র্যাটাস।

বৃষ্টি ঝরাতে থাকা নিম্বোস্ট্র্যাটাস; ছবিসূত্র: commons.wikimedia.org

যে স্তর মেঘে বা স্ট্র্যাটাসে বৃষ্টি হয় তাকে বলে নিম্বোস্ট্র্যাটাস (Nimbostratus)। কিউমুলোনিম্বাসের ক্ষেত্রেও একই কথা। কিউমুলাস মেঘগুলো বৃষ্টি ঝরাবার জন্যই পরিণত হয় কিউমুলোনিম্বাসে। কিউমুলোনিম্বাসের উচ্চতা ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ মেঘ তীব্র বর্জ্রের সৃষ্টি করে।

কিউমুলোনিম্বাস

কিউমুলোনিম্বাস। ছবিসূত্র: pinterest.com

এক ধরণের বিশেষ মেঘ হলো স্ট্র্যাটোকিউমুলাস (Stratocumulus)। ধূসর রঙা এ ধরণের মেঘগুলো স্তুপাকারে থাকলেও স্তুপগুলো গঠন কিছুটা বিস্তৃত। এরা সারিবদ্ধভাবে থাকে এবং এদের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ দেখা যায়। এ ধরণের মেঘ থেকে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কম হলেও এরা নিম্বোস্ট্রাটাসে রূপান্তরিত হতে পারে।

স্ট্র্যাটোকিউমুলাস

স্ট্র্যাটোকিউমুলাস; ছবিসূত্র: victoriaweather.ca

আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে যে মেঘেদের বাস, তাদের বলে অলক মেঘ বা সিরাস (cirrus)। শুভ্র এ মেঘগুলো পাতলা পালকের মতো সারা আকাশ ছেয়ে থাকে। মনে হয় কোনো শিল্পী আনমনে সাদা আঁচর তুলেছেন নীল ক্যানভাসে। অনেক সময় এ মেঘ নিজেদের মধ্যে সুবিন্যস্ত হয় জ্যামিতিক ঢঙে। এরা এতোটাই উঁচুতে থাকে যে, এদের বৃষ্টি মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়! ভূপৃষ্ঠ হতে ১৮ হাজার ফুটের উর্ধ্বে এদের স্বাভাবিক নিবাস। অনেক সময় এ মেঘ সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত দিয়ে যায়।

অলক মেঘ বা সিরাস

অলক মেঘ বা সিরাস; ছবিসূত্র: en.wikipedia.org

শুধুমাত্র অলক মেঘই হয়তো মহাবৈশ্বিক। পৃথিবী ছাড়াও মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুনি, ইউরেনাস আর নেপচুনে অলক মেঘ দেখা যায়। অন্য কোনো ধরণের মেঘের এমন খবর এখনও পাওয়া যায় নি।

নেপচুনে অলক

নেপচুনে অলক; ছবিসূত্র: dkfindout.com

সিরোস্ট্র্যাটাস (Cirrostratus) এবং সিরোকিউমুলাস (Cirrocumulus) হলো সিরাস মেঘের বিশেষ দুই রূপ। নামটি যেহেতু ‘সিরোকিউমুলাস’, তাই এ মেঘগুলো ছোট ছোট স্তুপ করে সাজানো থাকে দূর আকাশে। সাধারণত শীতের সময় এদের দেখা যায়।

সিরোকিউমুলাস

সিরোকিউমুলাস; ছবিসূত্র: perso.wanadoo.es

আবার সিরোস্ট্র্যাটাস স্ট্র্যাটাস মেঘেদের মতোই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চাদর হয়ে ছেয়ে থাকে, মাঝ থেকে চেয়ে থাকে জ্বলজ্বলে সূর্য। এ মেঘ বৃষ্টি কিংবা তুষার ঝড়ের পূর্বাভাষ।

সিরোস্ট্র্যাটাস।

সিরোস্ট্র্যাটাস; ছবিসূত্র: atmos.ucla.edu/~jrosko

এছাড়া মাঝামাঝি উচ্চতার মেঘেদের এলাকা হলো ৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার ফুট। আলটোস্ট্র্যাটাস (Altostratus) এবং আলটোকিউমুলাস (Altocumulus) এ শ্রেণীর মেঘ। আলটোস্ট্র্যাটাস ধূসর বা নীলচে ধূসর বর্ণের, সুবিস্তৃত জায়গা জুড়ে থাকে। এদেরকে ঝড়, টানা বৃষ্টিপাত বা তুষারপাতের আগে দেখা যায়।

আলটোস্ট্র্যাটাস।

আলটোস্ট্র্যাটাস; ছবিসূত্র: capetownskies.com

আলটোকিউমুলাসের বর্ণ সাদা। কিউমুলাস মেঘের মতোই এরা স্তুপাকারে থাকে, মূল পার্থক্য হলো উচ্চতায়। ‍উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে সকালে এই মেঘ বিকেলের বজ্রসহ ঝড়ের ইঙ্গিত দেয়।

আলটোকিউমুলাস

আলটোকিউমুলাস; ছবিসূত্র: chitambo.com

এ হলো মেঘের প্রাথমিক শ্রেণীবিভাগ। এছাড়াও আরো কিছু বিশেষ মেঘেদের সনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এবার একবারে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক প্রধান দশ ধরণের মেঘের উপর।

