Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘হ্যালি সিক্স’: অ্যান্টার্কটিকায় বিশ্বের প্রথম স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার

বিশাল আকারের গবেষণাগারকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যেতে পারলে কী সুবিধাই না হতো! কিন্তু চাইলেও অনেক সময় তা করা যম্ভব হয় না। তবে পৃথিবীতে এমন গবেষণাগার যে একটিও নেই, তা বললে ভুল হবে। জনমানবহীন অ্যান্টার্কটিকার ধু ধু বরফের রাজ্যে আছে এমনই এক গবেষণাগার, যেটিকে ইচ্ছা করলেই যেখানে ইচ্ছা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে’ নামক গবেষণা সংস্থার পরিচালিত ‘হ্যালি সিক্স’ নামের এই গবেষণাগারটি বিশ্বের প্রথম স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার।

ধু ধু বরফের রাজ্যে ‘হ্যালি সিক্স’; Source: British Antarctic Survey

হিমাংকের নীচে ৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যাওয়া তাপমাত্রা কিংবা দিনের পর দিন সূর্যের আলো না দেখেও অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বিজ্ঞানের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন একদল গবেষক। পৃথিবীর আবহাওয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে যাওয়া গবেষকদের মাথার উপর ছাদ হিসেবেও কাজ করে এই গবেষণাগারটি। এই গবেষণাগার থেকেই ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম পৃথিবীর রক্ষাকবচ ওজোন স্তরে ফাটল খুঁজে পাওয়ার ভয়ানক খবরটি বিশ্বজুড়ে প্রচারিত হয়েছিলো।

ওজোন স্তরে ফাটল খুঁজে পাওয়ার তথ্যটি এই গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরাই প্রথম নিশ্চিত করেছিলেন; Source: media.buzzle.com

শুধু তা-ই নয়, মেরু এলাকার প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশের অনেকটা মিল থাকায় এই গবেষণাগারে সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে নামিদামি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোরও। মহাকাশে বসবাস আর টিকে থাকার জন্য এই এলাকায় ক্রমাগত পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে নাসা আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।

যতদূর চোখ যায়, শুধুই বরফ; Source: British Antarctic Survey

১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গবেষণাগারের নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত জ্যোর্তিবিদ এডমন্ড হ্যালির নামানুসারে। সেই থেকে শুরু করে মোট পাঁচ প্রজন্ম ধরে চলছে এই গবেষণাগার। এই গবেষণাগারের প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিলো পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে পরিবেশগত পরিবর্তনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা। কিন্তু মেরু অঞ্চল মোটেও সাধারণ কোনো জায়গা নয়, পরিবেশ সেখানে বড়ই নির্মম। পরিবেশগত পরিবর্তন অনেক বেশি হওয়ায় মেরু অঞ্চলে এক জায়গায় দীর্ঘদিন অবস্থান করা সম্ভবপর না-ও হয়ে উঠতে পারে। তাই গবেষণাগারটিকে যেভাবেই হোক মাঝেমধ্যে এদিক সেদিক সরিয়ে নিতে হবে।

বর্তমানে ‘হ্যালি সিক্স’ নামে যে অত্যাধুনিক অবকাঠামোটি রয়েছে, সেটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৬ মিলিয়ন ইউরো সমপরিমাণ অর্থ। অনেকটা রেলগাড়ির মতো দেখতে এই গবেষণাগারের রয়েছে মোট আটটি অংশ। আটটি কক্ষকে জোড়া লাগিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পুরো অবকাঠামোটি। আটটি কক্ষের প্রতিটিকে একটি আরেকটি থেকে আলাদা করে এদের নিচে থাকা বিশেষ স্কিয়ের সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় খুব সহজেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রয়োজনটি আরো বেশি করে অনুভূত হয়েছে। কারণ ‘হ্যালি সিক্স’ নামক গবেষণাগারটিকে ‘ব্রান্ট আইস সেলফ’ নামক জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখে দিয়েছিলো। কারণ ঐ এলাকায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ফাটল।

‘ব্রান্ট আইস সেলফ’ এলাকায় দেখা গেছে ফাটল; Source: British Antarctic Survey

অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাকতিতেও যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নির্মম শিকার হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তাই সময়ের সাথে গবেষণাগারকে ক্ষয়ে যাওয়া বরফের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যও স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইদানিং সেই মাত্রা বেশ বেড়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে বরফের রাজ্যে উদ্ভূত ফাটল থেকে এই গবেষণাগারকে বাঁচাতে এর পূর্বের অবস্থান থেকে তেইশ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফাটলের কারণেই স্থানান্তর করা হয়েছে ‘হ্যালি সিক্স’কে; Source: British Antarctic Survey

অ্যান্টার্কটিকার শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রী থেকে শুরু করে মাইনাস ৫৫ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। একনাগাড়ে ১০৫ দিন পর্যন্ত আলোর দেখা নাও মিলতে পারে। তবে এই গবেষণাগার থেকে সাক্ষী হওয়া যায় এমন অনেক মহাজাগতিক ঘটনার, যার দেখা সাধারণ স্থানে মিলবে না। যেমন, নির্জন প্রান্তরের এই গবেষণাগারের বাসিন্দাদের রাতের আকাশের সঙ্গী হয়ে দেখা দেয় ‘অরোরা অস্ট্রালিস’। আকাশে আলোর এই অসাধারণ খেলা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা দুর্লভ বটে!

