Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বসবাসের শহর কি গড়ে দিচ্ছে আপনার ব্যক্তিত্ব?

সবে পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার গোছাতে শুরু করেছে বেলা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু অঞ্জনকে ভালোবাসে সে। দু’জনের পরিবারেই তাদের সম্পর্কের বিষয়টি জানিয়েছে তারা। অঞ্জনের পরিবার থেকে কোনো সমস্যা না থাকলেও বেঁকে বসলো বেলার পরিবার। তাদের আপত্তির প্রধান কারণ অঞ্জনের বাড়ি নোয়াখালি। নিজের জেলা বরিশাল বাদে অন্য কোনো জেলার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা মানতেই পারে না তারা। তাদের মতে, ভিন্ন জেলার মানুষের ভিন্ন আচরণের সাথে মানিয়ে জীবন পার করা সম্ভব নয়। তার উপর নোয়াখালি আর বরিশালের মানুষের চরিত্র উত্তর আর দক্ষিণ মেরু! বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেলেও এই দুই জেলার মানুষের একসাথে বাস করা সম্ভব নয় বলেই তাদের ধারণা।

বেলার পরিবারের মতোই মানসিকতা আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের। নানা বিশেষণে বিশেষিত করে বিভিন্ন জায়গার মানুষের বৈশিষ্ট্যকে সাধারণীকরণ করে ফেলেন অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও। অঞ্চলভিত্তিক প্রচলিত এসব মিথের উৎপত্তিস্থল স্পষ্ট নয়।

তবে কোন জায়গার মানুষ কেমন, অথবা কোন জেলার মানুষকে বিয়ে করবেন, সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। এখানে আমরা জানব কোনো জায়গার ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ আসলেই মানুষের চরিত্রের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে কি না।

ভৌগলিক অবস্থান ও পরিবেশ কি মানুষের চরিত্রে প্রভাব ফেলে? Image Source: Dhaka Tribune

মনোবিজ্ঞানের একটি নবীন শাখা হলো এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজি বা পরিবেশগত মনোবিজ্ঞান। ‘জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজি’-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানুষের সাথে তার আশেপাশের পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে পরিবেশগত মনোবিজ্ঞান। ভৌগোলিক পরিবেশ কীভাবে এবং কেন আমাদের জীবন ও চরিত্রকে প্রভাবিত করে, তার কারণ খোঁজা হয় মনোবিজ্ঞানের এ শাখায়।

বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে এর প্রতিষ্ঠাকাল পুরনো না হলেও এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার স্পেন্সার ও কেট জি এর মতে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ গবেষণার শুরু হয়।

১২৭৮ সালে মার্কো পোলো পশ্চিম এশিয়ার রাজ্যসমূহ ভ্রমণকালে পাশাপাশি দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র কেরমান ও পার্সিয়ার অধিবাসীদের বৈশিষ্ট্যগত বৈপরীত্য লক্ষ করে অবাক হন। কেরমান রাজ্যের স্থানীয় অধিবাসীরা ছিলো ভদ্র, উপকারী, ও শান্তিপ্রিয় মানুষ। অপরদিকে পার্সিয়ানরা ছিলো দুর্নীতিবাজ, বিশ্বাসঘাতক ও খুনে প্রকৃতির।

কেরমান ও পার্সিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে ছিল ব্যাপক বৈশিষ্ট্যগত বৈপরীত্য; Image Source: Getty Images

কেরমানের রাজা তার দরবারের বিজ্ঞদের কাছে এই বৈপরীত্যের কারণ জানতে চান। রাজদরবারের সেই বিজ্ঞদের মতে দুই রাজ্যের আলাদা মাটিই ছিলো মানুষের বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারণ। এই মতবাদ পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে রাজা সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের অঞ্চল এসফাহান থেকে মাটি আনার নির্দেশ দেন কর্মীদের।

ভোজনকক্ষে কার্পেটের নিচে এ মাটি ছড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর যেদিন সে কক্ষে রাজকীয় ভোজের আয়োজন করে সেদিন আমন্ত্রিত অতিথিরা নিজেদের মধ্যে উগ্রভাবে ঝগড়া শুরু করেন। এমনকি মারামারি করে অনেকে আহতও হন। এ ঘটনা থেকে রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আসলে মাটিই সবকিছুর জন্য দায়ী।

কেরমানের সেই রাজার পরীক্ষা কতটুকু নির্ভরযোগ্য, তার কোনো প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিককালে এই পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের ধারণার ভিত্তি করে নানা উল্লেখযোগ্য গবেষণা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার শিগেহিরো ঐশি ও তার সহকর্মীদের এক গবেষণায় মানুষের ভৌগোলিক পরিবেশ ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে লক্ষণীয় সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

ঐশী ও তার দল পাঁচটি ধারাবাহিক পরীক্ষার পর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। গবেষণায় দেখা যায় অন্তর্মুখী ব্যক্তিরা সমুদ্র সৈকতের চেয়ে পার্বত্য অঞ্চলে বেশী সুখী থাকেন। বৃহৎ পরিসরে রাজ্যভেদে এই গবেষণায় অধিবাসীদের ব্যক্তিত্বে পরিলক্ষিত হয় আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। ওয়াশিংটন, আইডাহো, মন্টানার মতো পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের চরিত্র আইওয়া, ওহিও ও মিশিগান অঞ্চলের মতো সমতলভূমির অধিবাসীদের চেয়ে বেশি অন্তর্মুখী।

