Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পূর্ণচন্দ্র বৃত্তান্ত: বিভিন্ন ধরনের পূর্ণিমা চাঁদ-কথন

চাঁদ সবসময়ই পৃথিবীর মানুষের কাছে একদিকে যেমন প্রেমের বস্তু, তেমনি বিস্ময়করও বটে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে অনবরত। যদিও পৃথিবী থেকে চাঁদের কেবল এক পৃষ্ঠই দেখা যায়, অপর পৃষ্ঠ দেখা যায় না। কারণ অপর পৃষ্ঠটি চাঁদের ঘূর্ণনজনিত কারণে কখনো পৃথিবীমুখো হয় না। এই পৃষ্ঠকে বলা হয় চাঁদের ‘ডার্ক সাইড’। বাস্তবে অন্ধকার নয়, বরং পৃথিবী থেকে দেখা যায় না তাই এমন নামকরণ।

তো বিস্ময়কর চাঁদের ডার্ক সাইড নিয়ে কথা বৃদ্ধি না করে মূল কথায় আসা যাক। ছোটবেলায় যখন ‘একটি পূর্ণিমা রাত’ নিয়ে আমরা রচনা লিখতাম, আমাদের সে রচনায় উঠে আসতো পূর্ণিমা কিংবা জ্যোৎস্না নিয়ে যত জল্পনা-কল্পনা। পৃথিবীর মানুষের কাছে একটা অন্যরকম আবেগের দাবী রাখে পূর্নিমা চাঁদ। তো এই পূর্ণিমা চাঁদ বা ‘ফুল মুন’ নিয়েই এই লেখা।

প্রথমত জানা যাক যে কিভাবে পূর্নিমা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কিভাবে পৃথিবী থেকে চাঁদের এই পূর্ণতাপ্রাপ্ত অবস্থা দেখা যায়।

চাঁদের এই পরিপূর্ণতা ৮টি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রতিবার অমাবস্যা থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়া চলে প্রায় এক মাস অবধি, অর্থাৎ অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত। সাধারণত যখন চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে তখন এর এক অর্ধাংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এবং উজ্জ্বল দেখায়। অন্যদিকে বাকি অর্ধাংশ থাকে সূর্যরশ্মির বিপরীত দিকে। কাজেই বিপরীত অংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে।

তো আমরা এই অমাবস্যা, পূর্ণিমা কিংবা এর মধ্যবর্তী সময়ের চাঁদের যে বিভিন্ন আকার দেখে থাকি তা মূলত সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের আপেক্ষিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। যেমন অমাবস্যার রাতে চাঁদ থাকে সূর্য-পৃথিবীর মাঝ বরাবর। ফলে তখন সূর্যের আলো চাঁদের যে অংশ আলোকিত করে, আমরা সে অংশ দেখতে পাই না। বরং আমরা দেখতে পাই এর অপর অংশ, অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশ। তাই অমাবস্যার রাত থাকে অন্ধকার।

এভাবে বিভিন্ন সময়ে চাঁদের বিভিন্ন অবস্থান ও এর উপর সূর্যের আলোর প্রভাবের কারণে চাঁদের আকার বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। অমাবস্যা থেকে শুরু হয় চাঁদের এই আকার বৃদ্ধি এবং পূর্ণিমাতে গিয়ে চাঁদ পায় পূর্ণতা। যদিও বাস্তবে চাঁদ ছোট-বড় হয় না, বরং সূর্যের আলোর প্রভাবেই এমনটা ঘটে থাকে। যখন চাঁদ ও সূর্যের মাঝ বরাবর পৃথিবী থাকে তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের কেবল আলোকিত অংশ পুরোটাই দেখা যায়। এই অবস্থাকেই আমরা পূর্ণিমা বলে থাকি। এ সম্পর্কে বেশ কিছু উপকথাও প্রচলিত আছে। সেসব সম্পর্কে অন্য কোনো লেখায় জানা যাবে।

লুনার ক্যালেন্ডার বা চন্দ্রমাসিক দিনপঞ্জি অনুযায়ী বিভিন্ন অবস্থানে চাঁদের বিভিন্ন আলোকীয় আকৃতি; Source: zlifeeducation.com

