তাহিতির বন্দরে টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল ফ্রান্স থেকে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া বুঁদোজ এবং ইতোয়াল জাহাজের নাবিকরা। তাদের উদ্দেশ্য পুরো পৃথিবী একবার প্রদক্ষিণ করে দেশে ফিরে যাওয়া। আর এই যাত্রাকালে বিভিন্ন দেশের বন্দরগুলোতে নোঙর ফেলে প্রয়োজনীয় খাদ্য-রসদ বোঝাই করে আবার রওয়ানা দিতো তারা। যাত্রী হিসেবে থাকা শৌখিন এবং পেশাদার বিজ্ঞানী, মানচিত্রকর, প্রাণিবিদ, উদ্ভিদবিদগণ বিরতিকালে নিজেদের গবেষণার স্বার্থে নমুনা সংগ্রহে নেমে পড়তেন। প্রায় দু’বছর ধরে সমুদ্রে ভেসে চলা এই জাহাজ এসে পৌঁছেছে তাহিতির বন্দরে। বাজারে সওদা কেনায় মগ্ন নাবিকদের মনোযোগ ভেঙে যায় হঠাৎ করে ভেসে আসা এক নারীর চিৎকারে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, নারীর চিৎকারের ভাষা ছিল ফরাসি।
কেনাকাটা ফেলে তারা এগিয়ে গেলো ঘটনা কী জানার জন্য। দেখা গেলো তাদের জাহাজের যাত্রী ‘জন’কে ঘিরে একদল স্থানীয় ছোকরা কথা কাটাকাটি করছে। তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে জন মেয়েদের স্বরে চিৎকার করছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে জনের স্বর মেয়েলি হয়ে উঠলো কেন সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছিল না। এক স্থানীয় ছোকরা জনকে আঘাত করে বসলে এক নাবিকের হুঁশ ফেরে। সে ছোকরাদের তাড়িয়ে দিয়ে জনকে উদ্ধার করে জাহাজে ফিরিয়ে আনে। আর তখনই জানা গেল, দু’বছর ধরে তাদের সফরসঙ্গী পুরুষ জন আসলে জাঁ বারে নামক এক নারী।
জাঁ বারে কে?
জাঁ বারে ছিলেন একজন ফরাসি উদ্ভিদবিদ এবং পর্যটক। উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি অসীম আগ্রহের দরুন তিনি ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উদ্ভিদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। তিনি এক ফরাসি নাবিকদলের যাত্রাসঙ্গী হন, যাদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা। তাই পরোক্ষভাবে তিনি সেই নাবিকদলের সাথে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যান। তিনি প্রথম নারী যিনি পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন।
কিন্তু শুনতে যতটা সহজ শোনা গেল, পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। তাকে কড়া গোপনীয়তায় সেই জাহাজে চড়তে হয়েছিল। এই জ্ঞানপিপাসুর জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সের অতুন গ্রামে ১৭৪০ সালের ২৭ জুলাই। দরিদ্র পরিবারের সন্তান বারে’র পিতা ছিলেন একজন দিনমজুর। তার সামান্য উপার্জনে পরিবারের অন্ন-বস্ত্রের যোগান হতো। বারের শৈশব কেটেছে গ্রামের পথে-ঘাটে খেলা করে। তিনি শখের বসে লতা-গুল্ম, গাছের পাতা সংগ্রহ করতেন। নিত্য নতুন নতুন গাছ সংগ্রহ করে তিনি ছোটখাট সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এসব গাছগাছালি সম্পর্কে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছিল না। নিজের কৌতূহল থেকেই তিনি উদ্ভিদ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। লতাপাতা নিয়ে পড়ে থাকা এই কৌতূহলী মেয়ের স্থানীয় নাম ছিল Herb Woman বা লতা নারী।
তিনি বড় হয়ে জীবিকার তাগিদে ফিলিবার্ট কমারসন নামক এক চিকিৎসকের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। জনাব কমারসন পেশায় চিকিৎসক হলেও, প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে টুকটাক গবেষণা করতেন। একবার তিনি গবেষণার উদ্দেশ্যে জাঁ বারের গ্রামে গিয়ে লতা সংগ্রহ করেছিলেন। তখন কমারসন এবং বাঁরের মাঝে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ১৭৬২ সালে কমারসনের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে তাদের এই বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয়। ১৭৬৪ সালে এই দম্পতির ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু তাদের সম্পর্ক সমাজের নিকট গোপন রাখতে তারা সেই সন্তানকে প্যারিসে অন্য এক পরিবারের নিকট পালক-পুত্র হিসেবে পাঠিয়ে দেন।
