Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সৌদি আরবের ৯,০০০ বছরের প্রাচীন রহস্যময় পাথরের স্থাপনা

বিশ্বের প্রাচীনতম জনপদগুলোর মধ্যে অনেকগুলোরই আবাসস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্য। স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে সেসব জনগোষ্ঠীর নির্মিত স্থাপনার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেরকমই অদ্ভুত এক নিদর্শন হলো মাঝারি এবং ছোট আকারের পাথরের নির্মিত স্থাপনা, যেগুলো স্থানীয় বেদুইনদের কাছে ‘বৃদ্ধ লোকেদের কাজ’ নামে পরিচিত। সৌদি আরব ছাড়াও ইয়েমেন, জর্ডান, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশ জুড়ে এই ধরনের পাথরের নির্মিত কাঠামোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছরের পুরনো এই স্থাপনাগুলোর অনেকগুলো এতো বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মিত যে, শুধুমাত্র আকাশ থেকে দেখলেই তাদের প্রকৃত আকার বোঝা সম্ভব।

গুগল আর্থ থেকে তোলা দরজা সদৃশ পাথরের কাঠামো; Source: livescience.com

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত এলাকার উপর প্লেন থেকে অনুসন্ধান এবং চিত্রধারণ কার্যক্রম চালু ছিল। মূলত গোয়েন্দাগিরি এবং শত্রু স্থাপনার উপর নজরদারি এর মূল উদ্দেশ্য হলেও সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান এবং আলজেরিয়ায় পরিচালিত এসব প্রকল্পে প্রত্মতাত্ত্বিকরাও জড়িত ছিলেন। সে সময়ই ১৯২০ সালে সর্বপ্রথম এ ধরনের কাঠামোর অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এসব এলাকা নিয়ে প্রত্মতত্ত্ববিদদের গবেষণার অগ্রগতিও থমকে যায়।

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে মাত্র এক দশক আগে, যখন গুগল আর্থ সফটওয়্যারটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলে যে কেউ স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত পুরো বিশ্বের যেকোনো স্থানের দুর্লভ ছবি দেখার সুযোগ লাভ করে। প্রত্মতাত্ত্বিকদের কাছে এটি ছিল স্বর্ণের খনি আবিষ্কারের মতো। তারা নব উদ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের স্যাটেলাইট ছবিগুলোতে বিচরণ করতে থাকেন এ ধরনের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের সন্ধানে।

এরকমই একজন হলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড কেনেডি। সম্প্রতি তিনি গুগল আর্থের মাধ্যমে সৌদি আরবের হ্যারেট খাইবার এলাকায় প্রায় ৪০০টি পাথরের তৈরি দেয়ালের মতো স্থাপনা আবিষ্কার করেছেন, যেগুলোকে ‘দরজা’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। উপর থেকে দেখতে কাঠামোগুলোকে মাটিতে শোয়ানো ক্ষেতের বেড়ায় ব্যবহৃত দরজার মতো মনে হয় বলেই এই নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ধারণা করছেন, এই স্থাপনাগুলো অন্তত ৯,০০০ বছর পুরানো।

এই ধরনের স্থাপনা অবশ্য এবারই প্রথম আবিষ্কার হয়নি। এর আগেও জর্ডান এবং সৌদি আরবে এরকম কিছু কিছু ‘দরজা’ এবং ‘ঘুড়ি’ আকৃতির স্থাপনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কেনেডি নিজেই গত এক দশক জুড়ে সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৯০০টির মতো ঘুড়ির সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু কেনেডির আবিষ্কৃত নতুন স্থাপনাগুলো অন্যগুলোর চেয়ে অনেক ভিন্ন। এগুলো সংখ্যায় অনেক বেশি এবং আকার ও আকৃতিতে অনেক বৈচিত্র্যময়। সবচেয়ে বড় স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য ৫১৮ মিটার, অন্যদিকে সবচেয়ে ছোটটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১৩ মিটার। দরজাগুলোর কয়েকটির অবস্থান খুবই নিকটবর্তী, আবার কয়েকটির অবস্থান পরস্পর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দূরে।