তো চাঁদের এই আলোকীয় পরিবর্তন ঘটে থাকে একটি পর্যায়বৃত্তিকভাবে। সাধারণত প্রায় প্রতি ২৯ দিন পরপর পূর্ণিমা চাঁদ দেখা যায়। খুব সঠিক করে বলতে গেলে ২৯.৫ দিন পরপর। অর্থাৎ, স্বাভাবিক ক্যালেন্ডারের হিসেবে প্রতিমাসে একটি পূর্ণিমা পাওয়া যায়। একে বলা হয় চন্দ্রমাসিক দিনপঞ্জি বা ‘লুনার ক্যালেন্ডার’। সাধারণ মাস থেকে এই ক্যালেন্ডার দুই-এক দিন কম হওয়ায় মাঝে মাঝে একই মাসে দুটি পূর্ণিমা চাঁদ দেখার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেটি ঘটতে পারে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর পরপর। মাসের দ্বিতীয় এই পূর্ণিমা চাঁদকেই বলা হয় ব্লু মুন (Blue Moon)। অমাবস্যার চাঁদকে বলা হয় নতুন চাঁদ (New Moon) এবং পূর্ণিমার চাঁদকে বলা হয় পূর্ণ চাঁদ (Full Moon)।

প্রতিমাসে চাঁদ তার অবয়ব এভাবে পরিবর্তন করতে থাকে। অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সে বড় হতে থাকে এবং এরপর আবার ছোট হতে হতে অমাবস্যায় ফিরে যায়। তো চাঁদের এই পরিবর্তন একদিকে যেমন বছরের বিভিন্ন ঋতুর হিসাব রাখতে সাহায্য করে, তেমনি সেটি বিভিন্ন সময়ের বৈশিষ্ট্যকেও ধারণ করে।

যেমন বছরের কোন সময়টা শিকারে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত কিংবা কোন সময়ে ফসল রোপন করতে হবে এবং কোন সময়ে তা আহরণ করতে হবে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আমেরিকার স্থানীয় অধিবাসীগণ, বিশেষ করে আদিবাসীগণ বছরের প্রতিটি মাসের পূর্ণিমার চাঁদকে একেকটি বিশেষ এবং আলাদা নামকরণ করেছে। এসব নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় মূলত ‘এল্গনকিন’ উপজাতি সম্প্রদায় থেকে যারা বাস করতো নিউ ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে লেক সুপিরিওর পর্যন্ত। এই নামসমূহ সংরক্ষণ করা হয়েছে ‘দ্য ওল্ড ফারমার’স আলম্যানাক’ বা কৃষকদের প্রাচীন পঞ্জিকাতে।

চলুন সেসব পূর্ণিমা চাঁদের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়া যাক।

জানুয়ারি: ঊলফ মুন

এই পূর্ণিমা চাঁদের আবির্ভাব হয় যখন গ্রামের বাইরের জঙ্গলের ভেতর নেকড়ে বা শিয়ালের দল খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় এবং তাদের স্বভাবসিদ্ধ ডাকে ডাকতে থাকে। এটাকে ‘ওল্ড মুন’ বা প্রবীণ চাঁদ নামেও ডাকা হয়। কতিপয় উপজাতি সম্প্রদায়ের কাছে এটি স্নো মুন নামেও পরিচিত। যদিও বাকি অন্যান্য সম্প্রদায় পরের পূর্ণিমাকে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের পূর্ণিমা চাঁদকে এই নাম দিয়ে থাকে।

ঊলফ মুন; Source: countryliving.com

ফেব্রুয়ারি: স্নো মুন

ফেব্রুয়ারি মাসের সাধারণত আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে তুষারপাত হয়ে থাকে। এই সময়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খাবারের সন্ধান করা এবং শিকারে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাজেই এসব স্থানীয় অধিবাসীর কাছে এটি হাঙ্গার মুন নামেও পরিচিত। আবার তীব্র তুষারপাতের কারণে এটি স্টর্ম মুন নামও অর্জন করেছে।