অন্তর্মুখী ব্যক্তিরা পার্বত্য অঞ্চলে বেশি সুখী থাকেন; Image Source: Bdprimeit

আকর্ষণীয় এই গবেষণার ফল থেকে ধারণা করা হয়, যে ভূখণ্ডে আমরা বাস করি এবং তার পরিবেশ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করি, সেগুলো আমাদের বিশ্বাস, চেতনায় প্রভাব বিস্তার করে। তবে গবেষকরা তখনও একটি বিষয় নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না যে ভৌগোলিক পরিবেশ তার প্রভাব দ্বারা মানুষের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তন করতে সম্ভব, নাকি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মানুষেরাই তাদের উপযোগী ভৌগোলিক পরিবেশ বেছে নেয় বসবাস করার জন্য।

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এই প্রশ্নের উত্তর জানতে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা করেন। ওই পরীক্ষায় তারা একদল ব্যক্তিকে দু’টি ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে যান। প্রথমে একটি নির্জন গাছগাছালি ঘেরা বাড়ি ও পরে একটি খোলা স্থানে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। উভয় স্থানে তারা দলগত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। স্থানভেদে আলোচনায় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও প্রতিক্রিয়ার মাত্রা থেকে তাদের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন লক্ষ করা হয়।

এ পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, স্থানের প্রভাব অনুসারে মানুষের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের হার খুবই সামান্য। এতে বোঝা যায়, একটি নির্দিষ্ট স্থান, সাময়িক অবস্থান ও স্বল্পকালীন আলোচনা ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের কারণ হতে পারে না। ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনযাপনের ভৌগোলিক পরিবেশের সাথে তার অভিজ্ঞতা, বংশগত ধারা প্রভৃতি বিষয়ের সমন্বয়ে নির্ধারিত হয় তার ব্যক্তিত্ব। 

ইউনিভার্সিটি অফ হেলসিঙ্কির মার্কাস জোকেলা এবং তার আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি অনলাইন ভিত্তিক গবেষণায় পরিবেশগত মনোবিজ্ঞান আরও বড় পরিসরে পরীক্ষা করা হয়েছে। লন্ডনের অধিবাসীদের উপর এই অনলাইন জরিপ চালানো হয়েছিলো। গ্রেট লন্ডনের ৫৬,০১৯ জন অধিবাসীর অংশগ্রহণ করেছিলো জরিপে। বৃহদাকারের নমুনা হওয়ায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ ও জীবনযাপনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে আগের চেয়ে সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল লক্ষ করা যায়।

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী গবেষণার চেয়ে এই গবেষণার ফলাফল কিছুটা জটিল হলেও উভয় গবেষণার মূল তথ্য একই ছিলো। যে ভূখণ্ডে আমরা বাস করি, তার সামগ্রিক পরিবেশ আমাদের জীবনযাপন প্রণালী ও ব্যক্তিত্বের কিছু সাধারণ বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু এর কারণে সর্বোপরি আমাদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। ভৌগোলিক পরিবেশের বৈচিত্র্য অনুযায়ী জীবন সম্পর্কে আমাদের চিন্তা চেতনা, কর্ম, অনুভব প্রভৃতি প্রভাবিত হয়।

উত্তর-পূর্ব ও মধ্য আটলান্টিক এলাকার মানুষ রোমান্টিক সম্পর্কের ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন থাকে; Image Source: WallHere

রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যক্তির মনোভাবের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে তার বসবাসের স্থান। ‘জার্নাল অফ রিসার্চ ইন পার্সোনালিটি’ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া যায়। ১,২৭,০০০ প্রাপ্তবয়স্কের উপর একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখা যায় পশ্চিম উপকূলবর্তী এলাকার চেয়ে উত্তর-পূর্ব ও মধ্য আটলান্টিক এলাকার মানুষজন রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকটাই উদ্বিগ্ন। অপরদিকে, উতাহ অঞ্চলে বসবাসকারীরা রোমান্টিক সম্পর্কে অনুরক্ত ও সবচেয়ে কম উদ্বিগ্ন দেখা যায়। আর পাবর্ত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম উৎসাহী ও উদাসীন।

মানুষের উপর ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাবের উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।  শীতপ্রধান অঞ্চল যেমন নর্ডিক দেশগুলোতে বছরের ছ’মাসই সূর্যের দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তখন সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে বিশেষ বিষণ্ণতা দেখা যায়, যাকে বলা হয় ‘সিজনাল ইফেক্টিভ ডিজঅর্ডার’

সূর্যালোকের স্বল্পতায় হতাশ ও বিষণ্ণ বোধ করে অনেক অঞ্চলের মানুষ; Image Source: Getty Images

সূর্যালোকের স্বল্পতায় হতাশ ও বিষণ্ণ বোধ করা সে অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অনেক সাধারণ ব্যাপার। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতারর কারণেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষজন বৈচিত্র্যময় ও আলাদা সংস্কৃতির মানুষের সাথে বেশি মিশতে পারে না। ফলে তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃত রক্ষায় বেশি সচেতন থাকে।

সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন, মানুষের চরিত্র গঠনে তার ভৌগোলিক পরিবেশ ও অবস্থানের সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শেষ করা যাক উইনস্টন চার্চিলের সেই বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে, “আমরা আমাদের অট্টালিকা রূপদান করি, পরবর্তীতে সেই অট্টালিকা আমাদের রূপদান করে।” পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের চর্চায় ভৌগোলিক পরিবেশের এই রূপদান করার ক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন অবস্থানের প্রভাব যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about how the city you live in can shape your character.

Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image @ Wallpaper Cave

Related Articles