Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিনি ব্রেইন: গবেষণাগারে প্রস্তুতকৃত মানব মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র সংস্করণ

টেলিভিশনের পর্দায় নিচ দিয়ে ভেসে চলা ব্রেকিং নিউজে চোখ বুলাতেই চমকে উঠলেন মিস পটার। কী সাঙ্ঘাতিক কথা! ল্যাবরেটরির গোপন ভল্ট থেকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নাকি চুরি করে নিয়েছে এক দুর্বৃত্তের দল। শুধু মিস পটারই নন, সেদিন সকালে এই সংবাদ পাওয়া মাত্র সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, কৃষক, শ্রমিকসহ সকল পেশার মানুষ শিউরে উঠলো। সবার মুখে একই প্রশ্ন, “এত সুরক্ষিত ভল্ট থেকে কীভাবে সেই মস্তিষ্ক দুর্বৃত্তদের হাতে গেলো?”

কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান কর্মকর্তারাও জানেন না। ঘটনাস্থলে অনিয়মের ছিটেফোঁটাও নেই। বাইরে থেকে দেখে কেউ বলতেই পারবে না, এখানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু ভল্টের ডালা খুলতেই দেখা যাবে, ভেতরে কিছু নেই। একদম ফাঁকা। এই ফাঁকা কুঠুরি দেখে সবার মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই আপাতত। এদিকে আইনস্টাইনের বিখ্যাত মস্তিষ্ক নিয়ে কুখ্যাত দুর্বৃত্তরা তাদের গোপন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে জমায়েত হয়েছে। এখানে একদল জাপানী বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হবে মস্তিষ্কের ক্লোন। এরপর এই মস্তিষ্ক ব্যবহার করে গড়ে তোলা হবে আইনস্টাইনের শত শত রেপ্লিকা। এই রেপ্লিকা আইনস্টাইনদের নিয়ন্ত্রণ করে সম্পাদন করা হবে ভয়ংকর সব এক্সপেরিমেন্ট।

গবেষণাগারে সংরক্ষিত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক; Image Source: Amitai Givertz

শৈশবে এ ধরনের বহু রোমাঞ্চকর সায়েন্স ফিকশনের বদৌলতে ঘুরে আসতাম ব্রেইন ক্লোনিংয়ের ভয়ংকর জগত থেকে। আর সব অঙ্গ ছাপিয়ে শুধু এই মস্তিষ্ক ক্লোনিংয়ের ব্যাপারটাই যেন ঘুরেফিরে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়তো। আর এটি একদম অস্বাভাবিক নয়। কারণ, জীবজগতের হাজারো প্রজাতির প্রাণীর ভিড়ে একমাত্র মানুষই পুরো পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। আর এর পুরো কৃতিত্ব গিয়ে বর্তাবে মানুষের উন্নত মস্তিষ্কের উপর।

এজন্য এই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণার কোনো শেষ নেই। আর মানব মস্তিষ্কের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে প্রয়োজন এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একটি মস্তিষ্ক গঠন প্রক্রিয়া একদম শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। আর এই কাজের জন্য বিজ্ঞানীরা স্টেম কোষের সাহায্যে সরাসরি মস্তিষ্ক নির্মাণ করা শুরু করলেন। ল্যাবরেটরি নির্মিত এই মস্তিষ্কের নাম দেয়া হয় ‘মিনি ব্রেইন’। ‘মিনি’ শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র। মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় গবেষণাগারে নির্মিত এই মস্তিষ্কের আকার অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হওয়ায় এর নাম দেয়া হয়েছে মিনি ব্রেইন। মানুষে মস্তিষ্কের সর্বমোট নিউরনের সংখ্যা ৮৬ বিলিয়ন, যেখানে একটি মিনি ব্রেইন মাত্র ১ লাখ নিউরন দ্বারা গঠিত। মিনি ব্রেইনের এই যুগান্তকরী যাত্রাপথ সম্পর্কে জানার আগে চলুন ছোট করে জেনে আসি স্টেম কোষ সম্পর্কে।

