প্রতিবারের মতো যথাসময়ে এবারও সুইডেনের বিখ্যাত ক্যারোলিনস্কা ইন্সটিটিউট থেকে মেডিসিনে বা শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুজনকে যৌথভাবে পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আমাদের দেহে গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি, যেমন- তাপমাত্রা, স্পর্শ ঠিক কীভাবে কাজ করে, সেই বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য এবারের চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল অর্জন করে নিয়েছেন আর্ডেম পাটাপুটিয়ান, এবং ডেভিড জুলিয়াস। চলুন, জেনে নেয়া যাক এই দুই নোবেলজয়ীর পরিচয় এবং আবিষ্কার কাহিনি।
আর্ডেম পাটাপুটিয়ান (Ardem Patapoutian) একজন আমেরিকান মলিকুলার বায়োলজিস্ট, নিউরো সায়েন্টিস্ট। তার জন্ম লেবাননের বৈরুতে হলেও পরবর্তীতে আমেরিকায় চলে আসেন এবং সেখানেই বাকি পড়াশোনার সম্পন্ন করেন। বৈরুতে থাকাবস্থায় তিনি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ছাত্র ছিলেন। আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রী অর্জন করেন। পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ফ্রান্সিসকোতে পোস্টডক করার সময় তিনি কিছু বিশেষ নিউরন নিয়ে পড়াশোনা করেন যারা আমাদের দেহে ব্যথা এবং স্পর্শের অনুভূতি জোগায়।
অপর নোবেলজয়ী ডেভিড জুলিয়াস (David Jay Julius) ব্রিংটন ব্রিজ, ব্রুকলিন, আমেরিকাতে জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে তিনি তার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে থেকে পিএইচডি গবেষণা, এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্টডক্টোরাল ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে, এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময় তিনি সাইলোসাইবিন মাশরুম, এবং এলএসডি নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। পরবর্তীতে এই গবেষণা থেকেই এই জিনিসগুলো কীভাবে মানবদেহের বিভিন্ন রিসেপ্টরের সাথে কাজ করে, সেই বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহী হন। আমাদের অতিপরিচিত মরিচ থেকে প্রাপ্ত 'ক্যাপসাইসিন' যৌগ যেটা 'জ্বলুনির অনুভূতি' তৈরি করে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে ডেভিড জুলিয়াস শরীরের চামড়ায় থাকা নার্ভ-এন্ডিং-এ একটি সেন্সর খুঁজে বের করেন, যা তাপের প্রতি সংবেদনশীল।
আর আর্ডেম পাটাপুটিয়ান 'প্রেশার সেনসিটিভ' কোষ ব্যবহার করে এমন কিছু নতুন প্রজাতির সেন্সর আবিষ্কার করেন, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, এবং চামড়ার যান্ত্রিক সংবেদনে উদ্দীপ্ত হয়। এই ধরনের আবিষ্কার আমাদের বুঝতে সহায়তা করছে কীভাবে আমাদের নার্ভাস সিস্টেম তাপ, ঠাণ্ডা, এবং যান্ত্রিক সংবেদনের প্রতি উদ্দীপিত হয়। নোবেল বিজয়ী এই দুজন এমন এক জিনিস খুঁজে পেয়েছেন, যা আমাদের অনুভূতি এবং পরিবেশের জটিল মিথষ্ক্রিয়ার 'মিসিং লিংককে' খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।
সপ্তদশ শতকে, দার্শনিক রেনে দেকার্ত আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়ার সাথে আমাদের মস্তিষ্কের কোনো একটা সংযোগ থাকতে পারে বলে ধারণা করেন। পরবর্তীতে স্পেশালাইজড অনুভূতিবাহী নিউরনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। ১৯৪৪ সালে জোসেফ আরল্যাঞ্জার এবং হার্বাট গ্যাসার শারীরতত্ত্বে নোবেল পান বিভিন্ন ধরনের অনুভূতিবাহী নিউরন ফাইবার আবিষ্কারের জন্য- যা বিভিন্ন সংবেদনের প্রতি উদ্দীপনা দেখাত। ডেভিড জুলিয়াস, এবং আর্ডেম পাটাপুটিয়ানের আবিষ্কারের পূর্বে আমাদের একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন ছিল, কীভাবে আমাদের নার্ভাস সিস্টেমে তাপমাত্রা এবং যান্ত্রিক সংবেদনশীলতা, বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত হয়?
