Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কীভাবে কাজ করে মানবদেহের হরমোন ব্যবস্থা?

আপনার আশেপাশের কোনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীকে ‘ইনসুলিন’ ব্যবহার করতে দেখেছেন? ফুটবলের ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল মেসির উচ্চতা সাধারণের তুলনায় কম কেন তা জানতে চেয়েছেন? কিংবা কুকুর আপনাকে ধাওয়া করলে কেন আপনি সাধারণের চেয়ে অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারেন অথবা পরীক্ষার হলে হাত-পা কেন ঘামতে শুরু করে জানতে ইচ্ছে হয়েছে?

এই সবগুলো ঘটনার পিছনেই লুকিয়ে আছে হরমোনের কারসাজি। ডায়াবেটিসের পেছনে দায়ী হরমোন ইনসুলিন কিংবা মেসির শৈশবে থাকা গ্রোথ হরমোনের জটিলতা থেকে শুরু করে আমাদের ভালোলাগা, মনের অবস্থা পরিবর্তন, সাময়িক উত্তেজনা কিংবা প্রজননে অংশ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজের সাথেই জড়িয়ে আছে হরমোন।

হরমোন হলো আমাদের শরীরে থাকা এক রাসায়নিক দূত। আমাদের দেহের নির্দিষ্ট কিছু অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোতে তৈরি হয় এই হরমোন। এই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই হরমোন তৈরি করে রক্তে নিঃসরণ করে। রক্তের মাধ্যমেই হরমোন পরিবাহিত হয়ে উৎপত্তিস্থল থেকে অনেক দূরেও তার কাজটি করতে পারে।

মানবদেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলো; Image source: pixfeeds.com

মাত্র তের বছর শিশু লিওনেল মেসির দেখা দিয়েছিলো ‘হিউম্যান গ্রোথ হরমোন’ নামক একধরনের হরমোনজনিত সমস্যা। এই হরমোন তৈরি হয় মস্তিষ্কের পিটুইটারি নামক গ্রন্থিতে। তৈরি হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। সেই অঙ্গগুলোতে এই হরমোনকে গ্রহণ করার জন্য থাকে বিশেষায়িত ব্যবস্থা। রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে গ্রোথ হরমোন আমাদের পেশি, অস্থি আর যকৃতে পৌঁছে যায়।

‘হিউম্যান গ্রোথ হরমোন’ এবং এর কাজ; Image source: commons.wikimedia.org

এই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্রের বার্তা প্রেরণের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি মূলত তিনটি উপাদানের উপর কাজ করে। প্রথম উপাদানটি হলো মানবদেহের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রন্থি। দ্বিতীয় উপাদানটি হলো এই গ্রন্থিগুলো থেকে তৈরি হওয়া হরমোন। আর তৃতীয় উপাদানটি হলো যে অঙ্গে হরমোনটি কাজ করবে সেই অঙ্গে থাকা গ্রাহক উপাদান। রক্তের মধ্য দিয়ে হরমোন প্রবাহিত হয়ে গ্রাহক উপাদানের বা রিসেপ্টরের মাধ্যমেই তার প্রত্যাশিত অঙ্গ কিংবা কোষটিকে খুঁজে পায়।

হরমোন ব্যবস্থার মূল তিনটি উপাদান; Image source: ed.ted.com

অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর নিজেদের কোনো প্রবাহ নালিকা নেই। তাই রক্তের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট কোষে পরিবাহিত হয়। রক্ত সারাদেহে অক্সিজেন, খাদ্যের সারাংশের পাশাপাশি হরমোনও পরিবহন করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ঐ নির্দিষ্ট কোষে থাকা গ্রাহক উপাদানের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ মানবদেহের লক্ষ-কোটি কোষের মধ্য থেকে ঠিক কার কাছে ঐ হরমোনটি পৌঁছে দিতে হবে তা নির্ধারিত হয় এই গ্রাহকের মাধ্যমেই। যদি কোনো কারণে গ্রাহকটি ঠিকঠাক কাজ না করে, তাহলেও দেখা দিতে পারে হরমোনজনিত জটিলতা।