স্নো মুন; Source: countryliving.com

মার্চ: ওয়ার্ম মুন

মার্চ মাসে শীতের তীব্রতা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে এবং প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটতে থাকে। বসন্তের এই আগমনী পূর্ণিমার চাঁদকে বলা হয় ওয়ার্ম মুন। কারণ এই সময় শীতের রুক্ষতা কমে যেতে থাকে। শুষ্ক মাটি আবার নরম ও সতেজ হতে শুরু করে। বসন্ত বিরাজ করতে থাকে চারদিকে। রবিন নামক বিশেষ পাখির আগমন ঘটে। সেই সাথে ম্যাপল নামক বিশেষ বৃক্ষের মধ্যে রসের প্রবাহ আবার শুরু হয়। এই কারণে মার্চের এই পূর্ণিমা চাঁদকে স্যাপ মুনও বলা হয়। এই চাঁদের আরো নামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেথ মুন, চেস্ট মুন, ক্রাস্ট মুন (কারণ এ সময় ভূপতিত তুষার দিনের বেলা গলে যায়, কিন্তু রাতে আবার জমে যায়)।

ওয়ার্ম মুন; Source: countryliving.com

এপ্রিল: পিংক মুন

সাধারণত এপ্রিল মাসে মসের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। আবার ধারণা করা হয় যে গ্রাউন্ড ফলোক্স নামক বন্য ফুল ফোটে এই সময়ে। এই ফুলকে ধরা হয় বসন্তের প্রথম ফুল যা কিনা গোলাপী বর্ণের। কাজেই এই ফুলের বর্ণ অনুসারে এর নাম করা হয়েছে পিংক মুন। অন্যান্য নামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এগ মুন এবং ফিস মুন

পিংক মুন; Source: countryliving.com

মে: ফ্লাওয়ার মুন

এপ্রিলে এক-দুই করে বসন্তের ফুল ফোটা শুরু হয়। মে মাসে এসে সেটা পায় পূর্ণতা। মে মাসে চারদিকে ফুটতে থাকে নানা বর্ণের নানা সুগন্ধের ফুল। স্থানীয় এল্গনকিন আদিবাসীদের কাছে এটি কর্ণ প্লান্টিং মুন  কিংবা মিল্ক মুন নামেও পরিচিত। কারণ এরপর থেকেই শুরু হয় শস্য চাষের।

ফ্লাওয়ার মুন; Source: countryliving.com

জুন: স্ট্রবেরি মুন

উত্তর আমেরিকাতে জুন মাসে সাধারণত ক্ষেত থেকে স্ট্রবেরি আহরণ ও সংরক্ষণ শুরু হয়। সেই হিসেবে এই মাসের পূর্ণ চাঁদের নাম করা হয় স্ট্রবেরি মুন। যদিও ইউরোপীয় অধিবাসীগণ একে পরিবর্তন করে নাম রেখেছে রোজ মুন। আবার গ্রীষ্মকালের আগমনের কারণে একে হট মুনও বলা হয়ে থাকে।

স্ট্রবেরি মুন; Source: countryliving.com

জুলাই: বাক মুন

ইংরেজী Buck অর্থাৎ বিশেষ প্রজাতির হরিণের থেকে এই নামের উদ্ভব। এই প্রজাতির পুরুষ হরিণ নিজেদের শিং স্খলন করতে পারে অর্থাৎ, এদের শিং ঝরে যায়। জুলাই মাসে এদের এই শিং আবার পুনরায় গজাতে শুরু করে। এই ঘটনার কারণে স্থানীয় আমেরিকানরা এই মাসের চাঁদের নাম করেছে বাক মুন। এই মাসে গ্রীষ্মকালীন বজ্রবৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে এর নাম থান্ডার মুন এবং খড় আহরণের কারণে একে হে মুনও বলা হয়ে থাকে।

