পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে জলের অসংখ্য আধার। মহাসাগর, সাগর, উপসাগর, হ্রদ, নদী ছাড়াও রয়েছে গভীর-অগভীর বহু জলাভূমি। জলের এই উৎসগুলোর তলদেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। জলের এই আধারগুলোর তলদেশে রয়েছে স্থলভূমি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ। সেখানে রয়েছে অদ্ভুত দেখতে সব জীব, অদ্ভুত আকৃতির পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, শৈলশিরা- আরও কত কী! এর সামান্যই আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের জানার বাইরে রয়েছে বিশাল এক জলজগত। প্রতিনিয়ত মানুষ অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে এই জগতকে জানার জন্য।
সাগর-মহাসাগর আর নদীর তলদেশে যেমন অনেক প্রাকৃতিক জিনিস রয়েছে, তেমন মানুষের নির্মিত অনেক কাঠামোও পাওয়া যায়। যেমন: সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, ঝড়-তুফানে ডুবে যাওয়া জাহাজ, নৌকা, উড়োজাহাজ, যুদ্ধ বিমান এবং আরও অনেক কিছু। এসব ধ্বংসাবশেষের মাঝে প্রায়ই এমন কিছু দেখা যায়, যা অনেক স্বাভাবিকের সংগায় উতরোয় না। ঠিক এমনই এক অস্বাভাবিক জিনিসের দেখা পাওয়া যায় বাল্টিক সাগরের তলদেশে।
২০১১ সালের গ্রীষ্মকাল। ওশেন-এক্স নামে একদল ট্রেজার হান্টার বাল্টিক সাগরের তলদেশে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মধ্যবর্তী জায়গায় একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজছিলেন। তাদের কাছে ছিল আধুনিক সোনার যন্ত্র (প্রতিফলিত শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে জলের নিচে নিমজ্জিত বস্তু সনাক্ত এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি ধারণ করার যন্ত্র)। হঠাৎ তাদের যন্ত্রে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়ে। টিমের প্রধান দুই পার্টনার লিন্ডবার্গ এবং অ্যাসবার্গ সোনারের মনিটরে দেখতে পান জলের ৮৫-৯০ মিটার নিচে গোলাকার একটি বস্তু। তাদের ভাষ্যমতে, বস্তুটি ২০০ ফুট জায়গা জুড়ে ছিল। বস্তুটির দেখতে কোনো সাধারণ পাথরের টুকরো বা পাহাড়ের মতো লাগছিল না। বরং এতে সিঁড়ি, র্যাম্প এবং আরও কিছু আকৃতি দেখা যায়, যা প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় না।
তারা আরও দাবি করেন, যখন তাদের জাহাজ বস্তুটির উপরে ছিল, তখন তাদের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এমনকি স্যাটেলাইট ফোনও কাজ করছিল না।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণে জাহাজের লোকেরা স্টকহোম বন্দরে ফিরে আসেন। টিম মেম্বাররা কয়েক সপ্তাহ ধরে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নেন, এ ঘটনা বাইরের কাউকে বলবেন না। কয়েকমাস চেষ্টার পরও তারা এই বস্তুর কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেন না। তখন বাধ্য হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে ঘটনাটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করবেন। পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অনলাইন আর টেলিভিশনের মাধ্যমে পুরো দুনিয়ার মানুষ জানতে পেরে যায় এই বিষয়ে। সংবাদ মাধ্যমগুলো এটিকে এলিয়েন স্পেস-শিপ হিসেবে প্রচার করে। ঘটনাটি জনপ্রিয়তাও পায় রাতারাতি।