হ্যালি সিক্স থেকে দেখা পাওয়া যায় ‘অরোরা অস্ট্রালিস’; Source: British Antarctic Survey

পৃথিবীর চরমতম এই পরিবেশেও যাতে গবেষকরা বাধাহীনভাবে কাজ করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে এই ল্যাবগুলোকে বেশ অত্যাধুনিকভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। পাশাপাশি শত প্রতিকূলতার মাঝেও এই গবেষণাগারগুলোতে রয়েছে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎসহ নিত্যদিনের সকল সুবিধা। এই সুবিধা দেওয়ার জন্য ১২০ কিলোওয়াটের সমন্বিত তাপ ও বিদ্যুৎ ইঞ্জিন রয়েছে, যেগুলোকে বিমানের জ্বালানি দিয়ে সচল রাখা হয়। চরম ঠাণ্ডা তাপমাত্রার কারণে এই গবেষণাগার আর নিত্যদিনের কাজে ব্যবহার করার জন্য পানি উৎপাদন করাও দুষ্কর। তবে এই সাবধানতার মাঝেও এই গবেষণাগারেও মাঝমধ্যে ঘটে যায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই টানা ১৯ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাটি বিকল হয়ে পরেছিলো।

হ্যালি সিক্সের একটি গবেষণাগার; Source: www.aecom.com

তবে জনমানবহীন এই তুষার অরণ্যে শীতকালে সর্বোচ্চ ১৬ জন এই গবেষণাগারে অবস্থান করতে পারেন। তবে পরিবেশ যখন একটু সুপ্রসন্ন থাকে, তখন এই গবেষণাগারগুলোও মুখর হয়ে উঠে। গ্রীষ্মে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই গবেষণা অবকাঠামোতে একসাথে প্রায় সত্তর জন গবেষক কাজ করতে পারেন।

গবেষকদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবেও কাজ করে এই অবকাঠামো; Source: British Antarctic Survey

তবে এই অবকাঠামোতে গবেষকদের শুধু যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, এমনটাই কিন্তু নয়। আছে হাসপাতাল, জিমনেশিয়াম এবং আড্ডা দেওয়ার জায়গা। খোশগল্পের পাশাপাশি ইনডোর গেমসের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে পুরো অবকাঠামোটিতে।

অবসর সময়ের খোশগল্পে মত্ত ‘হ্যালি সিক্স’ এর গবেষকরা; Source: www.aecom.com

পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এই গবেষণাগারটি স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথমেই যে ব্যাপারটির দিকে স্থপতিদের নজর দিতে হয়েছিলো তা হলো এই গবেষণাগারটিকে যথাসম্ভব হালকা কিন্তু মজবুত করতে হবে। জনমানবহীন বরফের রাজ্যে একটি গবেষণাগার স্থাপনের অন্যতম আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিলো এর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ। পাশাপাশি এই গবেষণাগার থেকে উৎপন্ন বর্জ্যকে পরিত্যাগ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও ছিলো অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ব্রিটেনে একটি সাধারণ বাড়িতে টয়লেটের ফ্লাশেই ব্যবহার করা হয় প্রায় নয় লিটারের মতো পানি, এই পরিমাণকে কমিয়ে মাত্র ১.২ লিটার করতে এই অবকাঠামোতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ভ্যাকুয়াম ড্রেইনেজ প্রক্রিয়া’, যেটি সাধারণত এতদিন মহাকাশযানগুলো আর স্পেস স্টেশনেই দেখা যেতো। তবে সেই প্রক্রিয়াটির খরচ কমিয়ে আনাও ছিলো এই অবকাঠামো নির্মাতাদের অন্যতম সাফল্য। পাশাপাশি বায়ো রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে সুয়েজ ট্রিটমেন্ট করে বর্জ্য উৎপাদন এবং দুই স্তর চুল্লির মাধ্যমে কিছু বর্জ্যকে পুড়িয়ে ফেলায় এই গবেষণা অবকাঠামো পরিবেশের উপর চাপ অনেকটাই কমিয়ে এনেছে।

পরিবেশগত দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত এই ‘হ্যালি সিক্স’; Source: aecom.com

আর অসাধারণ এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই প্রকল্প বিশ্ব জুড়ে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। প্রকৃতির ক্ষতিকে কমিয়ে এনে অভিনব এই স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার ২০১৩ সালে ‘British Construction Industry‘ ঘোষণা করে ‘International Project of the Year‘ হিসেবে। ‘The American Institute of Architects‘ এই প্রজেক্টকে ‘U.K. Chapter Excellence in Design‘ হিসেবে সম্মাননা দেয়।

ফিচার ইমেজ: aecom.com

Related Articles