Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রূপকথার আশ্চর্য সেই ফুটন্ত পানির নদী যখন আছে বাস্তবেই

ছোটবেলায় দাদা-দাদীর মুখে রূপকথার গল্প শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রূপকথার গল্প আমাদের ছোটবেলার চিন্তা-ভাবনার অনেকাংশ জুড়ে থাকে। অনেকে তো আবার স্বপ্নের রাজ্যের রাক্ষসের হাত থেকে জিয়নকাঠি দিয়ে রূপবতী ঘুমন্ত রাজকন্যাকে জাগিয়ে নিজের করে নিতে চায়। কিন্ত কখনও কি বড় হয়ে পরিণত বয়সে গিয়ে রূপকথার স্বপ্নের মতো শোনা গল্পের ঘটনাকে বাস্তবে রূপান্তরের চেষ্টা করেছেন? বড় হয়েও কি জানতে ইচ্ছা করেছিল, মেঘমল্লার গল্পের পাইন গাছগুলো এত তাড়াতাড়ি এত লম্বা কীভাবে হয়? বা রিপভ্যান উইংক্যাল এক ঘুমে কীভাবে এত লম্বা ২০টি বছর সময় কাটিয়েছিল? বড় হয়ে এই ছোটবেলায় শোনা আজব গল্পগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন কি? বলবেন হয়তো, “আরে এসব রূপকথার গল্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছু?”

স্বপ্নবাজ তরুণ আন্দ্রেজ রুজো; Image Source: Explorer Classroom

আপনি-আমি সেই চেষ্টাকে পাগলামো বলে উড়িয়ে দিলেও উড়িয়ে দিতে পারেননি লিমায় বেড়ে ওঠা আন্দ্রেজ রুজো নামের এক স্বপ্নবাজ তরুণ, যিনি ছোটবেলায় দাদার মুখে শোনা রূপকথার ফুটন্ত পানির নদীর খোঁজ করাকে রীতিমতো নিজের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করেন। পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসেন এমন এক আশ্চর্য নদী, যার পানির তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝে কোনো প্রাণীকে জীবন্ত সেদ্ধ করে ফেলতে সক্ষম, যেখানে একটু পা ফসকে পড়ে যাওয়ার ভুল হতে পারে ভয়ানক কষ্টদায়ক মৃত্যুর কারণ।

রূপকথা, রূপকথার মতো এক আবিষ্কারের জননী

আমাজন নানা আশ্চর্য রহস্যে ঘেরা এক জঙ্গল। এর অনেক অংশই এখনও পর্যন্ত মানুষের অজানা রয়ে গেছে। আমাজনের পেরু অংশের একদম মধ্যভাগে সবচাইতে ঘন জঙ্গলে আশ্চর্য এই ফুটন্ত পানির নদীটির অবস্থান। আমাজনের মোট আয়তনের শতকরা ১৩ ভাগ পেরুতে অবস্থিত, যেটি আমাজনের সবচেয়ে ঘন, রহস্যময় এবং ভয়ংকর অংশ। আমাজন জঙ্গল এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য জায়গা। আর স্বভাবতই এ জায়গা নিয়ে অনেক রূপকথা বা এমন অনেক অবিশ্বাস্য গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। আর এ জঙ্গলের এমন দুর্ভেদ্যতার কারণে সেই মুখরোচক গল্পগুলো কি শুধুই গল্প, নাকি বাস্তব- তা বের করা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। মানুষের এই জানার স্বল্পতার কারণে, এ জঙ্গল নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্প অনেক সময় বাস্তবে ধরা দেয়।

এমনটাই ঘটেছিল আন্দ্রেজ রুজোর আবিষ্কার করা ফুটন্ত পানির নদীর বেলায়। আন্দ্রেস রুজোর শোনা রূপকথার গল্পটি ছিল এক হারিয়ে যাওয়া শহরের। মেক্সিকো এবং পেরুতে তৎকালীন স্প্যানিশ শাসকের সৈন্যরা শেষ ইনকা শাসককে হত্যা করে আমাজন জঙ্গলে সোনা খুঁজতে বের হয়। কিন্তু আমাজনের অপরিচিত পরিবেশে টিকে থাকা এতটাও সোজা না। কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার পর তারা জঙ্গলের মানুষখেকো সাপ, বিষাক্ত ও ফুটন্ত পানির নদীর কথা মানুষদের জানায়। এই আশ্চর্য গল্প পেরুতে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু গল্পের আশ্চর্য নদী বাস্তবে থাকতে পারে, তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। তা মূলত আমাজনকে নানা কল্পকাহিনী এবং এর দুর্গম পরিবেশের কারণেই। আর এমনই অনেক প্রচলিত রূপকথার গল্পের মতো এক গল্প বাস্তবে রূপ নেবে, কে ভেবেছিল?

