Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যুগে যুগে ব্যাটারির বিবর্তন

আজকের যুগে মোবাইলের ভেতর সুদৃশ্যভাবে ব্যাটারি বসানো থাকে। সেসব ব্যাটারির ক্ষমতাও থাকে বেশ। চার্জারের মাথা মোবাইলে লাগিয়ে নিমিষেই চার্জ করে ফেলা যায় সেগুলো। সবার কাছেই এটা ভাত খাওয়া কিংবা জল খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন ব্যাটারি মোটেই স্বাভাবিক কিছু ছিল না। সামান্য একটু চার্জের প্রভাব দেখে তাজ্জব বনে যেত বিজ্ঞানীরা। দিনের পর দিন কৌতূহল নিয়ে এর পেছনে পড়ে থাকত তারা। ব্যাটারি থেকে বের হওয়া বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ দেখার জন্য টিকিট কেটে অডিটরিয়ামে আসত সাধারণ মানুষেরা। আজকের যুগে ব্যাটারি যে অবস্থানে এসেছে তা একদিনে হয়নি। অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে উন্নত হতে হতে এই অবস্থানে এসেছে। তারই কিছু টুকরো ইতিহাস নিয়ে এখানের আলোচনা।

১৭৮৬: লুইগি গ্যালভানি

গ্যালভানির ব্যাটারি আবিষ্কারের ব্যাপারটা বেশ মজার। তিনি জানতেনই না যে তিনি ব্যাটারি আবিষ্কার করেছেন। গ্যালভানি পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। বিভিন্ন প্রাণী কাটাছেরা করা ছিল তার রুটিন মাফিক কাজ। একদিন একটা ব্যাঙ কেটে টেবিলের উপর রেখে দিলেন। ওদিকে তার সহকর্মী একটা ধাতব ছোরা এনে ব্যাঙয়ের গায়ে লাগাতেই কেটে রাখা মৃত ব্যাঙটির পা লাফিয়ে উঠল। এই ঘটনায় গ্যালভানি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেন। নানা রকমের বস্তুকে ব্যাঙয়ের গায়ে ছুঁয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন।

লুই গ্যালভানি; Image Source: AwesomeStories

 

তিনি ধরে নিলেন ব্যাঙয়ের ভেতর কোথাও বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চিত থাকে। ধাতব বস্তু ছোঁয়ানো হলে সেটি মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে, যার কারণে ব্যাঙয়ের পা লাফিয়ে উঠে। তবে এখানে আসলে ঘটছিল অন্য ঘটনা। ব্যাঙটিকে রাখা হয়েছিল একটি ধাতব ক্ষেত্রে। তার উপর রাখা হয়েছিল আরেকটি ধাতু। এক ধাতু থেকে আরেক ধাতুর মধ্যে বিদ্যুতের আদান প্রদান হচ্ছিল। এদের মধ্যে পরিবাহী হিসেবে ছিল ব্যাঙ। ব্যাঙ মরে গেলেও তার পেশীর কোষগুলো সচল ছিল। তাদের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ হতেই সেগুলো নড়াচড়া করে উঠে। এখানে মূলত তৈরি হয়েছিল একটি ব্যাটারি। লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রথম ব্যাটারিটি তিনিই তৈরি করেন, অথচ এর সম্বন্ধে নিজেই জানতেন না।

ভিডিওতে দেখুন- বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃত ব্যাঙয়ের পা নড়াচড়া করে।

১৮০০: আলেসান্দ্রো ভোল্টা

ব্যাটারি বলতে সত্যিকার অর্থে যা বোঝায় সেটি সর্বপ্রথম তৈরি করেছিলেন আলেসান্দ্রো ভোল্টা। তার তৈরি করা ব্যাটারিটি অনেকটা এরকম- কতগুলো তামার পাত ও দস্তার পাত নেয়া হল। কার্ডবোর্ড কিংবা কাপড় দিয়ে এগুলোকে পরস্পর আলাদা করে রাখা। সেগুলো ডোবানো থাকে লবণের দ্রবণে। বর্তনী সংযোগ দিলে তাদের মধ্যে বিদ্যুতের প্রবাহ শুরু হয়। তবে ব্যবহারিক কাজের জন্য এই ব্যাটারি খুব একটা উপযোগী নয়। কাজ করে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তার উপর তামার পাতে হাইড্রোজেনের বুদবুদ জমে গিয়ে পাতের পরিবাহিতা কমিয়ে দেয়। একপর্যায়ে সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়।

আলেসান্দ্রো ভোল্টা (১৭৪৫-১৮২৭); Image Source: Time

উল্লেখ্য লুইগি গ্যালভানির কাজ নিয়েও তিনি গবেষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন গ্যালভানির বন্ধু ও শিস্য। তিনি প্রথমে গ্যালভানির ধারণাকে মেনেও নিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর এই ধারণা থেকে ফিরে আসেন।

১৮২০: ড্যানিয়েল সেল

ভোল্টার তৈরি করা ব্যাটারির স্থায়িত্ব কম হওয়ায় সেটি ব্যবহারিকভাবে মানুষের তেমন কাজে আসেনি। কিন্তু প্রয়োজন ঠিকই আছে মানুষের মাঝে। সে লক্ষ্যে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন এফ ড্যানিয়েল নতুন ধরনের একটি ব্যাটারি তৈরি করেন। এটি ভোল্টার ব্যাটারি থেকে বেশি স্থায়ী। সেখানে কপার সালফেট ও জিংক সালফেটের তড়িৎদ্বার ব্যবহার করা হয়। এর নাম দেয়া হল ড্যানিয়েল সেল। স্থায়িত্ব বেশি হওয়াতে এটি বাসাবাড়ির টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, ডোরবেল ইত্যাদিতে ব্যবহার হতে লাগল। মানুষের ব্যবহারিক কাজে লাগলেই না কেবল একটি আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের প্রকৃত মাহাত্ম্য বোঝা যায়। ড্যানিয়েল সেল পরবর্তী ১০০ বছর পর্যন্ত মানুষের মাঝে স্থান দখল করে ছিল।