বাক মুন; Source: countryliving.com

আগস্ট: স্টারজিওন মুন

স্টারজিওন মূলত বিশেষ প্রজাতির মাছ। সাধারণত আগস্ট মাসে বিভিন্ন জলাশয়ে বিশেষ করে গ্রেট লেক ও লেক চ্যামপ্লেইন-এ এই মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবী উপজাতিদের কাছে এই পূর্ণিমা চাঁদ স্টারজিওন মুন নামে পরিচিত। একে গ্রিন কর্ন মুনও বলা হয়ে থাকে। আবার এই সময়ে চাঁদের বর্ণ কিছুটা লালাভ হওয়ায় একে রেড মুনও বলা হয়।

স্টারজিওন মুন; Source: countryliving.com

সেপ্টেম্বর: হারভেস্ট মুন

পূর্ণ চাঁদের একটি পরিচিত নামের মধ্যে হার্ভেস্ট মুন উল্লেখযোগ্য। মূলত সেপ্টেম্বরের এই সময় রোপিত ফসল আহরণের সময়। ফসল আহরণের জন্যই এই চাঁদের এমন নাম করা হয়েছে। এই সময় ফসল আহরণ করে সংরক্ষণ করা হয়। একে কর্ন মুনও বলা হয়। এই চাঁদ সাধারণত একটু শীঘ্রই আকাশে উদয় হয় এবং শারদ বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি থাকার কারণে কিছুটা বেশি উজ্জ্বল হয়। চাঁদ দীর্ঘ সময় ধরে আকাশে অবস্থান করার কারণে কৃষকগণ রাতের বেলাতেও ফসল আহরণ করতে পারে। এ সময়ে বার্লি আহরণ করা হয়, যে কারণে একে বার্লি মুনও বলা হয়ে থাকে।

হার্ভেস্ট মুন; Source: countryliving.com

অক্টোবর: হান্টার’স মুন

হারভেস্ট মুন-এর পর আসে হান্টার’স মুন। নামের সাথে কাজের মিল থাকাই স্বাভাবিক। এই সময়ে গাছের পাতা ঝরে যেতে থাকে এবং গ্রীষ্মের সময়ে মোটাতাজা হয়ে যাওয়া হরিণ শিকার করার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। হান্টার’স মুন-ও হার্ভেস্ট মুন-এর মত উজ্জ্বল হয়ে থাকে এবং দীর্ঘসময় আকাশে অবস্থান করে। যার ফলে শিকারির পক্ষে অধিক সময় শিকার করার সহজ হয়ে যায়। অন্যান্য নামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ট্র্যাভেল মুন কিংবা ডাইং গ্রাস মুন

হান্টার’স মুন; Source: universetoday.com

নভেম্বর: বিভার মুন

নভেম্বরের পূর্ণিমা চাঁদের এমন নামকরণের ক্ষেত্রে মতান্তর লক্ষ্য করা যায়। বিভার (Beaver) (বা বাংলায় বীবর) মূলত ধারালো দাঁতওয়ালা একধরনের লোমশ উভচর প্রাণী। বলা হয়ে থাকে, এল্গনকিন উপজাতি এই সময়ে বিভার ফাঁদ তৈরী করে। অন্যদিকে ধারণা করা হয় যে, এই সময়ে বিভার প্রজাতি শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে একধরনের বাঁধ তৈরী করে। এই চাঁদকে ফ্রস্ট মুনও বলা হয়ে থাকে।

বিভার মুন; Source: countryliving.com

ডিসেম্বর: কোল্ড মুন

কোল্ড মুন এবং ডিসেম্বর মাস- বোঝাই যাচ্ছে যে আবার শীত এসে গেছে এবং রাত দীর্ঘ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে শুরু করে দিয়েছে। একে লং নাইট মুন বা ওক মুন-ও বলা হয়ে থাকে।

কোল্ড মুন; Source: countryliving.com

তো এই ছিলো মূলত বিভিন্ন মাসে আবির্ভূত হওয়া পূর্ণিমা চাঁদের নাম এবং সেসব নামের নেপথ্যের কাহিনী। এখন আমরা একটু অন্যদিকে যাবো।

উপরের নামগুলোর সাথে আমরা সচরাচর পরিচিত না হলেও যেসব নামের সাথে আমাদের পরিচয় আছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্লু মুন, সুপার ব্লু ব্লাড মুন ইত্যাদি। এখন চলুন এদের সম্পর্কে জানা যাক।

