Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্বপ্ন দেখা: জানা-অজানা নানা দিক

আপনি রাতে ঘুমিয়েছেন আর স্বপ্ন দেখেননি, এমনটা কতবার হয়েছে বলুন তো? যদিও আপনার সবসময় সব স্বপ্নের কথা মনে থাকে না, বিজ্ঞান বলে, আপনি প্রতি রাতে প্রায় ৪ থেকে ৬ বার স্বপ্ন দেখেন, মানে যদি আপনি ঘুমান আর কী! স্বপ্ন নিয়ে অধ্যয়নের জন্য বিজ্ঞানের একটি আলাদা শাখাই রয়েছে; যার নাম ‘অনেইরোলোজি’ (Oneirology)। শুধু বিজ্ঞানই না, স্বপ্ন নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে নানারকম ধারণা আর মতবাদ। তেমন কিছু তত্ত্ব আর মতবাদ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সুমেরীয়রা তাদের স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখত। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বসবাস করা এই সভ্যতার অধিবাসীদের স্বপ্নের বিভিন্ন প্রতীক এবং সেগুলোর ব্যাখার এক সংকলন পাওয়া যায়- যাকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম স্বপ্নকোষ। তারা মনে করত, স্বপ্ন হলো ঈশ্বরের কাছ থেকে তাদের জন্য সংকেত। এর অর্থ জানার জন্য তারা স্বপ্নবিশারদদের শরণাপন্ন হতো। ধারণা করা হয়, স্বপ্ন সম্পর্কে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীতে হিব্রু, আরবি এবং গ্রিক সংস্কৃতির স্বপ্ন ব্যাখাকে অনেক প্রভাবিত করে। মিসরীয়রাও সুমেরীয়দের মতো স্বপ্নকে ঈশ্বরের নিদর্শন মনে করত। তারা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন, এমনকি বলিদানও করত, যাতে ঈশ্বরের তাদের কাছে ভবিষ্যৎ উন্মোচন করেন। ফারাওদের স্বপ্নগুলোকে তারা সরাসরি ঈশ্বরের আদেশ-নিষেধ হিসেবে গ্রহণ করত।

স্বপ্ন নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে নানারকম ধারণা আর মতবাদ; Source: pinterest.com

গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, মানুষ কেবলমাত্র স্বপ্নের মাধ্যমেই বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে পারে; কারণ তখন মনকে স্বাধীন করে দেওয়া হয়। হিপোক্রেটিস, অনেকের মতে যিনি আধুনিক মেডিসিনের জনক, মনে করতেন, স্বপ্ন হলো মানুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। সম্ভবত তখনই প্রথম কোনো মানুষ বুঝতে পারে যে, স্বপ্নের কোনো স্বর্গীয় উৎস নেই, তা মানুষের মনেরই সৃষ্টি। রোম সাম্রাজ্যের অগাস্টাস, যিনি জুলিয়াস সিজারের উত্তরাধিকারী, স্বপ্নকে এত গুরুত্বের সাথে নিতেন যে, তিনি আইন জারি করেছিলেন, কোনো নাগরিক যদি রাষ্ট্র সম্পর্কিত কোনো স্বপ্ন দেখে, সেটা নিয়ে সে যেন নিজ থেকেই বাজারে আলোচনা করে।

আধুনিক বিজ্ঞান কিন্তু অন্যরকম কথা বলে। এই পর্যন্ত স্বপ্ন নিয়ে যত প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ এই যে, মানুষের ঘুমের বিভিন্ন স্তর রয়েছে; যার মধ্যে একটি হলো ‘রেম স্লিপ’ (REM Sleep) পর্যায়। বেশির ভাগ স্বপ্ন আমরা এই স্তরেই দেখি। ঘুমের এই স্তরে মস্তিষ্কের কিছু অংশ আমরা জেগে থাকলে যেমন সজাগ থাকে, তেমনটাই সজাগ থাকে। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে এই REM পর্যায়টি ৫-১০ মিনিট থেকে ৩০-৩৪ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। তো স্বপ্নে আমরা যা দেখি, তা কী-ইবা দেখি, কেনইবা দেখি? আধুনিক ইমেজিং টেকনিক, যেমন- PET Scan, MRI প্রভৃতির কল্যাণে মনোবিশেষজ্ঞ এবং স্নায়ু-বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, স্বপ্ন হলো মস্তিষ্কের অতিরিক্ত তথ্য মুছে দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোর ভিত্তি আরো মজবুত করার একটি কৌশল।

বেশিরভাগ স্বপ্ন আমরা রেম স্লিপ স্তরেই দেখি; Source: factrange.com

২০০৭ সালে জার্মানির হিডেলবার্গের ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটে করা এক গবেষণা এই বক্তব্যটির সত্যতা কিছুটা নিশ্চিত করে। ইঁদুরের উপর করা সেই গবেষণায় গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, ঘুমের সময় মস্তিষ্কের নিওকর্টেক্স যখন সচল হয়, এটি হিপোক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে সংকেত পাঠায়; যেসব তথ্য হিপোক্যাম্পাস তার Short-Term Storage এ ধারণ করে রেখেছিল, সেগুলো নিওকর্টেক্সকে পাঠানোর জন্য। হিপোক্যাম্পাস তখন তার স্টোরেজ তথা তথ্যভাণ্ডার খালি করে দেয় পরবর্তী দিনের নতুন তথ্য ধারণ করার জন্য। আর নিওকর্টেক্স সিদ্ধান্ত নেয়, কোন তথ্য Long-Term Memory-তে পাঠাবে, আর কোনো তথ্য অপ্রয়োজনীয় মনে করে মুছে ফেলবে। মস্তিষ্কের ভেতর এসব তথ্য আদান-প্রদান প্রক্রিয়ার মাঝে এলোমেলো কিছু তথ্য ঘুমন্ত মনের পর্দায় আটকা পড়ে যায়, যেগুলো স্বপ্ন হিসেবে মানুষ দেখে এবং অধিকাংশ সময় বাস্তবতার সাথে এর খুবই কম মিল পাওয়া যায়।