১৯৯০-এর শেষের দিকে, ডেভিড জুলিয়াস ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোতে মরিচে পাওয়া 'ক্যাপসাইসিন' যৌগকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে শরীরে জ্বলুনির অনুভূতি কীভাবে তৈরি হয়- তার একটি সমাধানে আসার সম্ভাবনা আঁচ করেন। ক্যাপসাইসিন যে ব্যথার অনুভূতি তৈরির মাধ্যমে স্নায়ুকোষগুলোকে সক্রিয় করে সেটা বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। কিন্তু এই রাসায়নিক কীভাবে এই কাজটি করে সেটা অজানা ছিল। জুলিয়াস এবং তার সহকর্মীরা মিলিয়ন ডিএনএ খণ্ডাংশের একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলেন যাদের জিনগুলো আমাদের দেহে ব্যথা, তাপ কিংবা স্পর্শের অনুভূতিকে জাগায়।
অনেক গবেষণার পর এমন একটি সিংগেল জিন পাওয়া গেল, যেটা কোষকে ক্যাপসাইসিনের প্রতি সংবেদনশীল করে। অবশেষে ক্যাপসাইসিনের প্রতি অনুভূতিবাহী জিন পাওয়া গেল। পরবর্তীতে করা বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া যায়, ওই নির্দিষ্ট জিনটি একটি নতুন প্রজাতির আয়ন চ্যানেল প্রোটিনকে এনকোড করে, এবং নতুন আবিষ্কৃত ক্যাপসাইসিন রিসেপ্টরটির নামকরণ করা হয় TRPV1। জুলিয়াস যখন তাপের প্রতি প্রোটিনটির সংবেদন করার সক্ষমতার পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি উপলব্ধি করেন তিনি আসলে এমন একটি 'হিট সেন্সিং রিসেপ্টর' আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যা তাপমাত্রার প্রতি অনুভূতিকে ব্যথাদায়ক হিসেবে সক্রিয় করে তোলে।
অন্যদিকে, আলাদাভাবে ডেভিড জুলিয়াস, ও পাটাপুটিয়ান 'মেনথল' নামের একটি রাসায়নিক ব্যবহার করে TRPM8 আবিষ্কার করেন- যা ঠাণ্ডার প্রতি অনুভূতিশীলতা দেখায়। এই পরীক্ষাগুলো মূলত বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে 'জেনেটিক্যালি ম্যানুপুলেটেড' ইঁদুরের উপর চালিয়ে জিনগুলো আবিষ্কার করা হয়।
গবেষকরা পূর্বেই ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে 'মেকানিক্যাল সেন্সর' খুঁজে পেয়েছিলেন কিন্তু মেরুদণ্ডীদের মতো জটিল প্রাণীর মধ্যে মেকানিজমটি কীভাবে কাজ করে সেটা জানতেন না। পাটাপুটিয়ান, এবং তার সহকর্মীরা স্ক্যাপস রিসার্চ ল্যাবে গবেষণা করে এক নতুন 'মেকানোসেনসিটিভ আয়ন চ্যানেল' আবিষ্কার করেন। সেই আয়ন চ্যানেলের নাম দেন Piezo1। পরে এই জিনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আবিষ্কার করেন এবং নাম দেন Piezo2। এই আবিষ্কার থেকে বোঝা যায়- এই জিন দুটি 'সেন্স অব টাচ' এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ! অর্থাৎ, রক্তচাপ, শ্বাস প্রশ্বাস এবং মূত্রথলি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
TRPV1 জিন তাপমাত্রা, এবং বিভিন্ন রকমের হিট পেইন, যেমন- প্রদাহজনিত ব্যথা, মস্তিষ্কজনিত ব্যথা, বিভিন্ন অঙ্গের ব্যথা ইত্যাদিতে সংবেদনশীলতা দেখায়. অপরদিকে Piezo2 নামের জিন যান্ত্রিক ব্যথা, ইউরিনেশন, শ্বাস প্রশ্বাস, রক্তচাপ, বডি মুভমেন্ট ইত্যাদির প্রতি সংবেদনশীল।
ডেভিড জুলিয়াস এবং পাটাপুটিয়ানের এই আবিষ্কার 'ক্রোনিক পেইন'-এর মতো বিভিন্ন রোগের কন্ডিশনের চিকিৎসার জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করবে। চিকিৎসা জগতে একটি নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে বলে আশা করা যায়।
Language: Bangla
Topic: Nobel prize in medicine 2021
Reference:
1. Mechanisms of Chili’s Heat, Menthol’s Cool Garner Nobel - The Scientist
2. Press release: The Nobel Prize in Physiology or Medicine 2021 - Nobel Prize Organization