পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত পুরষ্কারটির নাম, নোবেল পুরষ্কার। যার হাত ধরে এর প্রবর্তন, সেই আলফ্রেড নোবেল মূলত ডিনামাইট উদ্ভাবন করেছিলেন। অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যাবসা করে এক জীবনে অনেক অর্থ-বিত্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৮৮৮ সালে এসে তিনি অনুধাবন করলেন, বড় এক ভুল হয়ে গেছে। সে সময় তার ভাই লুডভিগ নোবেলের মৃত্যুর খবর বড় করে ছাপিয়েছে পত্রিকাগুলো। সেই খবরে লুডভিগকে তারা আখ্যায়িত করেছে 'মৃত্যু ব্যবসায়ী' নামে। আলফ্রেড নোবেল ভাবলেন, তার নিজের মৃত্যুর পরেও এরকম শিরোনামই প্রকাশ করবে সংবাদপত্রগুলো। তাহলে, এই সমস্যা সমাধান করার উপায় কী?
নিজের সম্পত্তির ৯৪ শতাংশ তিনি লিখে দিয়ে গেলেন একটি পুরষ্কারের জন্য। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শান্তি এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য এই পুরষ্কার দেয়া হবে। একে কি প্রায়শ্চিত্ত বলা যায়? ভালো-খারাপে কাটাকাটি হয়ে যাওয়ার মতো কিছু?
পরবর্তীতে, ১৯৬৮ সালে সুইডেনের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও দ্য রিক্সব্যাংক নিজেদের ৩০০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে নোবেল ফাউন্ডেশনকে বিশাল অংকের টাকা অনুদান দেয় অর্থনীতিতে আরেকটি পুরষ্কার দেয়ার জন্য। এটি মূলত নোবেল পুরষ্কার না, কারণ নোবেল নিজে এটি চালু করে যাননি, তারপরও এই পুরষ্কারটিকেও নোবেল পুরষ্কার বলেই গণ্য করা হয়।
পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান- সবই নোবেল পুরষ্কারের আওতায় এসেছে, কিন্তু বাদ পড়ে গেছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র- গণিত। অথচ গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের ভাষা। পুরষ্কার না পেলেও গণিতবিদরা কিন্তু তাদের কাজ থামিয়ে দেননি। বিজ্ঞানীরা নিজেদের কাজের স্বীকৃতি অবশ্যই চান। কিন্তু তারা সাধারণত স্বীকৃতির জন্যে কোনো কাজ করেন না।
বিজ্ঞানীদের কাজের মূল্য পরিশোধ করা কিংবা তাদের ঋণ শোধ করা তো আসলে সম্ভব নয়। যেটুকু করা যায়, তাতে তাদেরকে কিছুটা স্বীকৃতি দেওয়া হয় মাত্র। আর সেই স্বীকৃতি বিজ্ঞানের সব শাখার মানুষ পাবেন, আর গণিতজ্ঞরা পাবেন না, এটা কেমন কথা? এসব ভেবে নরওয়ে সরকার ২০০২ সালে একটি নতুন পুরষ্কারের প্রচলন করে। গণিতজ্ঞ নিলস হেনরিক অ্যাবেলের নামে এর নাম দেওয়া হয় অ্যাবেল পুরষ্কার।
কেউ কেউ ভাবেন, নোবেলের নামের সঙ্গে মিল রেখে এই বিজ্ঞানীর নামকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে এ কথার পেছনে কোনো সত্যতা আছে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না। তবে কথা হলো, কে এই নিলস হেনরিক অ্যাবেল? যার নামে তাবৎ গণিতজ্ঞদের সম্মানিত করা হচ্ছে?
