বিশ্বে মোট নিঃসরিত গ্রীন হাউজ গ্যাসের ৩% আসে জাহাজশিল্প থেকে। সমুদ্রে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বিভিন্ন ধরনের নৌযান কর্তৃক ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে এই গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধকল্পে জীবাশ্ম জ্বালানির সম্ভাব্য বিকল্প কী হতে পারে?
গ্রীন হাইড্রোজেন
গ্রীন হাইড্রোজেন বর্তমানে গবেষকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রশ্ন হচ্ছে- গ্রীন হাইড্রোজেন বা হাইড্রোজেন জ্বালানি কী? জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারকেই গ্রীন হাইড্রোজেন বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ’গ্রীন’ বলা হয়ে থাকে কারণ প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবেশের জন্য যতটা ক্ষতিকর সেই তুলনায় হাইড্রোজেন জ্বালানি বেশ পরিবেশ বান্ধব। জীবাশ্ম জ্বালানির উপজাত হিসেবে ক্ষতিকর বিভিন্ন পদার্থ পাওয়া যায়, কিন্তু হাইড্রোজেন জ্বালানির একমাত্র উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় পানি।
জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার অত্যন্ত বিচিত্র। একে তরল কিংবা বায়বীয় দু’অবস্থাতেই ব্যবহার করা যায়। জীবাশ্ম জ্বালানি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত যত সীমাবদ্ধতা আছে, হাইড্রোজেন জ্বালানির ক্ষেত্রে সেরকমটা নেই। একাধিক পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি হচ্ছে তেল পরিশোধন, অ্যামোনিয়া উৎপাদন, স্টিল উৎপাদন, রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং সার কারখানা ইত্যাদি শিল্পে ব্যবহারের জন্য।
গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন
এখন পর্যন্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদনের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো স্টিম মিথেন রিফর্মিং। এই পদ্ধতিতে উচ্চ তাপমাত্রায় মিথেনের সাথে জলীয় বাষ্পের বিক্রিয়ায় প্রধানত হাইড্রোজেন এবং নগণ্য পরিমাণে কার্বন মনোঅক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। এটি প্রথম ধাপের বিক্রিয়া। এর অব্যবহিত পরের ধাপের বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত একটি প্রভাবক, জলীয় বাষ্প, কার্বন মনোঅক্সাইড বিক্রিয়া করে অধিক পরিমাণ হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি করে। পরিশেষে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যান্য অপদ্রব্যগুলো পরিশোধন করে বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন পৃথক করে ফেলা হয়।
মিথেনের পাশাপাশি অন্যান্য হাইড্রোকার্বন বা জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন- প্রোপেন, গ্যাসোলিন, কয়লাও ব্যবহার করা যেতে পারে জলীয় বাষ্পের সাথে বিক্রিয়ার জন্য। জীবাশ্ম জ্বালানিকে ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে হাইড্রোজেনের পাশাপাশি প্রতি বছর ৮৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড পাওয়া যায় যা কিনা যুক্তরাজ্য ও ইন্দোনেশিয়ার নিঃসরিত মোট কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমান। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত হাইড্রোজেনকে বলা হয় গ্রে হাইড্রোজেন।
স্টিম মিথেন রিফর্মিং প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেনের পাশাপাশি লব্ধ কার্বন ডাইঅক্সাইডকে পৃথক করে বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন পাওয়া গেলে সেটিকে বলা হয় ব্লু হাইড্রোজেন।
পানির বিশ্লেষণের মাধ্যমেও হাইড্রোজেন জ্বালানি পাওয়া যেতে পারে। পানির তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাইড্রোজেনের পাশাপাশি উপজাত হিসেবে কেবল অক্সিজেন পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে একটি ইলেক্ট্রোলাইজারের মাঝে তড়িৎ চালনা করার মাধ্যমে পানির বিশ্লেষণ সম্পন্ন করা হয়। এই সরবরাহকৃত তড়িৎ শক্তির উৎস যদি কোনো নবায়নযোগ্য শক্তি হয় তাহলে কোনো দূষণকারী পদার্থবিহীন হাইড্রোজেনকে গ্রীন হাইড্রোজেন বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে নবায়নযোগ্য শক্তি আরও সহজলভ্য (প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন এবং ব্যয় হ্রাসের দরুন) হওয়ায় এই পদ্ধতিকেই বিবেচনা করা হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল উৎপাদন প্রক্রিয়া হিসেবে।
গ্রীন হাইড্রোজেন ব্যবহারের সমস্যা এবং বিকল্প