এ তো গেল স্বপ্নের পরীক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক ব্যাখা। এবার শোনা যাক, মনোবিদরা স্বপ্নকে কীভাবে ব্যাখা করেন। এক্ষেত্রে সবার প্রথমে যার কথা আসে, তিনি হলেন ‘ড্রিম থিওরি’ এর অন্যতম প্রবক্তা সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ‘ফ্রয়েডিয়ান সাইকোঅ্যানালাইসিস’-এর মতে, স্বপ্ন হলো মানুষের অবদমিত ইচ্ছা পূরণের জায়গা। ফ্রয়েড স্বপ্নকে বলতেন ‘অবচেতন মনের রাজকীয় পথ’। তিনি মনে করতেন, স্বপ্ন হলো মানুষের অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি এবং তা মানুষের অবচেতন মনের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাগুলোই স্বপ্নের আকৃতি ধারণ করে। যদিও তার প্রথম দিকের গবেষণাগুলোতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্নের অধিকাংশ সুপ্ত বিষয়বস্তু হলো যৌনতা কেন্দ্রিক, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এই ধারণা থেকে কিছুটা সরে আসেন। তার পরবর্তী লেখাগুলোতে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ভয়-আতঙ্ক, মানসিক আঘাত প্রভৃতি অন্যান্য জিনিসও মানুষের স্বপ্নকে প্রভাবিত করে। এমনকি তিনি স্বপ্নের ক্ষেত্রে অনেক সময় অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড; Source: National Vanguard

স্বপ্নের মানসিক দিক নিয়ে গবেষণাকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকজন হলেন কার্ল জাংগ (Carl Jung)। তিনি ফ্রয়েডের অনেক তত্ত্বকে প্রত্যাখান করেন। কিন্তু স্বপ্ন যে মানুষের অবচেতন মনের সাথে সম্পর্কিত, ফ্রয়েডের এই ধারণাকে তিনি বিস্তৃত করেন। তিনি মনে করতেন, স্বপ্ন মানুষের জন্য গোপন সংবাদের মতো এবং মানুষের স্বপ্নে দেখা ভাল-মন্দ জিনিসগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তার বিশ্বাস ছিল, স্বপ্ন মানুষের কাছে এমন গোপন কিছু উন্মোচিত করে, যার দ্বারা সে মানসিক, ধার্মিক নানান সমস্যা ও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারবে। ফিটজ পার্ল, আরেকজন বিখ্যাত মনোবিদ, উল্লেখ করেন যে, মানুষ স্বপ্নে যা দেখে তা তার ব্যক্তিত্বেরই বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলে।

স্বপ্নের আবার বিভিন্ন ভাগ-বিভাজন রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং মজাদার একটি অংশ হলো লুসিড ড্রিমিং (Lucid Dreaming)। এটি এমন একটি পর্যায়, যখন যে ব্যক্তি স্বপ্ন দেখছে, সে বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নের বিষয়বস্তু এমনকি চরিত্রের ক্ষেত্রেও ব্যক্তির তখন কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ থাকে! এই লুসিড ড্রিমিং বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত এবং যারা লুসিড ড্রিমিং করতে পারে তাদেরকে অনেক সময় অনেইরোনাট (Oneironaut) বলা হয়।

মজাদার একটি অংশ হলো লুসিড ড্রিমিং; Source: bigthink.com

স্বপ্নে দেখা বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে কিন্তু অনেক বড় বড় আবিষ্কারও হয়েছে! তরুণ আইনস্টাইন নাকি একবার স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি একটি খাড়া পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন। পড়ার সময় তার গতি বাড়তে থাকল। বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে যখন তা আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছল, তখন তিনি খেয়াল করলেন যে, আকাশের তারাগুলোর আকৃতি তার সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। কথিত আছে, এই স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই আইনস্টাইন পরবর্তীতে তার বিখ্যাত ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ আবিষ্কার করেন। গণিতশাস্ত্রের বিখ্যাত প্রতিভা শ্রীনিবাস রামানুজন নিজেই বলতেন যে, স্বপ্নে ‘নামাক্কাল’ নামে এক দেবী এসে তাকে বিভিন্ন জটিল গাণিতিক সূত্র এবং ধারণা বলে যেতেন। তার দেখা ‘গাণিতিক স্বপ্নের’ এক বিখ্যাত ফসল হল ‘পাই’ এর অসীম ধারা।

শ্রীনিবাস রামানুজন; Source: CodePen

স্বপ্ন নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। নিত্যনতুন তথ্য মানুষের সামনে আসছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কের কিছু কিছু রোগ, যেমন- পার্কিনসন্স ডিজিস (Parkinson’s Disease ) প্রভৃতির সাথে স্বপ্নের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এ কথা ঠিক যে, স্বপ্ন নিয়ে যত মতবাদ প্রচলিত আছে, তার বেশিরভাগের মধ্যেই বিতর্ক আছে। আর থাকবেই বা না কেন? মানুষ তো এখন পর্যন্ত মস্তিষ্কের কার্যকলাপই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেনি, তাহলে সে এর এক রহস্যময় খেয়াল স্বপ্নকে কীভাবে ব্যাখা করবে? আশা করা যায়, বিজ্ঞান যখন মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারবে, স্বপ্ন নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর তখন মানুষের হাতের নাগালে আসবে।

ফিচার ইমেজ: mindvalleyacademy.com

Related Articles