সুপার মুন

সুপার মুনও এক প্রকার ফুল মুন বা পূর্ণিমা চাঁদ। যখন পূর্ণিমাতে চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব সবথেকে কাছাকাছি থাকে তখন সেই পূর্ণিমাকে বলা হয় সুপার মুন। এই সময় চাঁদের উজ্জ্বলতা অন্য সব পূর্ণিমার চাঁদের উজ্জ্বলতা থেকে অনেক বেশি হয়ে থাকে। সুপার মুন যখন মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমাতে আবির্ভূত হয় তখন তাকে সুপার ব্লু মুন বলে। আবার যখন সুপার মুন-এর পূর্ণ গ্রহণ হয়ে থাকে তখন একে বলা হয় সুপার ব্লাড মুন।

সুপার মুন; Source: countryliving.com

ব্লু মুন

ব্লু মুন সাধারণত একটি সাধারণ ঘটনা নয়। অর্থাৎ, এটি প্রতিমাসে বা প্রতি বছরে দেখা যায় না। মূলত দুই-তিন বছর পরপর ব্লু মুন দেখা সম্ভব হয়। তারপরও সম্ভাবনা সামান্য। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে ব্লু মুন আসলে কী এবং কেন?

ব্লু মুন; Source: countryliving.com

আমরা আগেই জেনেছি যে, লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি ২৯.৫ দিনে এক চান্দ্র মাস হয় এবং সে হিসেবে আমাদের সাধারণ ক্যালেন্ডারের সাথে এর এক-দুই দিনের পার্থক্য থাকে। তো এই পার্থক্য একসময় এমন একটা অবস্থানে আসে যখন একই মাসে দুটি পূর্ণিমা হয়ে থাকে। মাসের এই দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদকেই বলা হয় ব্লু মুন। কথা এখানেই শেষ নয়। কারণ এই হিসাব নিয়েও মতান্তর আছে।

প্রাচীন মত অনুযায়ী, সাধারণত একটি ঋতুতে তিনটি পূর্ণিমা চাঁদ থাকে। কিন্তু লুনার ক্যালেন্ডারের এই অতিরিক্ত পূর্ণিমার সম্ভাব্যতার কারণে কোনো কোনো ঋতুতে চারটি পূর্ণিমা দেখা যায়। এখন চারটি পূর্ণিমা বিশিষ্ট এই ঋতুর তৃতীয় পূর্ণিমার চাঁদটিকে বলা হয় ব্লু মুন

এখন কোন হিসাবটি সঠিক এই নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। তবে বেশিরভাগ গবেষকের মতে প্রাচীন মতবাদটিই সঠিক এবং পরবর্তী মতবাদকে প্রাচীন মতবাদের ভুল রুপান্তর হিসেবে মনে করা হয়। যদিও দুই মতবাদই এখন চলছে।

ব্লু মুন নামকরণের দিকে যদি যাওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে ‘Once in a blue moon’ শব্দগুচ্ছের সন্ধান পাওয়া যায় প্রায় ৪০০ বছর আগে। আসলে এমন নামকরণের অর্থ ছিলো ‘ঋণাত্মক’ বা না-বোধক। প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ধারণা ছিলো যে, চাঁদ তৈরী হয়েছে সবুজ রঙের পনির দিয়ে। এখন চাঁদকে নীল বলার অর্থ হচ্ছে না-বোধক। একে যদি আমরা বাক্যে প্রকাশ করতে চাই তো এমন বলতে হবে যে, “আমি তোমাকে বিয়ে করবো যেদিন আকাশে নীল চাঁদ উঠবে”। এখন তাদের ধারণা মতে সবুজ চাঁদতো আর নীল হবে না। তার অর্থ ‘তোমাকে’ আমার বিয়ে করাও হবে না।

ব্লু মুন আসলে নীল নয়; Source: theverge.com

কাজেই ব্লু মুন যে আসলে নীল না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এবং খুব সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে যে চাঁদকে ব্লু মুন বলা হচ্ছে সেটির বর্ণ মূলত হালকা ধূসর থেকে সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। একই মাসে যদি আরেকটি চাঁদ উঠেও থাকে তাতে চাঁদের নিজের বর্ণের পরিবর্তনের সাথে কোনো যোগসূত্র থাকার কথা নেই।