হরেক রকম মেঘ

হরেক রকম মেঘ; ছবিসূত্র: waitbutwhy.com

মেঘের যে বিজ্ঞান তার সূচনা হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, ১৮০২ সালে। ইংরেজ রসায়নবিদ লুক হাওয়ার্ড মেঘেদের নামগুলো প্রস্তাব করেন। বিশ শতক হতে আকাশপথে মানুষের যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হলে মেঘেদের নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন হয়।

শুধু গবেষণা বা পূর্বাভাষ নয়, একদল মেঘ-পাগল মানুষ মেঘ দেখাকে রীতিমত শখে পরিণত করেছেন। অদ্ভুত সেই শখটির নাম ‘ক্লাউডস্পটিং’ (Cloudspotting)। একটি সংগঠনও গড়ে ফেলেছেন তারা, ক্লাউড অ্যাপ্রিসিয়েশান সোসাইটি বা মেঘ চর্চা সমিতি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ সংগঠনটি একে একে বারটি বছর পার করেছে, আর তাতে যোগ দিয়েছে সারা পৃথিবীর চল্লিশ হাজারেরও বেশি মেঘপ্রেমী। সংগঠনটির সদস্য হতে পারবেন সারা পৃথিবী থেকে যে কোনো মেঘপ্রেমী। এজন্য তাকে গুণতে হবে মোট ৩৪.১৯ ইউএস ডলার এবং সদস্য হলে পাবেন একটি সার্টিফিকেট, ব্যাজ এবং ক্লাউড সিলেক্টর।

এই মেঘমুগ্ধের দলের একটি পাগলমীর কথা দিয়ে শেষ করি আজকের উপাখ্যান। ২০০৬ সালে আমেরিকার আইওয়া রাজ্যের সিডার র‌্যাপিডস শহরে প্রথমবারের মতো মেঘপাগলদের নজরে আসে বিশেষ এক মেঘ। আকৃতি খুবই অদ্ভুৎ এবং মেঘ সম্পর্কে আমরা ততদিনে যতটুকু জেনেছিলাম, তাতে কোনোভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছিলো না তাকে। বিশাল জলাধারে ঢেউ উঠলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন দেখতে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিশাল উত্তাল সমুদ্র উল্টো হয়ে আকাশে ঝুলে রয়েছে যেন। অনেকটা রাগি রাগি ভঙ্গিমার এই মেঘকে তারা নামও দিয়েছিলেন যুৎসই, ‘আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস’ বা ‘রাগী মেঘ’।

আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস বা রাগী মেঘ।

আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস বা রাগী মেঘ; ছবিসূত্র: fox41blogs.typepad.com

ক্লাউড অ্যাপ্রিসিয়েশান সোসাইটি বা ‘ক্যাস’ ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিকাল অর্গানাইজেশন-এর কাছে তাই অ্যাসপেরাটাসকে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিলো, যাতে করে আন্তর্জাতিক ক্লাউড অ্যাটলাস বা মেঘ মানচিত্রে জায়গা হয় তার। কিন্তু রিডিং বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে ভিন্ন কথা। তারা এক গবেষণা পত্রে বলেছে, এ মেঘ খানিকটা ‘ম্যামাটাস’ মেঘের মতো।

ম্যামাটাস

ম্যামাটাস; ছবিসূত্র: wordlesstech.com

কিন্তু ক্যাসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট গেভিন পিটার-পেনি অস্বীকার করে বলেন, এ মেঘ ম্যামাটাসের চেয়ে বেশি গরম। মেঘের উপরের দিকে ভিজে হাওয়ার স্রোত এবং নিচের দিকে হাওয়া অনেকটা শুকনো, বেশ ঠান্ডা। মেঘের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে হাওয়া চলাচলের সময় তৈরি হয় একের পর এক ঢেউ।

আগুনরাঙা ‘রাগী মেঘ’; ছবিসূত্র: apod.nasa.gov/apod/ap130227.html

এমন তর্ক-বিতর্কে মেঘ মানচিত্রে জায়গা হচ্ছিলো না রাগী মেঘের। সেজন্য সেই ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১৭ প্রায় এক যুগ ধরে আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস এর স্বীকৃতির লক্ষ্যে সারা দুনিয়ায় ক্যাসের সদস্যরা ছবি সংগ্রহ করতে থাকেন। অবশেষে এ বছর ২৪ শে মার্চ, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের স্বীকৃতি পায় অ্যাসপেরাটাস। এর ফলে প্রায় ৬৭ বছর পর নতুন কোনো মেঘের স্থান হলো মেঘ মানচিত্রে। সর্বশেষ ১৯৫১ সালে মেঘ মানচিত্রে নাম উঠেছিল ‘সিরাস ইনটরটাস’-এর।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/List_of_cloud_types

২) e-scientiae.com/মেঘেদের-যতো-কথা/

৩) dw.com/bn/মেঘ-দেখা-ও-তার-ছবি-তোলার-শখ/a-17808311

৪) archives.anandabazar.com/archive/1120925/25jibjagat1.html

৫) ittefaq.com.bd/world-news/2017/03/24/108758.html

৬) archives.anandabazar.com/archive/1120925/25jibjagat1.html

৭) weather.ou.edu/~smglenn/clouds.html

Related Articles