স্টেম কোষ থেকে দেহের বিভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদিত হয়; Image Source: Bioinformant

আমাদের দেহে নানা ধরনের কোষ রয়েছে। যেমন, মস্তিষ্কের কোষ নিউরন, ত্বকের কোষ, পেশী কোষ, রক্তকণিকা, যকৃত কোষ ইত্যাদি। প্রতিটি কোষ অন্য আরেক ধরনের কোষ থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা। যকৃত কোষ ইচ্ছে করলেই নিউরনে পরিণত হতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেহে আরেক ধরনের কোষ রয়েছে, যার নাম স্টেম কোষ বা কোষ। এটি একধরনের বহুরূপী কোষ, যা দেহের অন্যান্য কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। অর্থাৎ, একটি স্টেম কোষ থেকে নিউরন, যকৃত কোষ অথবা রক্তকণিকা গঠিত হতে পারে। আবার বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেহের যেকোনো কোষকে স্টেম কোষে রূপান্তরিত করতে পারেন। এরপর সেই স্টেম কোষ থেকে অন্য যেকোনো কোষে রূপান্তর করা যেতে পারে।

এই তত্ত্ব থেকে ভিয়েনার ইন্সটিটিউট অফ মলিক্যুলার বায়োলোজির বিজ্ঞানী ইয়ুর্গেন নব্লিচ চিন্তা করলেন, কেমন হয়, যদি ত্বকের কোষকে স্টেম কোষে রূপান্তরিত করে সেখান থেকে স্নায়বিক আবেশের মাধ্যমে নিউরন তৈরি করা যায়? আর এভাবে নিউরন থেকে তৈরি করা হবে লিলিপুট আকারের মস্তিষ্ক! খুব সহজভাবে নকশা করা হলেও বাস্তবে কাজটি ছিল খুব কঠিন। এসব পরীক্ষায় বড় বড় গবেষকদের চরম সতর্কতার পরেও ছোট-বড় কিছু ভুল হয়ে যেতেও পারে। বিশেষ করে, গবেষকরা একটি স্টেম কোষ থেকে নিউরন উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রোটিন, শর্করা, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানের সবচেয়ে নিখুঁত রাসায়নিক সংযোজনের পরিমাণ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন।

ইয়ুর্গেন নব্লিচের ল্যাবেও ভুল হলো। কিন্তু ভুল দেখে থমকে গেলে চলবে না। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল সংশোধন করে আবার প্রথম থেকে কাজ শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে কয়েক ধাপে ভুল সংশোধন এবং পুনরায় চেষ্টার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেন তারা। ২০১৩ সালে বিজ্ঞানীরা রাসায়নিক পদার্থের সঠিক সংযোজন বের করতে সক্ষম হন। কম্পিউটারের পর্দায় নমুনা কোষের ছবি দেখে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন গবেষক মেডেলিন ল্যাঙ্কেস্টার। ভিয়েনার সেই ল্যাবে প্রস্তুত করা হলো ভ্রূণাবস্থিত মস্তিষ্ক।1

TEDx CERN-এ মিনি ব্রেইন প্রকল্পের সফলতার কথা তুলে ধরেন মেডেলিন ল্যাঙ্কেস্টার; Image Source: Youtube

কিন্তু একই প্রকল্পে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি গবেষণাগারে কাজ চলছিলো। তাই মিনি ব্রেইন প্রকল্পে ইয়ুর্গেন নব্লিচদের একক কর্তৃত্ব ছিল না। পরবর্তীতে এই মস্তিষ্কের ভ্রুণ থেকে ধাপে ধাপে নির্মাণ করা হয় মিনি ব্রেইন অঙ্গকল্প। গবেষণাগারে তৈরি মিনি ব্রেইন স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মতোই বিকাশ লাভ করতে পারে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। মানুষের মস্তিষ্ককে বিজ্ঞানীরা যেমন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, মিনি ব্রেইনের মাঝেও সে বিভক্তি দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আসল মস্তিষ্কের সমকক্ষ হতে হলে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

গবেষণাগারে তৈরি হলো মানব মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র সংস্করণ