রূপকথার বাস্তবে রূপায়ণ

ছোটবেলায় শোনা এ গল্প আন্দ্রেস রুজোর চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়েও এ নদীর কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ভূপদার্থ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের সাউদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা আন্দ্রেস রুজো তার পড়াশোনা চলাকালেই এ নদীর অস্তিত্বের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করেন। প্রায় দু’বছর তিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ অনেকের মতামত জানার চেষ্টা করেন।

কিন্তু সবাই তাকে হতাশ করেন, কারণ কোনো নদীর পানি এমন মাত্রায় গরম হতে হলে আশেপাশে আগ্নেয়গিরির উপস্থিতি জরুরি, কিন্তু পেরুর যে অংশে রুজো এমন নদীর উপস্থিতি দাবি করছিলেন, তার আশেপাশে প্রায় ৪০০-৪৫০ মাইল পর্যন্ত কোনো আগ্নেয়গিরি ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবে সবাই এই রূপকথার নদীকে শুধু মাত্র একটি কল্পকাহিনী বলেই উড়িয়ে দেন। এবং ঐ সময় এই রুপকথার নদী খোঁজার ব্যাপারটা অনেকটাই হাস্যকর হয় দাঁড়ায় সবার সামনে। তিনিও এ বিষয়ে আশা ছেড়ে দেন।

কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর; Image Source: Explorer Classroom

তিনি চূড়ান্তভাবে এ নদী নিয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেন পিএইচডি করার সময়। তার গবেষণা দলের কাজের অংশ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি জিওথার্মাল ম্যাপ তৈরি করেন গুগলের সাহায্যে, যেখানে আগের চেয়ে আরো ভালোভাবে ভূ-অভ্যন্তরস্থ তেল, গ্যাস, পানির প্রবাহ সম্পর্কে জানা যায়। যেহেতু পেরুতে খনিজ সম্পদ খোঁজা তার অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল, তাই গল্পের সেই নদীর কথা মাথায় রেখেই তিনি পেরুর জন্য এমন একটি জিওথার্মাল ম্যাপ তৈরি করেন। যেখানে দেখা যায়, আশেপাশে কোনো আগ্নেয়গিরি না থাকলেও আমাজনের কোনো কোনো ভূমির তাপমাত্রা রহস্যজনকভাবে অস্বাভাবিক হারে বেশি, যা রুজোর মনে অনেক আগ্রহের জন্ম দেয়। কারণ হঠাৎ করে এমন অস্বাভাবিক হারের তাপমাত্রার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তার কাছে ছিল না।

চরম আগ্রহের কারণেই তিনি কোনো এক ছুটিতে বাড়িতে এসে তার পরিবারকে এমন নদীর থাকার সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করেন। তার মা এবং ফুফু তাকে অবাক করে দিয়ে জানান, এমন নদীর অস্তিত্ব আসলেই আছে। শুধু তা-ই নয়, তারা ঐ নদী নিজ চোখে দেখেছেন বলে দাবি করেন, যা রুজোর অন্বেষণের জন্য অনেক বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০১১ সালে তার ফুফুকে নিয়ে আজব নদী খোঁজার কাজে বেড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে অনেক প্রত্যাশিত সেই নদীর তিনি খোঁজও পেয়ে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

নদীর পানির তাপমাত্রা পরিক্ষা করছেন আন্দ্রস রুজো
নদীর পানির তাপমাত্রা পরিমাপরত আন্দ্রেস রুজো; Image Source: Explorer Classroom

