Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমাদের শোনা ও দেখার সীমাবদ্ধতা এবং সেগুলো উৎরানোর কৌশল

যখন দেখা ও শোনার প্রসঙ্গ চলে আসে, তখন অবধারিতভাবে আসে আলো ও শব্দের কথা। আলো ও শব্দের মাধ্যমেই মানুষ দেখতে ও শুনতে পায়। আলো একধরনের তরঙ্গ, পানির ঢেউয়ের মতো ঢেউ তুলে আলোক রশ্মি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তাই একে কম্পন বলে ধরে নেয়া যায়। একইভাবে শব্দও একধরনের তরঙ্গ, স্প্রিংয়ের মতো সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে তা অগ্রসর হয়। শব্দ আর আলোর মাঝে অনেক সাদৃশ্য আছে। কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আলোর প্রক্রিয়া দিয়ে শব্দকে ব্যাখ্যা করা যায়। অন্যদিকে শব্দের প্রক্রিয়া দিয়েও আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়।

শব্দের তীব্রতা অনেক বিস্তৃত। বিস্তৃত তীব্রতার মাঝে ছোট একটা অংশ পর্যন্ত আমরা শুনতে পাই। এর বাইরে অত্যন্ত তীব্র শব্দও আছে যার তীব্রতার মাত্রা এতটাই বেশি যে, স্বাভাবিক মানুষ তা শুনতে পারে না। এদেরকে বলে ‘আল্ট্রাসাউন্ড’। মাঝে মাঝে আমরা ‘আল্ট্রাসনোগ্রাফি‘ নামক একটা বিষয় শুনে থাকবো যা চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করেই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। মানুষ এত তীব্র শব্দ না শুনলেও বাদুড় তা ঠিকই শুনতে পায়। বাদুড় এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে চলাচল করে।

আল্ট্রাসাউন্ডে তোলা ১২ সপ্তাহের ভ্রূণ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/Wolfgang Moroder

বেশি তীব্রতার পাশাপাশি কম তীব্রতার শব্দও আছে। এসব শব্দের তীব্রতা এতটাই কম যে, মানুষ তা শুনতে পায় না। এ ধরনের শব্দকে বলে ‘ইনফ্রাসাউন্ড’। হাতি ও তিমি সহ আরো কিছু প্রজাতি এমন স্বল্প তীব্রতার শব্দ শুনতে পায়। এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। শব্দের বৈচিত্র্যতার মাঝে মানুষের শোনার সক্ষমতা আল্ট্রাসাউন্ড ও ইনফ্রাসাউন্ডের মাঝামাঝি অবস্থান করে, যা তীব্রতার দিক থেকে খুব বেশিও নয়, আবার খুব কমও নয়।

ইনফ্রাসাউন্ডে শোনার ক্ষমতা আছে তিমি মাছের। ছবি: সায়েন্স ২.০

আলোর বেলাতেও একই রকম ব্যাপার প্রযোজ্য। শব্দের বেলায় আমরা যাকে আল্ট্রাসাউন্ড বলে ধরে নিয়েছিলাম, সেখানে আলোর বেলায় হবে ‘আল্ট্রাভায়োলেট’ বা অতিবেগুনী রশ্মি। আল্ট্রাভায়োলেট শব্দটির মানে হচ্ছে ভায়োলেট বা বেগুনীর সীমার বাইরে। মানুষের দেখার সীমা বেগুনী পর্যন্ত, এর বাইরের কোনো আলো মানুষ দেখতে পায় না। তবে মানুষ অতিবেগুনী আলো দেখতে না পেলেও, কিছু কিছু পোকামাকড় ঠিকই দেখতে পায়।

কিছু কিছু প্রজাতির ফুলের মধ্যে লুকায়িত অবস্থায় বিশেষ ধরনের ডোরাকাটা সজ্জা থাকে। এই ধরনের সজ্জাকে মানুষের স্বাভাবিক চোখ দেখতে পায় না। কিন্তু কিছু কিছু পোকামাকড় তা ঠিকই দেখতে পায়। গাছেরা এমন প্যাটার্ন ব্যবহার করে ঐ ধরনের পোকামাকড়কে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে, যা তাদের প্রজনন বা টিকে থাকার জন্য দরকারি। মানুষের চোখ যদি অতিবেগুনী আলোর প্রতি সংবেদী হতো, তাহলে মানুষ ফুলের ঐ বিশেষ সজ্জা দেখতে পেতো। তারপরেও মানুষ চাইলে বিশেষভাবে এটি দেখতে পারে। কারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আছে, একে ব্যবহার করে মানুষের সাধ্যের বাইরে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয়েছে।