নিলস হেনরিক অ্যাবেল একজন নরওয়েজিয়ান গণিতজ্ঞ। তার জন্ম ১৮০২ সালের ৫ই আগস্ট। আধুনিক গণিতের একাধিক শাখায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন তিনি।
বাবা ছিলন দরিদ্র লুথারিয়ান পাদ্রী। দক্ষিণ নরওয়ের এক শহরে থাকতেন তারা। ১৮১৫ সালে অসলোর ক্যাথেড্রাল স্কুলে পড়াশোনা শুরু। ২ বছর পরে নতুন এক গণিত শিক্ষক যোগ দিলেন সেই স্কুলে। বার্ন্ট মিখায়েল হোমবো। তিনিই প্রথম অ্যাবেলের গণিত প্রতিভা চিনতে পেরেছিলেন। গণিতের ক্লাসিক সব বইপত্র, সমস্যা ইত্যাদির সঙ্গে অ্যাবেলকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। নিউটন, অয়লার থেকে গাউস- সবার কাজ নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন অ্যাবেল। তারপর শুরু করেছেন নিজস্ব গবেষণা।
একসময় বাবা মারা গেলেন। পরিবার পড়ল অকুল পাথারে। সব মানুষের জীবনেই এমন কিছু মানুষ থাকে, যারা সব ভুলে এগিয়ে আসে বিপদের দিনে। এই মানুষগুলোর কথা কখনো জানা যায়, কখনো তারা হারিয়ে যান ইতিহাসের আড়ালে। অ্যাবেলের জীবনে সেই ভূমিকায় এগিয়ে এলেন শিক্ষক হোমবো। নিজে যেমন সরাসরি আর্থিকভাবে সাহায্য করলেন, তেমনি কিছুটা ফান্ড সংগ্রহ করে দিলেন অ্যাবেলের জন্য। সেই টাকা দিয়ে অ্যাবেল, অসলোর ইউনিভার্সিটি অব ক্রিশ্চিয়ানায় ভর্তি হলেন ১৮২১ সালে। ১৮২২ সালে পেলেন প্রিলিমিনারি ডিগ্রি। তারপর হোমবোর সাহায্যে নিজের মতো করে চালিয়ে গেলেন পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজ।
ফাংশনাল ইকুয়েশন এবং ইন্টিগ্রাল নিয়ে অ্যাবেলের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৮২৩ সালে। অর্থাভাবে ভুগছেন তখন তীব্রভাবে। তার বন্ধুবান্ধব নরওয়েজিয়ান সরকারের কাছে আবেদন করল, অ্যাবেলকে যেন জার্মানি বা ফ্রান্সে একটা ফেলোশিপের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কিন্তু সেই আবেদনের উত্তর আসতে যে দেরী হবে, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। এদিকে, একটা গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক সমস্যা (দ্য জেনারেল ইকুয়েশন অব ফিফথ ডিগ্রি) যে বীজগাণিতিকভাবে সমাধান করা কখনো সম্ভব হবে না, সেটা প্রমাণ করে ফেলেছেন। নিজের খরচে প্রকাশও করে ফেললেন সেটা। সে সময়ের বিখ্যাত গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিখ গাউসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন এই প্রমাণ। পৃথিবী বিখ্যাত এক অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যার যে সমাধান হয়ে গেছে, সেটা স্বচক্ষে দেখেও বুঝতে পারলেন না গাউস। বাতিল করে দিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য গণিতবিদরা বুঝতে পেরেছিলেন, অ্যাবেল কী করে বসে আছেন!
১৮২৬ সালে অ্যাবেল গেলেন প্যারিসে। উদ্দেশ্য, সেখানে নিজের একটা স্থায়ী গতি করা। সে সময় গণিত চর্চার কেন্দ্র ছিল প্যারিস। সব গণিতজ্ঞের সঙ্গে কাজ করার সুযোগও পেয়ে গেলেন। থিওরি অফ ইন্টিগ্রালস অফ অ্যালজেবরিক ফাংশনের উপর বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা পেপার লিখে ফেললেন তিনি। ফলশ্রুতিতে তৈরি হলো অ্যাবেলের উপপাদ্য। এর উপরে ভিত্তি করে পরবর্তীতে অ্যাবেলিয়ান ইন্টিগ্রালস এবং অ্যাবেলিয়ান ফাংশনের তত্ত্ব তৈরি হয়। সহজ কথায় বলা যায়, গণিতের আস্ত একটা শাখাই তৈরি হয়েছে এই মানুষটির হাত ধরে। কিন্তু তাতে তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি নিজের জন্য।