সানাই-টিমপিসকা ও প্রচলিত লোক-কাহিনী

আন্দ্রেস রুজো ছিলেন প্রথম ভূবিজ্ঞানী, যিনি এই আজব নদী খুঁজে পান। কিন্তু ঐ নদী তিনিই সবার আগে খুঁজে পান- সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করবে এ নদীর প্রাচীন নাম। অবাক করা এই নদীটির প্রাচীন নাম ‘সানাই-টিমপিসকা’, যার অর্থ ‘সূর্যের তাপে ফুটন্ত’। স্থানীয়রা সূর্যের তাপকে এই নদীর এমন উষ্ণতার জন্য দায়ী করতেন। তার মানে, উত্তপ্ত নদীটি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক আগে থেকে জানলেও তা পৃথিবীর সামনে কোনোভাবে আসেনি। নদীটিকে স্থানীয় বাসিন্দারা পবিত্রভূমি ভেবে পূজা করত। নদীর খোঁজ পেলেও সেখানে তার গবেষণা চালানো সহজ ছিল না। স্থানীয় লোককাহিনী এবং পুরোহিতদের কারণে নদীর সম্পর্কে বাইরে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। নদীর পাড়ে বসবাস করে মায়ানতুয়াকু ও সাঞ্চুয়ারিও হুইসটিন নামের দুই সম্প্রদায়।

এই দুই সম্প্রদায়কে ঘিরে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে, যা স্থানীয়রা যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস করে আসছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মায়ানতু হলো আমাজন জঙ্গলের সেই আত্মা, যার মাথা ব্যাঙের মতো, কিন্তু শরীর টিকটিকির মতো। তার হাত-পা আবার কচ্ছপের মতো। তাদের বিশ্বাস, এই মায়ানতু নামক আত্মা তাদের জন্য উপকারী। আবার ‘ইয়াকু’ অর্থ পানি। এই নদীর পানিতেই মায়ানতুর মতো অনেক শক্তিশালী আত্মার বসবাস। আর শক্তিশালী ধর্মযাজক বাদে অন্য মানুষ তাই ঐ নদীতে যেতে ভয় পায়। এই ধর্মীয় আবেগ আর লোককাহিনীর প্রতি স্থানীয়দের দৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই বাইরের পৃথিবী কোনোভাবেই এই নদীর ব্যাপারে জানতে পারেনি। যার কারণে আন্দ্রেস রুজো, ‘মায়েস্ট্রো জোয়ান’ নামের এক ধর্মযাজকের সাহায্য নিয়ে নদীতে পৌঁছান।

সেই ধর্ম জাযক যিনি আন্দ্রেজ রুজোকে নদীটির উপর গবেষণার অনুমতি দিয়েছিলেন
ধর্মযাজক মায়েস্ট্রো জোয়ান; Image Source: The Telegraph

ভৌগোলিক অবস্থান এবং অজানা কিছু তথ্য

ফুটন্ত পানির এই আশ্চর্য নদী মূলত আমাজনের পেরু অংশের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত। লিমা থেকে ‘পুকালপা’ নগরী আকাশপথে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। এটি পেরুর অন্যতম বৃহত্তম নগরী। এ নগরী থেকে ‘পাচিটা’ নদীতে যেতে সময় লাগে প্রায় দু’ঘণ্টা, এবং এ নদী দিয়েই সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত বয়েলিং ওয়াটার রিভার বা ফুটন্ত পানির নদীতে পৌঁছাতে হয়। নদীতে গিয়ে আন্দ্রেস রুজোর প্রথম ধাক্কা ছিল নদীর পানির তাপমাত্রা। তিনি উত্তপ্ত পানি ভেবেছিলেন, কিন্তু নদীর পানি আসলেই যে এতটা উত্তপ্ত হবে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। প্রথমেই তিনি থার্মোমিটারে পানির তাপমাত্রা পরীক্ষা করেন, যা ছিল প্রায় ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো; যা একেবারে সেদ্ধ করার মতো গরম না, কিন্ত কোনো প্রাণীকে মারার জন্য যথেষ্ট।