গ্রাহকের মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে হরমোন; Image source: ed.ted.com

১৯০৫ সালের জুন মাসে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের শরীরবিদ্যার অধ্যাপক আরনেস্ট স্টারলিং সর্বপ্রথম ‘হরমোন’ শব্দটি তার লেকচারে ব্যবহার করেন। গ্রিক ‘hormōn’ শব্দ থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্টারলিং যখন হরমোন নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখনো এর ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানা ছিলো না শরীরতত্ত্ববিদদের। হরমোনের ব্যাপারে প্রচলিত এবং যৎসামান্য গবেষণালব্ধ তথ্য ছিলো। রাসায়নিকভাবে এই হরমোন আসলে কী ধরনের পদার্থ তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা শুরু হয়ে যায়।

হরমোন শব্দটির উৎপত্তির বছর বিশেকের মাথায় এডওয়ার্ড কেলভিন কেন্ডেল নামে এক গবেষক দু’ধরনের হরমোনকে রক্ত থেকে বিশুদ্ধ করে এর রাসায়নিক ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এর একটি ছিলো ‘কর্টিসোন’, যেটি একটি স্টেরয়েড জাতীয় রাসায়নিক। আরেকটি ‘থাইরক্সিন’। থাইরক্সিন একধরনের পরিবর্তিত অ্যামিনো অ্যাসিড। ১৯২৬ সালে স্যার চার্লস হ্যারিংটন তার গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে থাইরক্সিন তৈরি করেন। এই থাইরক্সিন হরমোন আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে সেটিকে অক্সিজেন ব্যবহারে উদ্দীপ্ত করে এবং সেটির বিপাকে সহায়তা করে। 

আমাদের মানসিক অবস্থা নির্ধারণে কাজ করে যারা; Image source: imgur.com

ধীরে ধীরে হরমোন নিয়ে গবেষণা যত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো, ততই উদঘাটিত হওয়া শুরু করলো বিস্ময়কর সব তথ্য। আমাদের মনোজাগতিক নানা পরিবর্তনের সাথে হরমোন জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। আমাদের ভালো লাগা, ভালোবাসা, উত্তেজনা কিংবা মন খারাপের জন্যও দায়ী অনেক হরমোন। ডোপামিন, সেরাটোনিন আর অক্সিটোসিন এর মধ্যে অন্যতম।

কোনো কাজের প্রত্যাশামাফিক ফল পাওয়ার পরে আমাদের যে চরম আনন্দের অনুভূতি হয় তার জন্য দায়ী ডোপামিন। কোনো কাজে সফলতা অর্জনের পরে এই ডোপামিন নিঃসরণ অনেকটা মানসিক পুরষ্কারের মতোই কাজ করে। তাই কঠিন সমস্যা সমাধানের পরের মানসিক শান্তির সাথে দুনিয়ার অন্যকিছুকে তুলনা করা মুশকিল। তবে কোকেইনের মতো কিছু নেশাজাতীয় দ্রব্য মানুষকে কৃত্রিমভাবে ডোপামিন নিসঃরণের স্বাদ দেয়। এ কারণেই কোকেইনে ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি একবার অভ্যস্থ হয়ে গেলে তা ছেড়ে আসা মুশকিল।

এবার আসা যাক অক্সিটোসিনের কথায়। অক্সিটোসিন মানুষের বন্ধুত্ব এবং আবেগের সাথে জড়িত। বন্ধু কিংবা ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকাকালীন সময়ে দেহে অক্সিটোসিনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। দীর্ঘদিন পরে কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হলেও এই হরমোন নিঃসরিত হয়। ২০০৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়িতে ফিরে কুকুরকে জড়িয়ে ধরার সময়েও কুকুর এবং মানুষের অক্সিটোসিনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। এতে বোঝা যায়, আমাদের মানসিক এবং আবেগঘটিত সম্পর্কগুলোতে অক্সিটোসিন হরমোনের গুরুত্ব অনেক। 

