Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানব বিবর্তনের গবেষণায় চিকিৎসায় নোবেল

চিকিৎসায় ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সোয়ান্তে পেবো (Svante Pääbo)। বিলুপ্ত হোমিনিনদের জিনোম আবিষ্কার ও মানব বিবর্তনবিষয়ক গবেষণার জন্য তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। মানুষের উৎপত্তি ও পৃথিবীতে অনন্য এক প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিচরণের ব্যাপারে আমাদের কৌতূহল রয়েছে সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই। প্রত্নতত্ত্ব ও জীবাশ্মবিদ্যার সহায়তায় ফসিল থেকে পাওয়া হাড়ের আকার-আকৃতি বিশ্লেষণ করে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টাও তাই বিদ্যমান অনেক আগে থেকেই। 

কিন্তু কালের বিবর্তনে মানব বিবর্তনের গবেষণাতেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। একসময় মানুষের হাতে এসে পৌঁছল জিনোম সিকুয়েন্সিং প্রযুক্তি। জিনোম উন্মোচনের মাধ্যমে মানুষের বিবর্তনের গবেষণায় শুরু হলো নতুন যুগের। কিন্তু হাজার হাজার বছরের পুরনো এসব ফসিল থেকে ডিএনএ পৃথক করে জিনোম সিকুয়েন্স করা মোটেও সহজ কোনো কাজ না। 

আর ‘আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব’ এমন কাজই সম্ভব করে দেখিয়েছেন সোয়ান্তে পেবো। মানুষের নিকটতম প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালদের জিনোম সিকুয়েন্স করেছেন তিনি। একইসঙ্গে আবিষ্কার করেছেন নতুন এক হোমিনিন সদস্য, যার নাম ‘ডেনিসোভা’। তিনি দেখিয়েছেন- বিলুপ্ত এসব প্রজাতির সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্সের জিন বিনিময় হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, যার প্রমাণ এখনও রয়ে গেছে মানুষের শরীরে। এছাড়া, পেবোর গবেষণা ‘প্যালিওজিনোমিকস’ নামে বিজ্ঞানের একদম নতুন এক শাখার সূচনা করেছে।

হোমিনিন কারা?

হোমিনিন হলো হোমিনিনি ‘ট্রাইব’-এর অন্তর্ভুক্ত সকল প্রাণী। আধুনিক মানুষ যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনই নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতি, অস্ট্রালোপিথিকাসসহ অন্যান্য অনেক বিলুপ্ত গণও এর অন্তর্গত। তবে মানুষের কাছের বিলুপ্ত নিয়ান্ডার্থাল, হোমো ইরেক্টাস প্রভৃতি ও অস্ট্রালোপিথিকাসদের বোঝাতেই ‘হোমোনিন’ টার্ম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, যাদের বর্তমানে শুধু ফসিল হিসেবেই পাওয়া যায়।

কিন্তু এই বিলুপ্ত হোমিনিনদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? আমরা (হোমো স্যাপিয়েন্স) বাকি হোমিনিনদের থেকে কীভাবে আলাদা? এমন সব প্রশ্নেরই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সোয়ান্তে পেবো।

ড. সোয়ান্তে পেবোর হাতে নিয়ান্ডার্থালদের মাথার খুলি; Image source: Frank Vinken/ Max Planck Society

নিয়ান্ডার্থালদের জিনোম উন্মোচন

একসময় বিভিন্ন জায়গায় প্রাপ্ত বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর ফসিল থেকে পাওয়া হাড় বিশ্লেষণ করে বিবর্তনের প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা হতো। প্রত্নতত্ত্ব ও জীবাশ্মবিদ্যার সহায়তায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন- প্রায় তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সের উৎপত্তি হয়। 