আগ্নেয় গম্বুজের উপর অবস্থিত দরজা; Source: livescience.com

শুধু দরজা এবং ঘুড়ি না, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আগ্নেয়ক্ষেত্রের আশেপাশের এলাকা জুড়ে এ ধরনের বৃদ্ধ লোকেদের কাজের মধ্যে রয়েছে কি-হোল (চাবির গর্ত), চাকা, ত্রিভুজ, বুল’স আই প্রভৃতির মতো আকৃতি বিশিষ্ট পাথরের তৈরি স্থাপনা। ঘুড়িগুলোকে উপর থেকে দেখতে লেজ এবং সুতা বিশিষ্ট ঘুড়ির মতোই মনে হয়। গবেষকদের ধারণা, এগুলো শিকার ধরার কাজে ব্যবহৃত হতো। হরিণ বা এ জাতীয় কোনো প্রাণীকে তাড়িয়ে একবার এ জাতীয় ঘুড়ির আকৃতির স্থাপনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সেগুলো আর সেখান থেকে বের হতে পারত না।

নির্মাণশৈলীর দিক থেকে ত্রিভুজ এবং কি-হোলগুলো সবচেয়ে নিখুঁত। ড. কেনেডি জানান, ত্রিভুজ এবং কি-হোলের বাহুগুলো এত নিখুঁতভাবে তৈরি সরলরেখা যে, সেগুলো তাকে অবাক করেছে। এগুলো দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো নির্মাণের জন্য পাথরগুলো খুব সাবধানে বাছাই করা হয়েছিল। কি-হোলের গোলাকার ছিদ্রগুলোও প্রায় নিখুঁত বৃত্তাকার। অনেক সময়ই দেখা যায়, পাশাপাশি অবস্থিত একগুচ্ছ ত্রিভুজ বা কি-হোল কিছু দূরে অবস্থিত বুল’স আইয়ের দিকে মুখ করে থাকে। কেনেডির ধারণা, এগুলো হয়তো কোনো ধর্মীয় প্রতীকের অংশ হতে পারে।

যেভাবে পাথর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে কাঠামোগুলো; Source: New York Times

শুধুমাত্র ছবি দেখে পাথরের স্থাপনাগুলোর বয়স নির্ণয় করা কঠিন। তবে ড. কেনেডি বলেন, এগুলো এখন পর্যন্ত পাওয়া এই অঞ্চলের মানব নির্মিত স্থাপনাগুলো মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। তিনি জানান, জর্ডানে পাওয়া ঘুড়ি আকৃতির স্থাপনাগুলো গবেষণা করে তারা সেগুলোর বয়স মোটামুটি ৯,০০০ বছর নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। আর সৌদি আরবে আবিষ্কৃত ছবিগুলোর অন্তত একটিতে দেখা গেছে, বিশালাকৃতির দরজার উপরে ঘুড়ি আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, দরজাগুলোর বয়স ৯,০০০ বছর বা তার চেয়েও বেশি হতে পারে।

দরজাগুলোর অধিকাংশই পাওয়া গেছে সৌদি আরবের হ্যারেট তথা আগ্নেয়গিরি নিঃসৃত লাভা থেকে তৈরি সমভূমিতে, যেখানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কোনো পানির উৎস নেই এবং যা কৃষিকর্মের জন্য ও মানুষের বসবাসের জন্য খুবই অনুপযোগী। কেনেডির মতে, হাজার হাজার বছর আগে অবশ্য এই অঞ্চল এরকম ছিল না। সে সময় এটি মানুষের বসবাসের জন্য আরো উপযোগী ছিল। এছাড়াও কয়েকটি দরজার অবস্থান বর্তমানে মৃত আগ্নেয়গিরিগুলোর চূড়ার খুবই কাছাকাছি। আবার, কিছু দরজার অংশবিশেষ লাভা দ্বারা অনেকটাই আবৃত। এসব থেকে ধারণা করা যায়, এদের বয়স লাভার চেয়েও পুরনো। এখান থেকেও দরজাগুলোর বয়স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

