মহাকাশের বিচিত্র অনবদ্য ছবি দেখে মুগ্ধ হয় না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকুক বা না থাকুক, মহাকাশের এসব চিত্তাকর্ষক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে সত্যিই পারা যায় না। আজ কথা হবে মহাকাশের এসব হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ধারণের পেছনের যন্ত্রটি নিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য নামটি নিঃসন্দেহে অতি পরিচিত। চমকপ্রদ এই যন্ত্রের নাম 'হাবল টেলিস্কোপ'। এই টেলিস্কোপ গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথের দৃশ্য ধারণ করে থাকে। হাবল টেলিস্কোপ নক্ষত্রের জন্ম হতে দেখেছে, নক্ষত্রকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে, বহু দূরবর্তী ছায়াপথের দৃশ্য মুঠোয় এনে দিয়েছে, ধূমকেতুকে খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে দেখেছে, এবং সেই সাথে আরও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে।
তবে এর নিজের ইতিহাসটা কী? কীভাবে উদ্ভাবিত হয়েছিল এই টেলিস্কোপ? কীভাবেই বা এটি ধারণ করে থাকে সুদূর মহাকাশের বিচিত্র চিত্র? আজকে সেই গল্পটাও আপনাদের জানানো হবে।
এর ভিত্তি মূলত গড়ে তুলেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও। অনেকেই নিশ্চয়ই গ্যালিলিওর স্পাইগ্লাসের কথা শুনে থাকবেন। স্পাইগ্লাসের উদ্ভাবক গ্যালিলিও না হলেও এর কার্যক্রমের উন্নতিসাধন ও ব্যবহারে তার অবদান কম নয়। সহজ ভাষায়, স্পাইগ্লাস এমন একটি যন্ত্র, যা দূরবর্তী বস্তুকে কাছে থেকে দেখতে সহায়তা করে। ১৬১০ সালের দিকে গ্যালিলিও যখন স্পাইগ্লাস নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন তিনি শনির বলয়ের চিত্র টেলিস্কোপে ধরতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন।
অপটিকসের উন্নতির সাথে সাথে ধীরে ধীরে গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্রধারণেরও উন্নতি ঘটে। কিন্তু বহুদিন ধরে একটি সমস্যা থেকে যায়। আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে, তা মহাকাশ থেকে আগত আলোকে বাধা দেয়ার কারণে সুনিপুণভাবে চিত্রধারণ সম্ভব হচ্ছিল না। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি টেলিস্কোপ, যা ভূমিতে অবস্থিত টেলিস্কোপগুলোর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম। ১৯৬৪ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর, জ্যোতির্বিদ লাইম্যান স্পিটজার এমন একটি টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের প্রস্তাবনা দেন। তবে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স থেকে সমর্থন পেতে এ প্রস্তাবনার কয়েক দশকের মতো সময় লেগে যায়। ১৯৬৯ সালে সংস্থাটি স্পেস টেলিস্কোপের রূপরেখা প্রদান করে এবং এর নির্মাণের নির্দেশনা দেয়।
এদিকে আমাদের অতি সুপরিচিত সংস্থা নাসা থেকেও এর জন্য পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। অবশেষে ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের প্রশাসক জর্জ ল স্পেস টেলিস্কোপ টিমকে প্রস্তাবনার বাস্তবায়নের জন্য অনুমতি দেন এবং নাসা শীঘ্রই এ প্রচেষ্টার জন্য অর্থ তহবিলের তদবির করে। এ ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথমদিকে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও কংগ্রেসের প্রচেষ্টায় আর্থিক সংকটের সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। কিন্তু সমস্যা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। ১৯৮৬ সালে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাতজন নভোচারীর মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার কারণে টেলিস্কোপের প্রকল্প আরও পিছিয়ে পড়ে। কেননা, শাটল ফ্লাইট আবার শুরু না করা পর্যন্ত টেলিস্কোপের প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে স্পেস শাটলের উদ্ভাবনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল, পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্পেস টেলিস্কোপের অবতারণা হয়।
যা-ই হোক, প্রথম প্রচেষ্টাতেই কিন্তু মহাকাশের নিখুঁত চিত্রধারণ করা যায়নি। যন্ত্রপাতির বিভিন্ন ত্রুটির কারণে ধারণকৃত ছবিগুলো ছিল ঝাপসা। এর পেছনে মূল কারণ ছিল লেন্সের ত্রুটি। ১৯৯৩ সালে স্পেস শাটল সাতজনের একটি দলকে এ সমস্যা দূর করার জন্য পাঁচদিনের একটি মহাকাশযাত্রায় পাঠায়। এ সময় ওয়াইল্ড ফিল্ড প্ল্যানেটরি-২ সহ আরও দুটি নতুন ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে হাবল টেলিস্কোপ থেকে নতুন ছবি তোলা হয়, যেগুলো ছিল অত্যন্ত নিখুঁত ও চমকপ্রদ। এরপর থেকে সৌরজগতের বিভিন্ন চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে হাবল টেলিস্কোপ।
হাবল টেলিস্কোপ ভূমিতে অবস্থিত অন্যান্য টেলিস্কোপের থেকে আলাদা নানা কারণেই। টেলিস্কোপটি দৈর্ঘ্যে প্রায় একটি স্কুল বাসের মতো, এবং ওজনে প্রায় দুটি হাতির সমতুল্য! বায়ুমণ্ডলের বাধাকে অতিক্রম করে এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে আবর্তন করতে সক্ষম। একটি ডিজিটাল ক্যামেরার মাধ্যমে এই টেলিস্কোপ চিত্র ধারণ করে। পরে রেডিও কম্পাঙ্কের মাধ্যমে এসব চিত্র পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়।
এডউইন হাবল