নদীর পানিতে বিভিন্ন ছোট ছোট প্রাণী, যেমন- ব্যাঙ, সাপ মরে ভেসে যেতে দেখেন আন্দ্রেস রুজো। তার মতে, কোনো প্রাণী নদীর পানিতে পড়ার পরেও সাঁতরে পার হতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথমেই প্রচণ্ড উত্তপ্ত পানিতে তার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কারণে সে কিছু দেখতে পারে না। আস্তে আস্তে বাইরের চামড়া সেদ্ধ হতে শুরু করে, তারপর মুখের মাধ্যমে শরীরে ভেতরের অঙ্গে গরম পানি প্রবেশ করে। ঐ প্রাণীর লিভার, কিডনিসহ অভ্যন্তরীণ প্রায় সব অঙ্গ অকেজো হয়ে পড়ে আস্তে আস্তে; যার কারণে সে আর সাঁতরাতে পারে না। শক্তিহীন হয়ে একসময় প্রাণীটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

এই উত্তপ্ত নদীটি আমাজন জঙ্গলের মাঝে বয়ে যাওয়া নদীর একটা অংশ মাত্র। পুরো নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার, কিন্তু এর মাঝে প্রায় ৬.২৪ কিলোমিটার অংশ উত্তপ্ত। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এটা এতটাই গরম হয়, যা যেকোনো প্রাণীকে মেরে ফেলতে সক্ষম। এর তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৯৪ ডিগ্রির মাঝে ওঠানামা করে। নদীর পানির তাপমাত্রা বছরের সেই সময়টাতেই একটু সহনীয় পর্যায়ে যায়, যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। স্থানীয় মানুষ এ নদীর পানি চা তৈরি বা অন্যান্য রান্নার কাজে ব্যবহার করে।

গরম পানির কারণে মৃত্যুবরণ করা একটি প্রানী
গরম পানির কারণে মৃত দুর্ভাগা এক ব্যাঙ; Image Source: The Business Insider

উত্তপ্ততার কারণ কী?

এ নদীর পানি উত্তপ্ত হও্রয়ার পেছনে আন্দ্রেস রুজো তিনটি সম্ভাব্য কারণ দাঁড় করান।

. তার প্রথম চিন্তা ছিল, এই নদীর পানি প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম, তা নিয়ে। প্রাকৃতিকভাবে এমন এক নদীর প্রবাহিত হওয়ার জন্য দরকার অনেক পরিমাণ তাপের যোগান, অনেক বড় আকারের পানির প্রবাহ আর এমন কোনো ব্যবস্থা, যা পানিকে একদম উপর থেকে গভীর পর্যন্ত উত্তপ্ত রাখবে। এর কোনোটাই সেখানে ছিল না। তাই এ চিন্তা বাদ দিতে হয়।

. পৃথিবীতে এ নদীর পানিই শুধু মাত্র উত্তপ্ত নয়। আরো অনেক নদী-হ্রদ আছে, যেখানে পানি উত্তপ্ত; কিন্তু এগুলোর সবগুলোই কোনো না কোনো আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি অবস্থিত। এ কারণে উত্তপ্ত লাভার সাথে উত্তপ্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ঐ নদীর আশেপাশে, প্রায় ৭০০ কিলোমিটারের মাঝে কোনো আগ্নেয়গিরি ছিল না। তাই এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে হয়।

. তৃতীয় যে কারণটি হতে পারে, তা হলো কাছাকাছি কোনো তেল উত্তোলন কেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে। এটি ভয়ানক দুর্ঘটনার পূর্বাভাস হতে পারে। আর কাছাকাছি একটি পুরাতন তেল উত্তোলন কেন্দ্রের অবস্থান রুজোর ভয় বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অনেক গবেষণার পরে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, নদীর পানি ওরকম কোনো তেল উত্তোলন কেন্দ্রের দুর্ঘটনার কারণে নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটি আশ্চর্য ঘটনা।