কাজেই, ঋণের বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে অ্যাবেল আবারো নরওয়েতে ফিরে আসলেন। ততদিনে শরীরে বাসা বেঁধেছে টিউবারকোলোসিস। একে সাথে নিয়েই কাজে নামলেন। ১৮২৮ সালে শিক্ষকতা শুরু করলেন ক্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শরীর খারাপ কিংবা আর্থিক দৈন্যদশা কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। ইকুয়েশন থিওরি এবং এলিপটিক ফাংশন নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন এ সময়, লিখেছেন বেশ কিছু পেপার। বিখ্যাত গণিতবিদ গুস্তাব জ্যাকোবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এলিপটিক ফাংশন তত্ত্ব এগিয়ে নিয়ে গেছেন অনেকদূর। এই সময়ে এসে অ্যাবেলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ফ্রেঞ্চ একাডেমির একদল বিজ্ঞানী তার জন্যে স্থায়ী একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। এমনকি নরওয়ে-সুইডেনের তৎকালীন রাজার সঙ্গেও তারা কথা বলেছিলেন এ নিয়ে।
কিন্তু ততদিনে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন অ্যাবেল। এর কিছুদিনের মধ্যেই, ১৮২৮ সালে ইহকাল ত্যাগ করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের একজন, নিলস হেনরিক অ্যাবেল।
তার ১০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে, ১৯০২ সালে একটি পুরষ্কারের প্রচলন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন নরওয়েজিয়ান গণিতবিদ সোফাস লাই। কিন্তু ১৮৯৯ সালে লাই নিজেই পরলোকগত হন। ১৯০২ সালে রাজা দ্বিতীয় অস্কার আবারো এই পুরষ্কারের কথা বলেন। কিন্তু সুইডেন আর নরওয়ের আলাদা হয়ে যাওয়া, অর্থনীতির উপরে এর প্রভাব ইত্যাদি মিলে সেবারও আর করা হয়ে উঠেনি।
তবে অ্যাবেলের কথা পুরো সময়টুকুতে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। তাবৎ গণিতজ্ঞরা তাকে সম্মানের চোখে দেখে এসেছেন সবসময়ই। সেজন্যেই ২০০২ সালে আবার যখন অ্যাবেল পুরষ্কারের কথা উঠল, ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিকাল ইউনিয়ন এবং সে সময়ের সব গণিতবিদই একে শতভাগ সমর্থন দিয়েছিলেন। এর অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হলো ১ মিলিয়ন ডলার। গণিতের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হিসেবেও একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হলেও গণিতে যেহেতু দেওয়া হয় না, সেজন্যে মানুষ একে গণিতের নোবেল নামে ডাকা শুরু করে। তবে, দুটো পুরষ্কারের মধ্যে বাস্তবে কোনো সম্পর্ক নেই।
২০০৩ সালে বীজগাণিতিক টপোলজি নিয়ে কাজের জন্য প্রথম অ্যাবেল পুরষ্কার পান জিন-পিয়েরে সেরে। পরের বছর একুশ শতকের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ স্যার মাইকেল আতিয়াহ টপোলজির জন্য এই পুরষ্কার পেয়েছেন। ফি বছর গণিতের শ্রেষ্ঠ কাজের জন্য এই পুরষ্কার দেয়া হয়।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো একজন নারী এই পুরষ্কার পেয়েছেন। তার নাম, ক্যারেন উলেনবেক। জ্যামিতিক পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন, গজ তত্ত্ব এবং ইন্টিগ্রাল সিস্টেমস-এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যই পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি।
নোবেল যেখানে 'মৃত্যুর বণিক' কুখ্যাতি এড়ানোর জন্যে নোবেল পুরষ্কারের প্রচলন করছেন, সেখানে অ্যাবেল ছিলেন একজন সত্যিকারের গণিতবিদ। যিনি জীবদ্দশায় খুব বেশি কিছুর আশায় হিসেব কষেননি। কাজ করেছেন গণিতকে ভালোবাসতেন বলে, গণিতকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন বলে। এখনও, গণিতবিদরা নোবেল পুরষ্কারের মতো বিখ্যাত কিছুতে ভূষিত হওয়ার সুযোগ পান না। তাদের নাম ঘুরে ফেরে না মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু তারা নিজেদের কাজ করে যান চুপচাপ।
আর এই নিঃস্বার্থ মানুষগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাদেরই মতো আরেকজন চমৎকার গণিতজ্ঞের স্মরণে। যথার্থ স্বীকৃতি বোধ হয় একেই বলে।
This article is in Bangla language. It is about the Abel Prize, the most prestigious prize in mathematics. Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image: abelprize.no