প্রকৃতপক্ষে হাবল টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়েছে একজন ব্যক্তির নামে। তাহলে নিশ্চয়ই এমন কারও নামে করা হয়েছে, যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোনো বিশাল অবদান রেখে গিয়েছিলেন? ঠিক তা-ই। এর নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবলের নামানুসারে। হাবলকে আধুনিক কসমোলজির জনক বলা হয়। একসময় এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে, আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ 'মিল্কিওয়ে’ ব্যতীত অন্য কোনো ছায়াপথের অস্তিত্ব নেই। মহাকাশের নেবুলাকে সুনিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করে হাবল এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি দেখিয়েছেন, মহাকাশ আমাদের কল্পনার চেয়েও বহু দূর বিস্তৃত।
আফসোসের ব্যাপার এ-ই যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশাল অবদান রাখার পরও তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেননি। তবে মহাকাশের বিচিত্র চিত্র ধারণকারী যন্ত্রটি আজ এডউইন হাবলের নামানুসারে উচ্চারিত হচ্ছে, এখানেই তার বিরাট সার্থকতা।
যেভাবে কাজ করে হাবল
হাবল টেলিস্কোপের নির্মাণের ইতিহাস তো জানা হলো। এখন পাঠকের নিশ্চয়ই জানার কৌতূহল হচ্ছে, কীভাবে এই টেলিস্কোপ কাজ করে? যারা জটিল বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র দেখলে ঘাবড়ে যান, তাদের ভয় পাবার কিছু নেই। এখানে মূলত টেলিস্কোপের প্রাথমিক কার্যকলাপ নিয়েই আলোচনা করা হবে।
প্রতি ৯৭ মিনিটে হাবল টেলিস্কোপ চার কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে পৃথিবীকে একবার আবর্তন সম্পন্ন করে, যা ১০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রকে একবার প্রদক্ষিণ করার সমতুল্য। এই টেলিস্কোপ মূলত সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত। ঘূর্ণনের সময় টেলিস্কোপটির দর্পণ আলো ধারণ করে এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে তড়িৎরূপে এই আলো প্রেরণ করে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক দর্পণে আলো আঘাত করে, যা পরবর্তী দর্পণে বাধা পেয়ে একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে এ আলোকে প্রেরণ করে। প্রতিটি যন্ত্রই ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য নিযুক্ত।
যন্ত্রপাতি
১) ওয়াইল্ড ফিল্ড ক্যামেরা: অতিবেগুনী, দৃশ্যমান এবং অবলোহিত রশ্মির অঞ্চলের আলো দেখতে পায়। ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার, নক্ষত্রের জন্ম, ছায়াপথ গবেষণায় সহায়তা করে।
২) কসমিক অরিজিন্স স্পেকটোগ্রাফস: অতিবেগুনী রশ্মি শনাক্ত করতে পারে; প্রিজমের ন্যায় আচরণ করে ভিন্ন ভিন্ন আলো শনাক্ত করতে পারে।
৩) অ্যাডভান্সড ক্যামেরা ফর সার্ভে: দৃশ্যমান আলো দেখতে পারে, সৌরজগতের অপেক্ষাকৃত পূর্ববর্তী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে।
৪) স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকটোগ্রাফ: তিন ধরনের আলোই দেখতে পারে এবং ব্ল্যাকহোল গবেষণায় সহায়ক।
৫) নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা অ্যান্ড মাল্টি অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার: হিট সেন্সর হিসেবে কাজ করে। ইন্টারস্টেলার ডাস্ট দিয়ে ঘেরা বস্তু দেখতে সহায়তা করে।
৬) ফাইন গাইডেন্স সেন্টার: মূলত নক্ষত্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং নক্ষত্রের গতি মাপতে সহায়ক।
পৃথিবীতে যেভাবে পৌঁছায় ছবি
একটি অ্যান্টেনার মাধ্যমে এসব তথ্য রেডিও কম্পাঙ্ক আকারে সংগৃহীত হয়। এ কাজে নিযুক্ত প্রকৌশলীরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিস্কোপের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করেন এবং বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এর জন্য মূলত দুটি প্রধান কম্পিউটার নিযুক্ত থাকে। এর মধ্যে একটি নির্দেশনা পরিচালনা করে এবং আরেকটি তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণের কাজ করে থাকে। অর্থাৎ, বিশাল যান্ত্রিক সমন্বয় ও কর্মীদের বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয় এ টেলিস্কোপের কার্যক্রম।
২০০৯ সালে জ্যোতির্বিদরা পঞ্চমবারের মতো হাবল টেলিস্কোপ পরিদর্শনে যাত্রা করেন এবং এতে নতুন যন্ত্রপাতি ও ক্যামেরা স্থাপন করেন। ২০২০ সালে টেলিস্কোপটির বয়স হলো ৩০ বছর, এবং এটি এখনও মহাকাশের চিত্তাকর্ষক চিত্র ধারণ করতে সক্ষম। তবে নাসা 'জেমস ওয়েব' নামের আরও অধিক উন্নতমানের একটি স্পেস টেলিস্কোপ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। সেটি হাবল টেলিস্কোপের স্থান দখল করবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাবল টেলিস্কোপ যে বিশাল অবদান রেখেছে এবং এটি যে মহাকাশ গবেষণায় একটি মাইলফলকের নাম, তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতেই হবে।
This article is in Bengali language. This is about Hubble Telescope, a very important milestone in the history of Astronomy, especially in the sector of Space Science.
References:
1. About the Hubble Space Telescope: NASA
2. What is the Hubble Space Telescope? NASA
Featured image: theconversation.com