উচ্চমাত্রার সেরোটোনিন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আর আবেগের সঞ্চার ঘটায়। পাশাপাশি আমাদের মনোজাগতিক অবস্থার ভালো-মন্দ নির্ধারণে সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন আর ডোপামিনের গুরুত্ব অনেক। এদেরকে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। 

মানুষের বয়ঃসন্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথেও জড়িত আছে হরমোন। বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের প্রজনন অঙ্গগুলোর পরিপূর্ণতা প্রাপ্তিতে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে এই রাসায়নিক বার্তাবাহকেরা। হরমোনের তারতম্যের কারণে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি অনেক দ্রুত হয়। সন্তান জন্মদান আর প্রজননেও অংশ নিতে ভূমিকা রাখে অনেক হরমোন।

যদি হরমোন নিঃসরণ কিংবা তৈরিতে সমস্যা সৃষ্টি হয় তাহলে দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা। এর মধ্যে ডায়াবেটিস সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। সারাবিশ্বে শত-সহস্র মানুষ ডায়াবেটিসজনিত সমস্যায় ভুগে থাকে ইনসুলিন নামক হরমোনের জটিলতার কারণে। মানবদেহ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ইন্সুলিন তৈরি করতে না পারে কিংবা কোষগুলো যদি ইনসুলিন গ্রহণে অক্ষম হয়, তাহলে এই সমস্যা দেখা দেয়। 

তবে ডায়াবেটিসই একমাত্র হরমোনজনিত সমস্যা নয়। এড্রিনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন নামে একধরনের হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে হয়ে থাকে ‘কুশিং রোগ’। এই রোগটি নারীদের মধ্যেই বেশী দেখা যায়। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, দেহে অতিরিক্ত পরিমাণ পশম, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি। 

মানুষের বৃদ্ধির সাথে জড়িত হরমোনের সংকট হলে মানুষ খর্বাকার হয়, ফুটবলার লিওনেল মেসির শৈশবে যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু বৃদ্ধির সাথে জড়িত হরমোনগুলো অত্যাধিক মাত্রায় নিঃসরিত হলেও দেখা দেয় সমস্যা। উচ্চমাত্রার বৃদ্ধি হরমোনের কারণে দেখা দেয় ‘এক্রোমেগালি’। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাত, পা, কপাল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বড় হয়ে থাকে। এছাড়াও এদের উচ্চতাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, উচ্চ রক্তচাপ, পেশি দুর্বলতাসহ নানা ধরনের সমস্যা।

তবে ডায়াবেটিস, কুশিং রোগ কিংবা এক্রোমেগালিতেই হরমোনজনিত জটিলতা সীমাবদ্ধ নেই। পরিমাণের অধিক কিংবা বেশি হরমোন নিঃসরণের ফলে মানবদেহে দেখা দেয় নানা ধরনের জটিলতা। এমনকি আমাদের মনের ভালো-মন্দের অনেকটাই নির্ধারিত হয় এই হরমোনের সরাসরি প্রভাবের ফলে। হরমোনের তারতম্যের কারণে অনেকের মধ্যেই দেখা যায় ‘বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার’।

এক্রোমেগালিতে আক্রান্ত এক নারী তার পরিবারের সাথে; Image source: SCIENCE PHOTO LIBRARY

হরমোনের কার্যকলাপ নিয়ে জানার পর তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে, হরমোন কি তাহলে মানুষের আচার-আচরণ, ভালো-মন্দ থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে? আসলে এই ব্যাপারটি মোটেও সত্য নয়। আমাদের হরমোন ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে মূলত আমাদের দেহের কার্যকলাপকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার নিমিত্তে।

দেহের কার্যকলাপকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে হরমোন; Image source: ed.ted.com

তবে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, সামাজিক এবং পারিবারিক কিংবা বংশগতির কারণেও হরমোনের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হতে পারে। এর ফলে কোনো গ্রন্থি থেকে প্রয়োজনের চেয়ে কম কিংবা বেশি হরমোন নিঃসরণ হতে পারে। আর এর ফলেই মানবদেহে দেখা দেয় হরমোনজনিত নানা সমস্যা। 

ফিচার ইমেজ: ed.ted.com

Related Articles