লুই আঁতোয়া ডি বুগেনভিয়ে’র যাত্রা সঙ্গী
১৭৬৫ সালে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই দেশের অভিযাত্রীদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবী ভ্রমণ করে ফ্রান্সের জন্য নতুন অঞ্চল অনুসন্ধান করার। সেই নির্দেশনায় সাড়া দেওয়া অভিযাত্রিকদের দলে ছিলেন লুই আঁতোয়া ডি বুগেনভিয়ে। তিনি ছিলেন একজন ফরাসি এডমিরাল। তার অধীনে বুঁদোজ এবং ইতোয়াল নামক দুটি জাহাজ ছিল। বিশ্বভ্রমণে অংশীদার হতে এই অভিযাত্রিক অনুরোধ করলেন তার কাছের বন্ধু ফিলিবার্ট কমারসনকে। নতুন অঞ্চল থেকে নতুন উদ্ভিদ সংগ্রহের এই মোক্ষম সুযোগ হারাতে চাইলেন না তিনি। কিন্তু তিনি নিজে ছিলেন ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাই তার একজন যোগ্য এবং ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়োজন। তখনই তার মাথায় আসলো জাঁ বারের কথা। একজন উদ্ভিদবিদ হিসেবে জাঁ বারেই পারে তার সকল কাজের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বুঝতে।
কিন্তু তৎকালীন ফরাসি নৌবাহিনীর কড়া নিয়ম ছিল, কোনো নারী জাহাজে পাড়ি দিয়ে ভ্রমণ করতে পারবে না। তাই জাঁ বারের ভ্রমণ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে হাল ছাড়তে নারাজ কমারসন। দু’জন মিলে এক অভিনব ফন্দি আঁটলেন। জাঁ বারে নিজেকে পুরুষদের পোশাকে আবৃত করলেন। তার নতুন নাম হয়ে গেলো ‘জন’। এরপর তারা ইতোয়াল জাহাজে চড়ে রওয়ানা দিলেন নতুন পৃথিবী এবং উদ্ভিদের সন্ধানে।
সাগরজলে বছরের পর বছর
নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ ভাসিয়ে দেওয়া হলো আটলান্টিকের বুকে। সেই সাথে শুরু হলো ছদ্মবেশী জনের যাত্রা। বিশাল আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তারা তাদের প্রথম গন্তব্যস্থল উরুগুয়ের রাজধানী শহর মন্টিভিডিওতে পৌঁছায়। বন্দরে নোঙর ফেলার পর কমারসন এবং বারে নিকটবর্তী লোকালয় ঘুরে বিভিন্ন লতা-গুল্ম সংগ্রহ করা শুরু করেন।
এরপরের গন্তব্যস্থল ছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো। এই অঞ্চলে জাঁ বারে নতুন প্রজাতির উজ্জ্বল গোলাপি এবং বেগুনি ফুল সমন্বিত লতার সন্ধান পান। জাহাজের এডমিরালের সম্মানার্থে এই লতার নামকরণ করা হয়েছিল Bougainvillea brasiliensis. এভাবে একের পর এক বন্দরে নেমে নিকটবর্তী অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছিলেন জাঁ বারে। শুধু জাঁ বারে’র নাম বললাম কারণ ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে প্রায়ই শয্যাশায়ী পড়ে ছিলেন ফিলিবার্ট কমারসন। তাই ভ্রমণকালে নিজের উদ্যোগেই উদ্ভিদ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যান জাঁ বারে। তিনি সর্বমোট ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন। দুঃখের ব্যাপার হলো, বহু বছর যাবৎ এই অসামান্য অবদান সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।
নিজের ছদ্মবেশ যেন ফাঁস হয়ে না যায়, সেজন্য তিনি অন্যান্য পুরুষদের ন্যায় ভারী কাজকর্ম করতে থাকেন। প্রয়োজনে ভারী সরঞ্জাম কাঁধে নিয়ে জাহাজের ডেকে নাবিকদের সাহায্য করতে থাকেন তিনি। তার নিষ্ঠা আর উৎসর্জন দেখে বাকিরা যারপরনাই অবাক হয়েছিল। দুই বছর পর ১৭৬৭ সালে তাহিতি’র বন্দরে গিয়ে পৌঁছায় জাহাজ দু’টো। এই দীর্ঘ সময় ধরে তার পরিচয় সফলভাবে গোপন রাখতে সক্ষম হলেও তাহিতি’র বন্দরে স্থানীয়দের খপ্পরে পড়ে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে ইতোয়ালে ফিরিয়ে নিলে সেখানে তিনি তার আসল পরিচয় বলতে করতে বাধ্য হন।
নির্যাতনের শিকার
জাহাজে সেদিন জাঁ বারের আসল পরিচয় উদ্ঘাটনের পর কী ঘটেছিল? কীভাবে এই সংবাদ হজম করেছিল তার সহযাত্রীগণ? এই বিষয়ে জাহাজের এডমিরাল বুগেনভিয়ে’র ডায়েরিতে লেখা ছিল,