কিন্তু এখানেই কথা শেষ নয়। চাঁদকে নীল দেখা গিয়েছিলো ১৮৮৩ সালের দিকে। যদিও সেটা দেখা সম্ভব হয়েছিলো এক পার্থিব ঘটনার কারণে। ক্র্যাকাটোয়া নামক আগ্নেয়গিরি যখন বিস্ফোরিত হলো তখন র‍্যালে স্ক্যাটারিং তত্ত্ব অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণা ফিল্টারের মতো কাজ করতে শুরু করলো। এর ফলে অস্তায়মান সূর্য এবং চাঁদকে দেখা যেতে লাগলো সবুজ ও নীল বর্ণের। একইভাবে অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনা, যেমন দাবানল কিংবা ধূলিঝড়ের কারণেও চাঁদকে নীল দেখা যেতে পারে।

ব্লাড মুন

ব্লাড মুন; Source: countryliving.com

ব্লাড মুন শব্দটির সাথে আমরা পরিচিত হলেও আসলে ব্লাড মুন বা রেড মুন নামে কোনো বৈজ্ঞানিক টার্ম নেই। এরূপ নামকরণ করা হয়েছে মূলত পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের কারণে। সাধারণত প্রতি ছয়টি চন্দ্রমাসের পর, অর্থাৎ ছয়টি পূর্ণিমার পর একটি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ ঘটে থাকে। এরূপ চারটি চন্দ্রগ্রহণকে একসাথে বলা হয় লুনার টেট্রাড। যখন পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয় তখন চাঁদ কিছুটা লালাভ বর্ণের দেখায়। সেখান থেকেই মূলত ব্লাড মুন নামের উৎপত্তি। এটি সাধারণত পূর্ণগ্রহণজনিত চন্দ্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

তো কিভাবে চাঁদ লাল হয় সে ব্যাপারে একটু জানা যাক।

যেভাবে চন্দ্রগ্রহণের সময় ব্লাড মুন দেখা সম্ভব হয়; Source: timeanddate.com

পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ মূলত সংঘটিত হয় মূলত যখন চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে এমন এক অবস্থানে আসে, যেখানে সূর্য ও চাঁদের ঠিক মাঝ বরাবর পৃথিবী থাকে এবং এরা এক সরলরেখায় অবস্থান করে। পৃথিবীর ছায়ার কারণে চাঁদ সূর্যের আলোয় নিজেকে আর আলোকিত করতে পারে না। কিন্তু চাঁদ একেবারেই সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত হয় না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে পরোক্ষভাবে কিছু আলো চাঁদে পৌছে যায়, এখানেও র‍্যালে স্ক্যাটারিং তত্ত্ব কাজে লাগে। বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে প্রতিসরণের কারণে এই আলোর বিভিন্নরকম আভার সৃষ্টি হয় যেমন লাল, হলুদ কিংবা কমলা। ফলে গ্রহণজনিত চাঁদের বর্ণ লালাভ দেখায়।

সুপার ব্লাড মুন এক্লিপস। চন্দ্রগ্রহণের এই ছবিটি তোলা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর ২৭-২৮ তারিখে; Source: earthsky.org

সুপার ব্লু ব্লাড মুন

সুপার ব্লু ব্লাড মুন আসলে একটি বিরল ঘটনা। এর নামে মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই কারণ। প্রথমত সুপার মুন বলতে বোঝায় পূর্ণিমা চাঁদ, যেখানে চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব হবে সর্বনিম্ন। দ্বিতীয়ত ব্লু মুন হতে গেলে একে মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদ হতে হবে, তৃতীয়ত ব্লাড মুন হওয়ার জন্য এর পূর্ণ গ্রহণ হতে হবে।

