Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা ঠিক কতটা ক্ষুদ্র?

১৯৯৫ সালের শীতের কোনো এক রাত, রাতের আকাশের তারাদের মিছিলে লুকিয়ে থাকা রহস্যের সমাধান করতে হাবল টেলিস্কোপের মুখ ফিরিয়ে দেওয়া হলো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ঐ আলোকবিন্দুদের দিকে। সপ্তর্ষি মণ্ডলের কাছাকাছি আকাশের অগণিত তারার থেকে একটু দূরে যেখানে তুলনামূলকভাবে তারার সংখ্যা কম এবং পার্শ্ববর্তী তারাদের কারণে সৃষ্ট আলোক দূষণ কম সেদিকেই ফিরিয়ে দেওয়া টেলিস্কোপটিকে।

হাবল টেলিস্কোপ; Source: spacetelescope.org

অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, হয়তো কিছুই দেখা যাবে না, কিন্তু টানা দশ দিন ধরে ১৫০ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে যে ফলাফল উঠে আসে তা জ্যোর্তিবিদদের বেশ বড়সড় ধাক্কা দেয়। সেই পর্যবেক্ষণে থেকে উঠে আসা ‘ডিপ ফিল্ড ইমেজ’ বিশ্লেষণের পর কম করে হলেও ১,৫০০ আলাদা গ্যালাক্সির অস্তিত্ব পাওয়া যায়!

তবে এই ডিপ ফিল্ড ইমেজগুলো অনেকটা টাইম মেশিনের মতো কাজ করে। কারণ আমাদের মনে হতে পারে এই ডিপ ফিল্ড ইমেজটি গ্যালাক্সিগুলোর তাৎক্ষণিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়, ডিপ ফিল্ড ইমেজ আসলে বিলিয়নখানেক বছর আগে এই গ্যালাক্সিগুলো কেমন ছিলো তা দেখতে পাই। একই কথা আমাদের চোখের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই আমরা আসলে অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শুধু এই ডিপ ফিল্ড ইমেজেই থেমে যাননি। এই ছবি নেওয়ার এক দশকের মাথায় মহাকাশকে আরো ভালোভাবে জানবার লক্ষ্যে আরো ক্ষমতাশালী টেলিস্কোপকে মহাকাশের দিকে তাক করেছিলেন। চার মাস ধরে টেলস্কোপিক বিশ্লেষণের পরে জ্যোতির্বিদদের হাতে আসে ‘এক্সট্রিম ডিপ ফিল্ড ইমেজ’। এই ছবিতে দৃশ্যমান হয় প্রায় দশ হাজার গ্যালাক্সি। অনেক বছর ধরে নেওয়া ডিপ ফিল্ড ইমেজগুলো মানুষকে মহাবিশ্বের বিশালত্ব সম্পর্কে অনেকগুণ সচেতন করে তুলেছে।

‘এক্সট্রিম ডিপ ফিল্ড ইমেজের ফলাফল মানুষকে করেছে হতভম্ব; Source: ed.ted.com  

সাধারণ একটি তুলনার জন্য বলে নেওয়া যেতে পারে, সৌরজগত ‘মিল্কিওয়ে’ বা ‘আকাশগঙ্গা’ নামক মাঝারি সাইজের একটি গ্যালাক্সির অতি ক্ষুদ্র অংশ। মাঝারি সাইজের এই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতে কম করে হলেও ১০০-৪০০ বিলিয়ন তারার বসবাস!

শুরুতে বিশ্লেষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিলো অতি ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল; Source: ed.ted.com

আকাশের বুকে একটি বলপয়েন্ট কলম ধরলে, এর ঠিক অগ্রভাগে যতদূর জায়গা দখল করে থাকে ঠিক ততটুকু জায়গাকেই শুরুতে বিশ্লেষণ করেছিলো হাবল টেলিস্কোপ। বিশাল মহাকাশের দুই মিলিয়ন ভাগের একভাগ হিসেবে ধরে নেওয়া এই ক্ষুদ্র জায়গাটিতেই আছে হাজারখানেক গ্যালাক্সি। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখা যাক, তাহলে পুরো মহাকাশজুড়ে কী পরিমাণ গ্যালাক্সি আছে?

অতি ক্ষুদ্র এলাকায় দেখা মিলেছে হাজারখানেক গ্যালাক্সির; Source: ed.ted.com

তের বিলিয়ন বছরের চেয়ে অধিক সময় পার করে আসা এই মহবিশ্বের মাত্র তিরানব্বই বিলিয়ন আলোকবর্ষ এলাকাকেই পর্যবক্ষেণযোগ্য মনে করা হয়।  জ্যোতির্বিদদের ধারণা, এর বাইরেও বিশাল এলাকা থাকতে পারে, যা পর্যবেক্ষণ করা আপাতত সম্ভব নয়। আর তাই বিশাল বিস্তৃত বিশ্বের ভাগ্যে জুটেছে ‘অসীম’ উপাধি। আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব এলাকায়ই আছে তিনশত সেক্সট্রিলিয়ন তারা। একের পরে একুশটি শূন্য দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটিই ‘এক সেক্সট্রিলিয়ন’। তাই আমাদের মহাবিশ্ব যে কত বিশাল তা অনুধাবন করতেই আরেকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, এই মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা ঠিক কতটা ক্ষুদ্র, আমরা কি আসলেই এই মহাবিশ্বের উল্লেখযোগ্য কোনো অংশ?