একজন ভূবিজ্ঞানীর অনুমান ও বিজ্ঞান

গবেষণা চলাকালে তিনি ঐ নদী সম্পর্কে কিছু অবাক করার মতো তথ্য পান। তার গবেষণা দলের মতে, পৃথিবীটাকে একটা মানবদেহের সাথে তুলনা করলে মানবদেহের রক্ত নালী, শিরা উপশিরার মতো ভূ-অভ্যন্তরেও অনেক উত্তপ্ত পাথর ও উত্তপ্ত পানির প্রবাহ বিদ্যমান। যেগুলোকে পৃথিবীর শিরা-উপশিরা বলে ধরা যায়। মানব শরীরের শিরা, উপশিরায় কোনো ছিদ্র হলে যেমন রক্ত বের হয়, ঠিক তেমনি ভূ-অভ্যন্তরেও এসব শিরা-উপশিরায় মাঝে মাঝে এমন ছিদ্র দেখা গেলে, এ উত্তপ্ত পাথর ও পানি ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসে, আর তখনই উত্তপ্ত পানির নদীর মতো বিভিন্ন ভূ-তাপমাত্রার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। উক্ত নদীর পানির রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নদীর পানি মূলত বৃষ্টির পানি। কিন্তু রুজোর অনুমান মতে, বৃষ্টির পানি অনেক দূরের আন্দিজ পর্বতের কাছাকাছি নদীর সৃষ্টির সময়ের, যেখানে নদীটি উৎপত্তি লাভ করেছে, সেখানকার।

আর এ লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার মাঝে নদীর কিছু পানি ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূ-তাপীয় শক্তির দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে আস্তে আস্তে আবার নদীর মূলধারায় ফিরে আসে উত্তপ্ত পানি রূপে। আর এ থেকেই সৃষ্টি উত্তপ্ত নদীর। তার মানে এই নদীর উত্তপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এক বৃহৎ হাইড্রোথার্মাল সিস্টেম জড়িত আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। রুজো স্পেনসার ওয়েলস এবং জনাথন এইসেন নামের আরো দুজন জীববিজ্ঞানীর সাথে কাজ করেন, যারা ঐ নদীতে বা নদীর আশেপাশে বসবাস করা সমস্ত প্রাণীর জিনোম নিয়ে গবেষণা করেন এবং দেখতে পান, তাদের মাঝে উচ্চ তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার একধরনের প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে উঠেছে।

পৃথিবীর সামনে আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ

রুজো তার অনেকদিন এর পরিশ্রমের ফসল এ নদীর ব্যাপারে পুরো দুনিয়াকে জানানোর জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে একটি আর্টিকেল লেখেন। এর মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর মানুষ নদীটি সম্পর্কে জানতে পারে। এরপর তিনি ২০১৪ সালে টেড টকে তার গবেষণার প্রায় সমস্ত তথ্য-উপাত্ত মানুষের সামনে তুলে ধরেন। এই নদীর অনেক রহস্যই এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের অজানা রয়ে গেছে।

আন্দ্রেস রুজো এখন পর্যন্ত নদীটিকে ঘিরে তার গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এখন তিনি নদী সম্পর্কে জানার চেয়ে নদী রক্ষার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি এই নদী নিয়ে তার গবেষণাপত্র ততদিন বাইরে প্রকাশ করেননি, যতদিন পর্যন্ত পেরু সরকার নদীটি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিয়েছে। তাছাড়াও রুজো এ নদীর উপর ‘দ্য বয়েলিং রিভার’ নামে একটি বই লিখেন। বইটিতে তিনি এ নদী নিয়ে তার সমস্ত গবেষণা এবং ধারণা তুলে ধরেছেন।

টেড টকএ ফুটন্ত পানির নদী নিয়ে কথা বলছেন আন্দ্রস রুজো
পৃথিবীর সামনে আত্মপ্রকাশ ঘটছে আশ্চর্য এক নদীর; Image Source; Ted Talk

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে এই জায়গাটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হলেও এর দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এটি এখনও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নদীটিকে তার নিজ বৈশিষ্ট্যে টিকিয়ে রাখা। আমাজন জঙ্গলের অবাধ বন-নিধনের ফলে নদীটির অস্তিত্ব অনেকটাই হুমকির মুখে। এ নদীর রহস্য সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই জানা বাকি আমাদের। এর মাঝে যদি মানুষের কারণে রূপকথার মতো আশ্চর্য এ নদী হারিয়ে যায়, তাহলে হয়তো হেরে যাবে রূপকথার গল্পেরই মতো অদম্য এক বিজ্ঞানী। প্রকৃতির দান প্রকৃতির কোলেই নিশ্চিন্ত মনে বয়ে যাবে হাজার বছর ধরে, এটাই চাওয়া লাখো-কোটি পরিবেশপ্রেমীর, রূপকথার এক অদম্য রাজপুত্রের। তা কি হতে দেয়া যায় না?

Related Articles