“তাহিতিয়ানদের দ্বারা আবদ্ধ জাঁ বারে তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নিজের আসল পরিচয় ফাঁস করে দেয় যেন তার স্বদেশীরা তাকে সম্ভাব্য যৌন নির্যাতন থেকে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে আসে।”
কিন্তু তিনি জাহাজের নাবিকদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি। সেই প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে হলে আমাদের ঢুঁ মারতে হবে অন্যান্য সহযাত্রীদের ডায়েরির পাতায়। সেখানে দেখা গেলো পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর জাঁ বারে’র জন্য জাহাজে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের মতে তাকে নাবিকরা প্রায়ই নির্যাতন করতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলেও জানা গেছে। নিজের জ্ঞানপিপাসা মেটানোর জন্য এত ত্যাগ-তিতিক্ষা’র পর একসময় তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ১৭৬৮ সালে জাহাজ মরিশাসের বন্দরে নোঙর ফেলে। এখানে পদার্পণের পর কমারসন এবং বারে নাবিকদের সাথে পুনরায় জাহাজে উঠতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তারা থেকে গেলেন মরিশাসে।
শেষ জীবন
জনাব কমারসন তার খ্যাতির সুবাদে অনেকের সাথেই পরিচিত ছিলেন। মরিশাসের গভর্নর পিয়েরে পইভো তার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তারা গভর্নরের অতিথি হিসেবে দ্বীপে বসবাস করা শুরু করেন। দ্বীপের বাকি পাঁচ বছর অসুস্থ কমারসনের সেবা করে কাটিয়ে দেন জাঁ বারে। ১৭৭৩ সালে ফিলিবার্ট কমারসন মৃত্যুবরণ করেন। নতুন দ্বীপদেশে জাঁ বারে একা হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গতা দূর করতে তিনি নতুনভাবে প্রেমে পড়েন। ১৭৭৪ সালের মে মাসে তিনি প্রেমিক জঁ দুবারনাকে বিয়ে করেন এবং নতুন দম্পতি ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠেন। ১৭৭৫ সালে জাহাজ যখন ফ্রান্সের বন্দরে নোঙর ফেলে, তখন জাঁ বারে বনে যান পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি পৃথিবীটা একবার ঘুরে এসেছেন।
জাঁ বারের এই অনন্য কীর্তি বেশ দীর্ঘ সময় ধরে অস্বীকৃত ছিল। এমনকি তার সংগ্রহের ৬ হাজার উদ্ভিদ নমুনা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বড় অবদান রাখলেও সে অবদানের স্বীকৃতি তিনি পাননি। ভ্রমণকালে তিনি নিজে কোনো দিনলিপি রাখেননি। সহযাত্রীদের ডায়েরি থেকে তার নিষ্ঠার কথা জানা যায়। ফিলিবার্ট কমারসন তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছিলেন এই ভ্রমণে বারে উদ্ভিদবিজ্ঞানের জন্য যা করেছে, সেই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নতুন প্রজাতির উদ্ভিদের নামকরণ তার নামে করা উচিত। কিন্তু তিনি আর কখনই ফ্রান্সে ফিরে না আসায় সেই স্বীকৃতি আর দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এরিক টেপে নামক এক জীববিজ্ঞানী কমারসনের অসম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তিনি ইকুয়েডরে আবিষ্কৃত এক নতুন উদ্ভিদের নামকরণ করেছেন Solanum baretiae. নামকরণের পাতায় তিনি জাঁ বারে সম্পর্কে লিখেন,
“একজন নির্ভীক অভিযাত্রিক, যিনি নিজের জীবন এবং সম্ভ্রম বাজি রেখেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকে। আর এই ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট রাখতে গিয়ে তিনি বনে গেছেন পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী প্রথম নারী।”
ফ্রান্সে ফিরে তিনি নতুন স্বামীর জন্মস্থান সাঁ-অলায় শহরে সংসার শুরু করেন। ১৮০৭ সালের ৫ আগস্ট তিনি এই শহরে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম সাহসী, ত্যাগী এবং প্রতিভাবান একজন কাণ্ডারির সংগ্রামী অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে।
0This is a Bangla article about Jeanne Baret who was the first woman to circumnavigate the earth.
References: All the references are hyperlinked.
Feature Image: Edited by author.