অর্থাৎ, যখন মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করে এবং একইসাথে সেদিন চাঁদের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয় তখন একে বলা হয় সুপার ব্লু ব্লাড মুন। আমরা জানি যে, চাঁদের বর্ণ আসলে নীল হয় না। কাজেই এই চাঁদকে মূলত লালই দেখায়। ব্লু মুন কেবল মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদের নামেই সীমাবদ্ধ।

প্রথম ছবিটি সুপার মুন, দ্বিতীয়টী সুপার ব্লু ব্লাড মুন; Source: bbc.co.uk

সুপার ব্লু ব্লাড মুন সাধারণত বিরল ধরনের। সর্বশেষ এই ধরনের চাঁদ দেখা গিয়েছিলো ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে। প্রায় দেড়শো বছর পর এই ধরনের চাঁদ আবার আবির্ভূত হয়েছিলো। আমেরিকার প্রায় ৫০টি দেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার কতিপয় দেশ থেকে এই সুপার ব্লু ব্লাড মুন দেখা গিয়েছিলো।

ব্ল্যাক মুন

ব্লু মুন নাম শুনে যেমন মনে প্রশ্ন জেগেছিলো যে, আসলে কি চাঁদ নীল হয়? ব্ল্যাক মুন নাম শোনার পর সেই প্রশ্ন আরেকটু বেশিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কারণ চাঁদ যদিওবা নীল হয়, তবুও কালো হবে কিভাবে?

আসলে ব্ল্যাক মুন বলতেও কিছু নেই। ব্ল্যাক মুন টার্মটি ব্যবহার করা হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। আমরা জানি যে, আমাদের সাধারণ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি অমাবস্যা এবং একটি পূর্ণিমা হয়ে থাকে। কিন্ত এই নিয়ম সব সময় সত্য নয়। যেমন চন্দ্রমাসিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতিটি পূর্ণিমা ঘটে ২৯.৫ দিনের ব্যবধানে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের দিন সংখ্যা ২৮ এবং অধিবর্ষের ক্ষেত্রে ২৯। কাজেই ফেব্রুয়ারি মাসের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা থেকেই যায়। কারণ দিনের সংখ্যা কম হওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসে কখনো কখনো পূর্ণিমা না-ও হতে পারে। এই যে কোনো মাসে পূর্ণিমা হলো না, একেই বলা হয় মূলত ব্ল্যাক মুন। অর্থাৎ, ‘ব্ল্যাক‘ বা কালো এখানে চাঁদের বর্ণ হিসেবে প্রকাশ পায়নি, বরং প্রকাশ পেয়েছে না-বোধক অর্থে। এক হিসেবে মতে প্রতি ১৯ থেকে ২০ বছর পরপর ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো পূর্ণিমা থাকে না। সেটা জানুয়ারী মাসে ব্লু মুন হিসেবে দেখা যায় কিংবা মার্চ মাসের প্রথম পূর্ণিমা হিসেবে দেখা যায়।

মাইক্রো মুন

সুপার মুন সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে এই সময়ে চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্ব থাকে সর্বনিম্ন। ফলে তা বড় ও উজ্জ্বল দেখায়। তেমনি যখন পূর্ণিমার চাঁদ পৃথিবী থেকে সর্বাধিক দূরত্বে অবস্থান করে তখন তাকে বলা হয় মাইক্রো মুন এসময়ে চাঁদকে সুপার মুন-এর থেকে প্রায় ১৪ শতাংশ ক্ষুদ্র দেখায় এবং এর উজ্জ্বলতা কমে যায় প্রায় ৩০ শতাংশের মতো।

মাইক্রো মুন; Source: timeanddate.com

তো এই ছিলো ফুল মুন বা পূর্ণিমা চাঁদের বৃত্তান্ত। পূর্ণিমা চাঁদ নিয়ে যেমন কবি সাহিত্যিকেরা কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, এর বৈজ্ঞানিক সাহিত্য-কবিতাও কিন্তু কম শ্রুতিমধুর নয়। বছরের একেক মাসে পূর্ণিমা চাঁদের একেক নাম। কিংবা সুপার মুন, ব্লু মুন, ব্লাড মুন– এগুলো সবই আমাদের মনে জাগায় বিস্ময়।

ফিচার ইমেজ: wallpapersite.com

Related Articles