অনলাইনে কয়েকটি ওয়েবসাইট খোলা হয় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। রেডিও, টেলিভিশনে এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষকের মতামত প্রকাশিত হতে থাকে। ওশেন-এক্স দলও বসে থাকেনি। তারা দ্বিতীয়বার ওই স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এক বছর পর কয়েকজন স্পন্সরের অর্থায়নে তারা স্থানটিতে যাওয়ার মতো জাহাজ এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যোগাড় করেন। কিন্তু যাত্রার দিন ভাগ্য তাদের সহায় হয় না। আবহাওয়া অনেক খারাপ হয়ে যায়। তারা জাহাজ নিয়ে দু'দিন বন্দরেই বসে থাকেন। এরপর আবহাওয়া ভালো হলে যাত্রা শুরু হয়।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে তারা আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সাগরের তলদেশ স্ক্যান করা শুরু করেন। তাদের নির্দিষ্ট করা জায়গার চারপাশে ১.১৬ বর্গ মাইল জুড়ে একটা এলাকা ঠিক করে স্ক্যান করার জন্য। কিন্তু রহস্যজনক ব্যপার হলো, দলের সদস্যেরা আশেপাশে কয়েকটি নেভি জাহাজ দেখতে পান, যেগুলো ওই একই জায়গায় ঘোরাঘুরি করছে। নেভি জাহাজ দেখে মনে হচ্ছিল, তারাও কিছু একটার সন্ধান করছে। কিছুটা শঙ্কিত হলেও অশেন-এক্স তাদের অনুসন্ধান বন্ধ করেনি। কয়েক ঘণ্টা স্ক্যানিং প্রক্রিয়া চালানোর পর মাঝরাতে হঠাৎ তাদের দুটি সোনার যন্ত্রের একটি হারিয়ে যায়। তারা অবশিষ্ট আরেকটি সোনার কাজে লাগান হারিয়ে যাওয়া সোনারটি খুঁজতে। কয়েক ঘণ্টা পর হারিয়ে যাওয়া সোনারটি খুঁজে পাওয়া যায়।
এত অসুবিধার পরও ভোররাতে আবার স্ক্যানারে বস্তুটির দেখা মেলে। জায়গাটি চিহ্নিত করে দলের সদস্যেরা রিমোট নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রোবট পাঠান। রোবটটি যখন বস্তুটির কাছে পৌঁছায়, তখন ক্যামেরার ফুটেজে তারা দেখতে পান- বস্তুটির উপরের অংশ মনুষ্যনির্মিত কংক্রিটের মতো দেখতে। এবার তারা ডুবুরি নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এবারও অসুবিধা দেখা দেয়। সাগরের পানির তাপমাত্রা মাইনাস ১ ডিগ্রি হয়ে যায়, যা গ্রীষ্মকালে অস্বাভাবিক। চারদিকে ওই সময় ঘন কুয়াশার চাদরও দেখা দেয়। তারপরও তাদের ডুবুরি পানিতে নামেন। পানির নিচে প্রতি মিটার নামার সাথে সাথে আলোর স্বল্পতা দেখা দিতে থাকে।
যখন তারা বস্তুটির কাছে পৌঁছান, সেখানে শুধু অন্ধকারই ছিল। তাদের ফ্ল্যাশলাইটে সামান্যই দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে তারা অবশেষে বস্তুটির কাছে পৌঁছান। প্রথমবার কেউ খালি চোখে বস্তুটি দেখতে পায়। ডুবুরিদের ভাষ্যমতে, বস্তুটি কংক্রিট বা সিমেন্টের মতো। কিন্তু, এর বিশেষত্ব হলো- বস্তুটির উপরিতল দেখলে মনে হচ্ছিল, তা অস্বাভাবিক তাপে পুড়ে গেছে। কারণ, সেটি ছিল কুচকুচে কালো রঙের এবং পোড়া প্লাস্টিকের মতো। ডুবুরিরা ১০ মিনিট জলের নিচে বস্তুটি পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তারা বস্তুটির উপরের পাথর এবং বালি তুলে উপরিতলে ফিরে আসেন। উপরে উঠতে প্রায় ৯০ মিনিট সময় লাগে তাদের। পরদিন সকালে ওশেন-এক্স বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করে।