নৌযানে ব্যবহারের জন্য জ্বালানি হিসেবে গ্রীন হাইড্রোজেনের বেশ কিছু বিকল্প আছে। উদ্ভিজ্জ উৎস কিংবা প্রাণিজ উচ্ছিষ্ট থেকে প্রাপ্ত শক্তিকেও ব্যবহার করা যেতে পারে নৌযানের জ্বালানি হিসেবে। তবে ইতোমধ্যেই অন্যান্য বিভিন্ন খাতে শক্তির এই উৎসের ব্যবহার বিদ্যমান থাকায় এটি খুব কার্যকর হবে না জাহাজশিল্পের জন্য। নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জ করে সেটিকে জাহাজে ব্যবহার করা যেতে পারে তবে এখানেও সীমাবদ্ধতা আছে। বিলাসবহুল এবং পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বেশ কিছু জাহাজ আছে যাদের আকার অত্যধিক বড়। আবার কিছু জাহাজ আছে যেগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে সাগরপথে লম্বা পথ পাড়ি দেয়। বৃহদাকার এবং দীর্ঘ পথযাত্রার এসব জাহাজের জন্য চার্জিত ব্যাটারি একেবারেই সুন্দর সমাধান হতে পারে না। অত বড় জাহাজ চালানোর জন্য কিংবা অত লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ ব্যাটারি প্রয়োজন হবে তার জন্য জাহাজে যথেষ্ট পরিমাণ স্থান থাকবে না।
অর্থাৎ শেষমেশ বাদ রইল শুধু হাইড্রোজেন বা অন্যান্য যে কোনো সংশ্লেষিত জ্বালানি। ১৯৭৫ সালের তুলনায় বর্তমানে হাইড্রোজেন জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। এই ক্রমবর্ধমান সরবরাহের প্রায় পুরোটাই খরচ হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প কারখানায়। বলা বাহুল্য, উৎপাদিত এই হাইড্রোজেনের বেশিরভাগই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের ৬% এবং কয়লার ২% সরাসরি হাইড্রোজেন উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ নৌযানে (বিশেষভাবে নকশাকৃত) সরাসরি উৎপাদিত হাইড্রোজেন থেকে তার জ্বালানির সরবরাহ কিন্তু দিব্যি মেটানো যেত, যেহেতু সেটি হত সম্পূর্ণভাবে নিঃসরণ শূন্য (Zero Emission) প্রক্রিয়া। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যতীতও হাইড্রোজেন প্রস্তুত করা সম্ভব পানির তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মোট হাইড্রোজেনের মাত্র ০.১% এই পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে।
জাহাজে হাইড্রোজেন জ্বালানিকে ব্যবহারের একাধিক পদ্ধতি আছে। সবেচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে জাহাজের অভ্যন্তরে নির্মিত কোনো দহন ইঞ্জিনে (combustion engine) জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হবে। তবে এখানে একটি সমস্যা আছে- বাতাসের প্রায় বেশিরভাগ অংশ জুড়ে নাইট্রোজেন গ্যাস থাকে। তাই বাতাসে যে কোনো কিছুর দহনে নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড তৈরি হয় যেগুলো পরিবেশের দূষণের জন্য দায়ী। তবে এর সমাধানও রয়েছে। দহন পরবর্তী একটি বিশুদ্ধকরন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহকে পৃথক করার ব্যবস্থা থাকলে সেগুলো সরাসরি বাতাসে মিশে যাবে না।
হাইড্রোজেনকে সরাসরি কোনো জ্বালানি কোষে (fuel cell) ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে হাইড্রোজেনের দহনকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় যার কারণে ক্ষতিকর কোনো গ্যাস তৈরির সম্ভাবনাও থাকে না। কোষের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয় এবং একমাত্র উপজাত হিসেবে পানি পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে মুশকিল হলো এতে করে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি কোষ প্রয়োজন হয় যেগুলোর জন্য জাহাজে স্থান সংকুলান করা এক বিরাট সমস্যা।
আরেকটি বিকল্প হচ্ছে বাষ্পচালিত হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ। শতভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন সহযোগে হাইড্রোজেনের দহনের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাষ্পকে ব্যবহার করে একটি টারবাইন চালানো হয় যেখান থেকে অবশেষে বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে- জীবাশ্ম জ্বালানির এত চমৎকার ব্যতিক্রম থাকার পরও কেন জাহাজশিল্পে গ্রীন হাইড্রোজেনের বহুল ব্যবহার হচ্ছে না। এখনও কেন জাহাজ শিল্প মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির উপরেই নির্ভর করছে? বিষয়টি অনেকটা সেই কখনও-শেষ-না-হওয়া ডিম আগে না মুরগি আগে তর্কের মতোই। হাইড্রোজেন জ্বালানিশিল্পে বিনিয়োগকারীরা দেখতে চাচ্ছেন বাজারে সত্যিই হাইড্রোজেন জ্বালানির কদর বা চাহিদা ঠিক কতটা? চাহিদা বুঝে তারা নির্ধারণ করবেন যে তারা ব্যপক হারে এর পেছনে অর্থ ঢালবেন কিনা। অন্যদিকে জাহাজ শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ ভাবছেন, যেখানে এই জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহই নেই তাহলে আমি খামোখা কেন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যাব?
This article is written in Bangla. This article is about green hydrogen fuel. All the necessary references are hyperlinked within the article.
Feature Image: bbc.com