মিনি ব্রেইন আবিষ্কার এবং এর অগ্রগতি নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই আশাবাদী। এর ফলে মানসিক রোগের কারণে রোগীর মস্তিষ্কে বিভিন্ন প্রভাব এবং অন্যান্য জটিল ব্যাধির সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক নির্ণয় করা যাবে বলে জানান ইউসি ডেভিস মেডিক্যাল সেন্টারের নিউরোসার্জন বেন ওয়ালডাও। তার মতে,

“অনেক সময় রোগীর সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে তার চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত অনেক রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার পরেও অনেক সমস্যা থেকে যায়। মিনি ব্রেইন যদি মানুষের মস্তিষ্কের সমতুল্য হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে এসব রোগের চিকিৎসা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা যাবে।”

এছাড়া আলঝেইমার, পার্কিনসন এবং অটিজমের মতো গুরুতর রোগের নিরাময় আবিষ্কারে সহায়তা করবে মিনি ব্রেইন অঙ্গকল্প। গবেষকগণ কোনো ঔষধ প্রস্তুত করলে তা প্রথমে প্রাণীর উপর প্রয়োগ করে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রাণীর দেহে সঠিকভাবে কাজ করা ঔষধ মানবদেহে প্রয়োগের পর ব্যর্থ হয়। যদি এভাবে মস্তিষ্কের রোগের জন্য আবিষ্কৃত কোনো ঔষধ ভুলভাবে মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা হতে পারে। তাই মিনি ব্রেইন কোষগুলো এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ দেখাতে পারবে। মানুষ তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে কীভাবে প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে এগিয়ে গেলো, সে রহস্য উন্মোচনে মিনি ব্রেইনের বিকাশক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মিনি ব্রেইন কি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে? Image Source: Emilio Garcia

মিনি ব্রেইন নিয়ে যখন গবেষণার কাজে সফলতা দেখা দেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, “মিনি ব্রেইন কি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারবে?” এর উত্তর হবে, “না।” এর পেছনে বেশ কতগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় মিনি ব্রেইনে খুব কম নিউরন বিদ্যমান। বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরনের সমন্বয়ে মানুষ তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সংগঠিত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, একটি বিমানের সকল যন্ত্রাংশ খুলে যদি ‘এলোমেলোভাবে’ পুনরায় লাগানো হয়, তাহলে বিমানটি আর উড়তে পারে না। কিন্তু এলোমেলো বিমান থেকেও আপনি এর যন্ত্রাংশগুলো আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। মিনি ব্রেইনের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। স্টেম কোষ থেকে উদ্ভূত নিউরনের সমন্বয়ে গঠিত মিনি ব্রেইন মানুষের মস্তিষ্কের ন্যায় সুবিন্যস্ত নয়। তা কিছুটা এলোমেলো বিমানের মতো। তাই আপাতত মিনি ব্রেইন মানুষের ন্যায় স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারবে না।

মিনি ব্রেইন আবিষ্কার মানব মস্তিষ্ক গবেষণায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই নতুন ক্ষেত্র প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে আরো উন্নত হবে। তখন হয়তো অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করা সম্ভব না হলেও, মানব মস্তিষ্কের একদম কাছাকাছি গোছের মিনি ব্রেইন তৈরি করা সম্ভব হবে। সেটি গবেষণার মাধ্যমে রোগ-ব্যাধির নিরাময় আবিষ্কার করা ছাড়াও আমরা আরো জটিল জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো। হয়তো সেসব প্রশ্নের ভিড়ে “মানুষ কেন সেরা?” এই প্রশ্নেরও উত্তর মিলবে।

This is a bangla article about mini brain. Mini brain is smaller version of human brain which was prepared in human laboratory with the help of skin cell. Skin cell was converted into stem cell prior to producing mini brain cells i.e. neurons. 

Reference: 1. What Are Mini-Brains? Science, 342(6155), 200–201. (sci-hub.tw/10.1126/science.1245812)

& All the other references of this articles are hyperlinked.

Featured image: Genome Institute Singapore 

Related Articles