ড্যানিয়েল সেলের সরল রূপ; Image Source: Wikimedia Commons

১৮৫৯: রিচার্জেবল ব্যাটারি

এই পর্যায়ের আগে যত ব্যাটারি উদ্ভাবিত হয়েছে তাদের সবগুলোই ছিল একমুখী। ব্যাটারির ভেতরে যে উপাদান আছে সেগুলো বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহার হয়ে গেলে সেগুলোকে পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। ক্যামেলি আলফোনস ফাউর নামে একজন বিজ্ঞানী এমন একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন যেখানে ব্যাটারিকে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ রিচার্জ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। এতে তিনি ব্যবহার করেন লেড ও এসিড। এ ধরনের ব্যাটারি পরবর্তীতে ট্রেনে ও গাড়িতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়।

লেড এসিড ব্যাটারির বর্তমান রূপ; Image Source: B&H

১৯৪৯: অ্যালকালাইন ব্যাটারি

১৯৫০ সাল পর্যন্ত জিংক-কার্বন ব্যাটারি ব্যবহৃত হতো সকল ক্ষেত্রে। কিন্তু ব্যবহারের চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় এর আয়ু ছিল অনেক কম। যা ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের মনে অসন্তোষ নিয়ে আসে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসে একটি ব্যাটারি কোম্পানি। এভ্রিডে ব্যাটারি কোম্পানি এই দিকটি উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দেয় লুইস ইউরি নামে এক বিজ্ঞানীকে। তিনি এই কাজটি বেশ ভালভাবেই সম্পন্ন করেন। এর মাঝে তিনি অ্যালকালাইন ব্যবহার করলেন এবং দেখলেন এটি প্রচলিত জিংক-কার্বন ব্যাটারির চেয়ে প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকেই ভালো ফলাফল দেয়।

অ্যালকালাইন ব্যাটারির বর্তমান রূপ; Image Source: Sportsman’s Guide

১৯৫৪: সৌর কোষ

সূর্যে প্রচুর শক্তি আছে। চেষ্টা করলে সেসব শক্তি মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহার করতে পারে। তার জন্য দরকার শুধু উপযুক্ত ব্যবস্থা। সৌর কোষ এমনই একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সৌরশক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সৌর কোষে কয়েক স্তরে সজ্জিত সিলিকনের স্ট্রিপ থাকে। এই স্ট্রিপগুলো সূর্যের আলোর প্রভাবে ইলেকট্রন ও হোল তৈরির মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করে। ব্যাটারির চমৎকার এই প্রযুক্তিটি ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে বাজারে আসে।

একটি সৌর কোষ; Image Source: Bauratgeber-Deutschland

১৯১২: লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি

লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ইতিহাসটা বেশ পুরনো। ১৯১২ সালের দিকে গিলবার্ট নিউটন লুইস লিথিয়াম ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু তখন সেটি বাণিজ্যিকভাবে লভ্য হয়নি এবং একটা সময় পর এটি চাপা পড়ে যায়। পরবর্তীতে এই প্রযুক্তির কথা নতুন করে অনুভব করে গবেষকরা। কয়েক দশক ধরে কয়েক ধাপে উন্নয়নের পর জাপানের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সনি ১৯৯১ সালে রিচার্জযোগ্য লিথিয়াম ব্যাটারি বাজারে আনে। ধীরে ধীরে এই ব্যাটারি এখন মোবাইল, ক্যামেরা, ল্যাপটপ সহ গুরুত্বপূর্ণ সব প্রযুক্তি পণ্যে আধিপত্য বিস্তার করছে।

মোবাইলে ব্যবহৃত লিথিয়াম আয়নের ব্যাটারি; Image Source: Pixel Ballads

বিশেষ: বাগদাদ ব্যাটারি

বাগদাদ ব্যাটারি ঠিক ব্যাটারি কিনা সে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেক অনেক আগের নমুনা বিধায় নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন। যদি ব্যাটারি হয়ে থাকে তাহলে এটিই ব্যাটারির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা।

১৯৩৮ সালের ইরাক। মাটি খুড়তে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেলেন গোলকধাঁধাময় এক পাত্র। পাত্রের ভেতরে একটি লোহার পাত ঢুকানো এবং চারপাশে অন্য কোনো বস্তু থাকার জন্য ফাঁকা জায়গা। অনেকটা ব্যাটারির কোষের মতো। হিসেব করে জানা গেল এটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে।

বাগদাদ ব্যাটারির নমুনা; Image Source: may.tistory.com

এত আগেকার মানুষ ব্যাটারির মতো কোনোকিছু তৈরি করেছিল? করলে কী কাজের জন্য করেছিল? নাকি ব্যাটারি ছাড়া, ভিন্ন কোনো কারণে এই গঠন তৈরি করেছে? এর উত্তর এখন আর সহজে বলা সম্ভব নয়। দিনে দিলে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে। যদি সত্যিই এটি ব্যাটারি হয় তাহলে সে কালের মানুষদের নিয়ে আমাদের ধারণা পালটে ফেলতে হবে পুরোপুরি।

ফিচার ছবি- PinsDaddy

Related Articles