এরপর শুরু হয় বস্তুটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সোহিস্টোরিস্কা মেরিটাইম মিউজিয়ামের মেরিন আর্কিওলজিস্ট গোরান একবার্গ বলেন, বস্তুটি দেখতে অস্বাভাবিক হলেও তা প্রকৃতির সৃষ্টি। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ভোলকার ব্রাকার্ট বস্তুটির উপর থেকে তুলে আনা পাথর এবং বালির নমুনা পরীক্ষা করেন। তিনি বলেন যে, পাথরগুলো হয়তো আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট এবং বস্তুটি হয়তো তুষারযুগের সময় থেকেই ওখানে রয়েছে। কিন্তু তিনি এর সাথে আরও বলেন, যে পাথরগুলো ওখান থেকে তুলে আনা হয়েছে, ওগুলো খুব সম্ভব বস্তুটিকে ঢেকে রেখেছে। এই প্রাকৃতিক পাথরগুলোর নিচে কোনো কৃত্রিম বস্তু থাকবার সম্ভাবনার কথাও তিনি বলেন।
এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশনে এই ঘটনাকে ওশেন-এক্স দলের ধাপ্পাবাজি বলা হতে থাকে। স্পন্সররা তাদের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। তবুও এই ঘটনায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা খুব একটা কমেনি। বিশ্বজুড়ে গবেষকরা বিভিন্ন মতবাদ দিতে থাকেন বস্তুটি নিয়ে। মূল ধারার বিজ্ঞানীরা বলেন, বস্তুটি কোনো আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে সৃষ্ট। আবার কেউ কেউ বলেন, ওটা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া কোনো কেবল ব্যারেল। অনেকে আবার যুক্তি দেন, বস্তুটি জার্মানির নাৎসি বাহিনীর কোনো সিগন্যাল জ্যামিং ডিভাইস। কারণ অঞ্চলটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো। বাল্টিক সাগরের ওই অংশে প্রচুর মাইন পাতা হতো তখনকারর সময়ে। এছাড়া ডুবোজাহাজ চলাচলের জন্য খুব ভালো জলপথও এটি। জার্মানির সামরিক বাহিনীর গোপন নথি থেকে জানা যায়, বাল্টিক সাগরে তারা কিছু সিগন্যাল জ্যামিং ডিভাইস স্থাপন করে। এই যুক্তিটি অনেক জোরালো, কিন্তু প্রশ্ন হলো- এত বিশাল একটি যন্ত্র জার্মানরা সেখানে নিল কীভাবে?
এছাড়া আরেকটি মতবাদ বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয়- বস্তুটি বহির্জাগতিক। কেউ কেউ বলে, বস্তুটি কোনো উল্কাপিণ্ড, যা মহাকাশ থেকে এসেছে। আবার কেউ বলে, বস্তুটি কোনো মহাকাশ যান। এটি বলার কারণ বস্তুটির অদ্ভুত আকৃতি আর পুড়ে যাওয়া কৃষ্ণবর্ণ কংক্রিটের স্ল্যাবের মতো উপরিতল। যখন কোনো বস্তু মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রচণ্ড গতিতে প্রবেশ করে, তখন তাপে এরকম চেহারা লাভ করে। এছাড়াও এই মতবাদে বিশ্বাসী লোকেরা বলেন যে, এতে বিশেষ কোনো যন্ত্র থাকার কারণে এর উপরে গেলে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করে না।
বিশ্বজুড়ে মানুষ বিভিন্ন মতবাদ দিলেও বাল্টিক সাগরের এই রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। নৌ বাহিনীও এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। কেটে গেছে বহু বছর। ইন্টারনেটে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে এই ব্যাপারে। ওশেন-এক্স এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে স্পন্সর যোগাড় করে আবার ওই স্থানে গিয়ে অনুসন্ধান চালাতে। তারা এই রহস্য সমাধান করার জন্য বদ্ধপরিকর। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো এই রহস্যের সমাধান হবে, বা কখনোই হয়তো জানা যাবে না বাল্টিক সাগরের তলদেশে আসলে ঠিক কী ঘটেছিল।
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
This article is about a strange, circular object found at the bottom of Baltic Sea in 2011 continues to baffle scientists. Some people call it a fake but alien hunters have their own theories.
Featured image: time-loops.net