পাশাপাশি অবস্থিত অনেকগুলো কি-হোল; Source: New York Times

স্থাপনাগুলো সবই পাথরের নির্মিত। মাঝারি আকৃতির পাথর খন্ড পরপর সাজিয়ে শত শত মিটার লম্বা এসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিটি পাথরের লাইন আসলে খুবই পাশাপাশি অবস্থিত দুই সারি লাইনের সমন্বয়ে গঠিত। পাশাপাশি দুই সারি পাথরের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান অপেক্ষাকৃত ছোট পাথর দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দরজাগুলো সবগুলোর গঠন এক রকম না। কয়েকটি দরজায় দুই পাশে দুইটি খুঁটি মাঝ বরাবর মাত্র একটি পাথরের লাইন দ্বারা সংযুক্ত, যেগুলো ‘I Type Gate’ নামে পরিচিত। আবার কিছু আছে একাধিক লাইন দ্বারা সংযুক্ত, যেগুলোকে দেখতে দ্বি অথবা ত্রিখণ্ডিত আয়তক্ষেত্র বলে মনে হয়।

প্রাচীন মানুষেরা পাথর দিয়ে এই অদ্ভুত স্থাপনাগুলো কেন তৈরি করেছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তবে এগুলো কী কী কাজে ব্যবহৃত হতো, সে সম্পর্কে তারা ধারণা দিয়েছেন। প্রথমত, বিজ্ঞানীরা জানেন যে, ঘুড়িগুলো পশুপাখিকে ফাঁদে ফেলে শিকার করার কাজে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই দরজাগুলোর গঠন শিকারের উপযোগী না। তাছাড়া দরজাগুলোর উচ্চতাও খুবই কম। কি-হোল সহ অন্য কিছু স্থাপনার দেয়ালের উচ্চতা যেখানে ক্ষেত্র বিশেষে ১ মিটার পর্যন্ত দেখা গেছে, সেখানে দরজাগুলোর পাথরের উচ্চতা মাত্র ২০-৪০ সেন্টিমিটার।

১২০০ ফিট লম্বা একটি দরজা; Source: New York Times

দ্বিতীয়ত, এগুলো ঘর বা থাকার জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো না। এগুলো ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির, কিন্তু পাথরের দেয়ালগুলো খুবই নিচু এবং এদের কোনো প্রবেশ পথ নেই। তৃতীয়ত, এগুলো সমাধিস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হতো না। এই অঞ্চলের অন্য কোনো সমাধিক্ষেত্রের সাথে এদের কোনো সাদৃশ্য নেই। ড. কেনেডির ব্যক্তিগত মতামত, পাথরগুলোর এরকম স্থাপনার সাথে কৃষিকাজের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, যদিও তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন।

অন্য অনেক আরব রাষ্ট্রের তুলনায় সৌদি আরব দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজেদের আকাশ সীমার ব্যাপারে অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল। তারা কোনো বিদেশী প্লেনকে গবেষণার কাজেও তাদের আকাশ সীমায় ওড়ার অনুমতি দিত না। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে ডেভিড কেনেডির আবিষ্কারের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে সৌদি আরব ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়।

বিশালাকৃতির ঘুড়ি সদৃশ কাঠানো; Source: destinationksa.com

কেনেডি এবং তার সহকর্মী সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে তিন দিন ধরে খাইবার, উয়ায়রিদ এবং রাহা আগ্নেয়ক্ষেত্রের উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে উড়ে বেড়ান এবং অন্তত ৬,০০০ ছবি ধারণ করেন। কেনেডি আশা করেন, গুগল আর্থের লো রেজুলিউশন ছবির তুলনায় অনেক কাছ থেকে তোলা উচ্চমানের এসব ছবি এই রহস্যের সমাধানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অচিরেই হয়তো সমাধান হবে, ৯,০০০ বছর আগে যখন মানুষ চাকার ব্যবহারও জানত না, তখন ঠিক কী উদ্দেশ্যে তারা এই বিশাল আকৃতির স্থাপনাগুলো তৈরি করেছিল।

ফিচার ইমেজ- LiveScience.com

Related Articles