কাগজে কলমে হিসেব করলে আমাদের ক্ষুদ্রতার ব্যপারটি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়ানো মানুষের গড় উচ্চতা প্রায় ১.৭ মিটার। আর পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ১২,৭০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। তাই এই পৃথিবীর ব্যাসের এই দূরত্বের সাথে তুলনা করতেই প্রায় ৭৫ লক্ষ গড় উচ্চতার মানুষ দরকার।

মানুষের গড় উচ্চতা প্রায় ১.৭ মিটার; Source: ed.ted.com

যাকে কেন্দ্র করে আমাদের এই পৃথিবী ঘুরছে সেই মাঝারি আকারের নক্ষত্র সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১১০ গুণ অর্থাৎ প্রায় ১.৪ মিলিয়ন কিলোমিটারের কাছাকাছি। একধাপ এগিয়ে যদি আকাশগঙ্গার কথা চিন্তা করা যায় তাহলে সেখানে আমাদের সূর্যের মতো আরো প্রায় ১০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। তাহলে আরেকবার সেই ডিপ ফিল্ড ছবিতে ফিরে যাওয়া দরকার যেখানে ১,৫০০ আলাদা গ্যালাক্সির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিলো এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসেবানুযায়ী সেই গ্যালাক্সির প্রত্যেকটিতে গড়ে বিলিয়নখানেক তারা তো আছেই!

আমাদের গ্যালাক্সি, ‘আকাশগঙ্গা’; Source: ed.ted.com

বিশাল এই মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগত কিংবা গ্রহ তো দূরে থাক, আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গাকে নস্যির কৌটার সাথে তুলনা দিতেও ভয় পান জ্যোতির্বিদেরা। আর আমাদের অপরিসীম এই  ক্ষুদ্রত্ব পীড়া দিয়েছে বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক কিংবা দার্শনিক সবাইকে।

বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগানের মতে, “মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থা অনেকটা সকালের আকাশে উড়তে থাকা ধুলিকণার মতোই।” তের বিলিয়ন বছরেরও অধিক সময় পার করে আসা এই মহাবিশ্বে মানুষকে সাধারণ একটি রাসায়নিক যন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেন না সদ্যপ্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, তার মতে মানুষের শত কোটি গ্যালাক্সির এক কোণে আমাদের এই আমার এই সৌরজগত মোটেও উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু নয়!

তাই রাতের আকাশে অসংখ্য তারা দেখে আবেগে উদ্বেলিত হওয়ার পাশাপাশি এটি মানুষকে দিয়েছে চিন্তার খোরাক। মানুষের ক্ষুদ্রত্ব নিয়েও চিন্তার সুত্রপাত ঠিক সেখান থেকেই। প্রখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ প্যাসকেল এই নিয়ে বলেছিলেন, “যখন আমি আমার জীবনের ক্ষুদ্র সময়ের কথা চিন্তা করি, তা যেন মহাকালের গভীরে হারিয়ে যায়। মহাবিশ্বের বিশালত্বের মধ্যে আমার এবং পুরো মানবজাতির স্থানটি যেন কিছুই না। বিশাল মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা তো কিছুই জানি না, মহাবিশ্বের এই অধরা নীরবতা আমাকে পীড়া দেয়।”

মহাবিশ্বের আর কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কিনা সেই ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কারণ কী? আমরা কি মহাজগতিক একাকীত্বে আক্রান্ত হয়েই বুদ্ধিমান কাউকে খুঁজি? উপন্যাসিক জোসেফ কনরাড আমাদের এই একাকীত্বের অনুভূতির নাম দিয়েছেন ‘awful loneliness’ হিসেবে। রাতের আকাশের লক্ষ কোটি জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা আর মহাবিশ্বের বিশালত্ব নিয়ে আমাদের চিন্তা এই নিদারুণ একাকীত্বকে বারবার উসকে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নানাধরনের তরঙ্গ আর সংকেত পাঠিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, সৌরজগতের বিশাল অংশ চষে বেড়িয়েছেন কিন্ত আমাদের নিদারুণ একাকীত্ব কাটেনি। এখনো পর্যন্ত সৌরজগতে মানুষই একমাত্র বুদ্ধিমান এই তথ্য আমাদের যতটা না স্বস্তি দিয়েছে তার চেয়ে হয়তো বেশি একা করে দিয়েছে। যদিও সৌরজগত তো বটেই তার বাইরেও পুরোদমে প্রাণের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন  জ্যোতির্বিদরা।

এই ধারণার বিপরীতেও যুক্তি কম নয়। বারট্রান্ড রাসেল নামক প্রখ্যাত দার্শনিকের মতে, আকার-আকৃতির বন্দনা নিতান্তই অর্থহীন। স্যার আইজ্যাক নিউটন তো অতিকায় জলহস্তীর চেয়ে অনেকগুণ ছোট ছিলেন, কিন্তু তাই বলে তার গুরুত্ব কি মানব সমাজে কমে গেছে। রাসেলের মতে, ঠিক একই যুক্তিতে মহাজাগতিক স্কেলে আমাদের আকৃতি আমাদের মধ্যে হীনমন্যতার জন্ম দিতে পারে না, কারণ এই আকার-আকৃতি শুধুই একটি রুপক। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যেই বিশালাকৃতির বস্তুর জন্য একধরনের অদ্ভুত ভালোবাসা বাস করে। এ কারণেই হয়তো আমরা বিশালাকার দালানকোঠা নির্মাণে অধিকতর আগ্রহী। তবে দিনশেষে আপনাকে যখন বিশাল খড়ের গাদা আর একটি ডায়মন্ডের আংটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হবে, আপনি অবধারিতভাবেই অতি ক্ষুদ্র ডায়মন্ডের আংটিই বেছে নিবেন। তাই মহাজাগতিক মাপকাঠিতে আমরা যতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রই হই না কেন, আমাদের গুরুত্ব মোটেই কম নয়!

Feature image: ed.ted.com

Related Articles