স্বাভাবিক চোখে যদি দেখা হয় বা সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে যদি ছবি তোলা হয়, তাহলে এই ফুলটিকে নিতান্তই হলুদ ফুল বলে মনে হবে। কোনো ডোরাকাটা নেই, কোনো সজ্জা নেই। অতিবেগুনী রশ্মিতে ছবি তুলতে পারে এমন ক্যামেরা দিয়ে যদি ঐ ফুলটির ছবি তোলা হয়, তাহলে বিস্ফোরণরত নক্ষত্রের মতো একটি দৃশ্য দেখা যাবে। মনে হবে মাঝখান থেকে আলোক রশ্মিগুলো বিস্ফোরিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে।

ফুলের বাহ্যিক দুই রূপ। ছবি: পিন্টারেস্ট

দ্বিতীয় ছবিতে আমরা এই সজ্জাকে সাদাটে হিসেবে দেখছি। কিন্তু এটি সাদা নয়, এর সত্যিকার রং ‘অতিবেগুনী’, যা আমরা দেখতে পাই না। যেহেতু আমরা একে দেখতে পাই না, সেহেতু অতিবেগুনী রংটিকে এমন কোনো রঙের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে, যা মানুষ খালি চোখে দেখতে পায়। এ ধরনের ক্যামেরায় ছবিগুলো সাধারণত সাদা-কালোই ওঠে, তাই আমরা অতিবেগুনী রশ্মির এই সজ্জাটিকে সাদা-কালো হিসেবে দেখছি। যিনি এই ছবিটি তুলেছেন, তিনি চাইলে সাদা-কালোর পরিবর্তে লাল-নীল বা অন্য কোনো রঙও দিতে পারতেন।

এর চেয়েও বেশি কম্পাঙ্কের আলো আছে। আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে, তার তীব্রতাও তত বেশি হবে। অতিবেগুনী রশ্মির চেয়েও বেশি তীব্র রশ্মি হচ্ছে এক্স-রে। এক্স-রে বা এক্স রশ্মির তীব্রতা এতই বেশি যে, এমনকি পোকামাকড়ও তা দেখতে পায় না। দৃঢ় কোনো প্রতিবন্ধক ছাড়া এক্স-রে’কে আটকানো যায় না। মানুষের ত্বক আর মাংসকেও ভেদ করে চলে যেতে পারে এই আলো। এমনকি মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে বলেই চিকিৎসাক্ষেত্রে এ ধরনের আলো দিয়ে হাড়ের ছবি তোলা হয়। হাড়ের কোথাও ফাটল ধরেছে কিনা, ভেঙে গিয়েছে কিনা, টিউমার হয়েছে কিনা ইত্যাদি জানতে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। এর চেয়েও তীব্রতর আলো হচ্ছে গামা রশ্মি।

এক্স-রে’র মাধ্যমে দেহের ভেতরের ছবি তোলা যায়। এর মাধ্যমে জানা যায় কোনো হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা। ছবি: পিন্টারেস্ট

বিপরীত দিক থেকে, খুবই অল্প কম্পাঙ্কের আলোও আছে। নিম্ন তীব্রতার দিক থেকে লাল রঙের আলো পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই। এর বাইরে আরো স্বল্প তীব্র আলো হচ্ছে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। লোহিত শব্দটির পরিবর্তে একে মাঝে মাঝে ‘অবলাল আলো’ও বলা হয়। আমরা এ ধরনের আলো দেখতে পাই না। আমরা দেখতে না পেলেও, কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা এই আলোতে দেখতে পায়। যেমন- একধরনের সাপ আছে, যারা অবলোহিত আলোর প্রতি সংবেদনশীল এবং এই আলো তাদেরকে শিকার শনাক্ত করতে সাহায্য করে। শব্দের মতো আলোর বেলাতেও আমরা খুব বেশি তীব্রও না আবার খুব বেশি স্বল্পও না- এমন একটি ব্যবধিতে অবস্থান করছি।

সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্র প্রতিনিয়তই ছোট থেকে বড় সকল কম্পাঙ্কের তরঙ্গ নিঃসরণ করে যাচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার হলো, কম্পাঙ্কের এত বিস্তৃত একটি বর্ণালীর মাঝে খুব অল্পই আমরা মানুষেরা দেখতে পাই। তড়িৎচুম্বক বর্ণালীর সবচেয়ে বড় তরঙ্গ ‘রেডিও তরঙ্গ’ থেকে এই বর্ণালীর শুরু এবং সবচেয়ে ছোট তরঙ্গ ‘মহাজাগতিক রশ্মি’তে এর শেষ। এর মাঝে ক্ষুদ্র গাঢ় অংশটি হচ্ছে মানুষের জন্য দৃশ্যমান অঞ্চল। এই ক্ষুদ্র অংশের বাইরের সমস্ত অঞ্চলই মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। বলা যায়, বিস্তৃত বর্ণালীর প্রায় পুরোটাই মানুষের জন্য অধরা।

বর্ণালীর খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পায় মানুষ (উপরের লাইনে মাঝের রঙিন অংশটি)। ছবি: ফিফটি ডিগ্রি নর্থ

মানুষ দৃশ্যমান বর্ণালীর বাইরের আলো দেখার জন্য এমন কিছু যন্ত্রের সাহায্য নেয়, যা অদৃশ্য আলোর প্রতি সংবেদনশীল। পত্রপত্রিকায় মহাকাশের যে ছবিগুলো দেখা যায় সেগুলো সাধারণ দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে তোলা হয়নি। দৃশ্যমান আলোতে তুললে সেসব ছবি স্পষ্ট হতো না। বিশেষ করে সুপারনোভার ছবিগুলো তোলা হয় সেটি থেকে নিঃসরিত এক্স-রে তরঙ্গ ব্যবহার করে।

ছবিতে দেখানো রংগুলো আসলে কৃত্রিম রং। উপরে বিশেষ ধরনের ফুলের ক্ষেত্রে যেমন দেখেছি অনেকটা তেমন। সুপারনোভার ছবি তোলার জন্য এক্স-রের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যমান রং ব্যবহার করা হয়। উপযুক্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের জন্য উপযুক্ত রং বাছাই করতে পারলে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দিত করে সুপারনোভার ছবি তোলা যায়।

দৃষ্টিনন্দন কেপলারের সুপারনোভা, (কেতাবি নাম SN 1604)। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/নাসা/R.Sankrit & W.Blair

এসব ছবি তোলার জন্য তারা যে যন্ত্র ব্যবহার করেন তার নাম ‘রেডিও টেলিস্কোপ’। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এক্স-রের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ব্যবহার করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ব্যবহার করে নক্ষত্র ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দৈহিক সীমাবদ্ধতা কারণে মহাবিশ্বের নানা ঘটনা দেখতে পাই না, কিন্তু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনুসারে রঙ প্রতিস্থাপন করে পরোক্ষভাবে ঠিকই দেখে নিতে পারি। এ কারণে এ ধরনের ছবিগুলো একটা দিক থেকে বিশেষ। এ ধরনের রঙিন ছবিগুলো হতে পারে বাস্তবতার চমৎকার একটি জাদুকরী উদাহরণ।

রেডিও টেলিস্কোপ, এদের মাধ্যমে নক্ষত্র-গ্যালাক্সির ছবি তোলা হয়। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/ESO/José Francisco Salgado

পৃথিবীর অন্যান্য সব প্রজাতি থেকে মানব প্রজাতি আলাদা। অন্য প্রাণীর মতো মানুষেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু সে সীমাবদ্ধতা মানুষকে আটকে রাখতে পারেনি। কোনো না কোনো এক উপায়ে মানুষ সেই সীমাবদ্ধতাকে জয় করে নিয়েছে। যেসব সীমাবদ্ধতা মানুষ এখনো জয় করতে পারেনি, সেগুলোও একদিন না একদিন অবশ্যই জয় করবে।

ফিচার ছবি: io9/Dreams Time

Related Articles