আর সাত লাখ বছর আগে আফ্রিকার বাইরে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় উৎপত্তি হয় মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালদের। প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায় এ নিয়ান্ডার্থালরা। তারা বিলুপ্ত হবার আগেই, প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে, অনেক হোমো স্যাপিয়েন্স উৎপত্তিস্থল আফ্রিকার বাইরে স্থানান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে । তাই একটা লম্বা সময় হোমো স্যাপিয়েন্স আর নিয়ান্ডার্থাল ছিল একসঙ্গে। কিন্তু এই নিয়ান্ডার্থালদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? ততদিনে মানুষের বিবর্তনের গবেষণায় জিনোম সিকুয়েন্সিংকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। তাই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় ডিএনএ-ই আমাদের নিখুঁতভাবে সাহায্য করতে পারে। 

কিন্তু হাজার হাজার বছরের পুরনো এসব ফসিল থেকে ডিএনএ পৃথক করা মোটেই সহজ কোনো কাজ না। ডিএনএ কালের আবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। হাজার হাজার বছর পর খুব অল্প পরিমাণ ডিএনএ শুধু বাকি থাকে। আবার সেই ডিএনএ-তেও অন্যান্য জীবের ডিএনএ মিশ্রিত থাকে। ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে আধুনিক মানুষের ডিএনএ পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে সেখানে। তাই ‘আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব’ বলে মনে হয় এমন কাজ! 

কিন্তু ‘আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব’ এই সমস্যারই সমাধান খুঁজে বের করতে লেগে গেলেন বিজ্ঞানী সোয়ান্তে পেবো। আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আগ্রহী হয়ে পড়েন এমন কাজে। শুরু করেন প্রাচীন মমি থেকে ডিএনএ পৃথক করার চেষ্টার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে নিয়ান্ডার্থালদের ডিএনএ থেকে জিনোম উন্মোচনের গবেষণাকেই নিজের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করে নেন। নব্য আবিষ্কৃত পিসিআর প্রযুক্তি আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয় তার কাছে। এর সাহায্যে ক্ষুদ্র এক খণ্ড ডিএনএ-ও খুঁজে বের করা সম্ভব। ১৯৮৮ সালে পেবো ও উইলসন প্রথমবার প্রাচীন ফসিল থেকে ডিএনএ খোঁজার চেষ্টায় ব্যবহার করলেন এই প্রযুক্তি। কিন্তু এখানেও সেই আগের সমস্যা- প্রাচীন সেই ডিএনএ-র সাথে ব্যাকটেরিয়াসহ আধুনিক মানুষের ডিএনএ কিছুতেই পৃথক করা যাচ্ছে না। 

তাই দরকার হলো নতুন উদ্যমের, নতুন কিছু উদ্ভাবনের। পেবো সফল হলেন এখানেই। এ সমস্যার সমাধানে সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন কক্ষে পরীক্ষণ, নিম্ন তাপমাত্রায় ডিএনএ সংরক্ষণ, সিলিকাভিত্তিক পরিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তিসহ নানা পদ্ধতি খুঁজে বের করলেন। 

কোষে ডিএনএ শুধু নিউক্লিয়াসেই থাকে না, এর পাশাপাশি মাইটোকন্ড্রিয়াতেও থাকে। নিউক্লিয়াসের ডিএনএ-র তুলনায় মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ অনেক ছোট। কিন্তু কোষে নিউক্লিয়াসের ডিএনএ থাকে মাত্র এক জোড়া, আর মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ থাকে শত শত কপি। তাই হাজার বছর পরেও এই ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব। পেবো তাই প্রথমে চেষ্টা করলেন এই মাইটোকন্ড্রিয়ায় পাওয়া ডিএনএ-র উপর। চল্লিশ হাজার বছর পূর্বের নিয়ান্ডার্থালদের হাড় থেকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ সিকুয়েন্স করতে সক্ষম হলেন তিনি।

কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াস ও মাইটোকন্ড্রিয়া দুই জায়গাতেই থাকে ডিএনএ। ডিএনএ কালের আবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় ও খুব অল্প পরিমাণই অবশিষ্ট থাকে; Image source: nobelprize.org

কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আবার শুধুমাত্র মায়ের দ্বারা বংশানুক্রমে বাহিত হয়। তাই কোনো মায়ের শুধু ছেলেসন্তান থাকলে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ভ্যারিয়েন্টের বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকে, যা নিউক্লিয়ার ডিএনএ-তে নেই। তাই পেবো এবার জোর দিলেন নিয়ান্ডার্থালদের নিউক্লিয়াসে প্রাপ্ত ডিএনএ থেকে জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ে। 

জার্মানিতে নিজের প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভলুশনারি অ্যানথ্রোপলোজিতে নতুন উদ্যমে শুরু করলেন গবেষণা। অবশেষে ২০১০ সালে তিন নারী নিয়ান্ডার্থালারের হাড় থেকে ডিএনএ পৃথক করে জিনোম সিকুয়েন্স করতে সক্ষম হয় পেবো ও তার দল। ইতোপূর্বে বিশ শতকের শেষ দিকে আবার মানুষের জিনোম সিকুয়েন্সিং করা সম্ভব হয়েছে।

এবার সবকিছু মিলিয়ে দেখার পালা। পেবো আবিষ্কার করলেন- আফ্রিকার মানুষের চেয়ে আফ্রিকার বাইরের মানুষের জিনোমের সঙ্গে নিয়ান্ডার্থাল জিনের মিল বেশি। ইউরোপীয় ও এশীয় ১-৪% মানুষের রয়েছে নিয়ান্ডার্থালদের জিন। অর্থাৎ মানুষ যখন উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা ছেড়ে স্থানান্তরিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই নিয়ান্ডার্থালদের সাথে এ জিন বিনিময় ঘটে। 

ডেনিসোভা হোমিনিনদের আবিষ্কার

২০০৮ সাল; সাইবেরিয়ার দক্ষিণে ডেনিসোভা গুহা থেকে আবিষ্কৃত হলো চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো এক আঙুলের হাড়। সোয়ান্তে পেবো এর জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখতে পান- এটি আধুনিক মানুষ বা নিয়ান্ডার্থাল কারো নয়। এই প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নতুন একটি হোমিনিন আবিষ্কার করা সম্ভব হলো। নাম দেওয়া হলো ‘ডেনিসোভা’।

শুধু তা-ই নয়, আধুনিক মানুষের সাথে ডেনিসোভার জিন মিলিয়ে দেখা গেল- ডেনিসোভা ও মানুষের মধ্যেও একসময় জিনের বিনিময় ঘটেছে। শুরুর দিকে মেলানেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মধ্যে ৬% পর্যন্ত ডেনিসোভানদের ডিএনএ পাওয়া যায়। 

প্যালিওজিনোমিকস

বিজ্ঞানী পেবোর আবিষ্কার আমাদেরকে বিবর্তন সম্পর্কে নতুন এক ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে। তার আবিষ্কার বলছে- হোমো স্যাপিয়েন্সের আফ্রিকা থেকে স্থানান্তরের সময় কমপক্ষে দুটি হোমিনিন প্রজাতি ইউরেশিয়ায় বিদ্যমান ছিল। নিয়ান্ডার্থালরা ছিল পশ্চিমে আর ডেনিসোভানরা পূর্বে। আর ঠিক এই সময়েই মানুষের সাথে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভানদের জিন বিনিময় ঘটে। জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন ডেনিসোভানদের আবিষ্কার ও পরবর্তীতে নানা গবেষণা বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখার সূচনা করে- প্যালিওজিনোমিকস। 

ইউরেশিয়ার পশ্চিমে অবস্থান ছিল নিয়ান্ডার্থালদের ও ডেনিসোভার অবস্থান ছিল পূর্বে। আর ঠিক এই সময়েই মানুষের সাথে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভানদের জিন বিনিময় ঘটে; Image source: nobelprize.org

সোয়ান্তে পেবোর আবিষ্কার আমাদের আরও বলছে- বিলুপ্ত হোমিনিনদের কিছু জিন এখনও আমাদের মধ্যে আছে। যেমন: তিব্বতের মানুষদের মধ্যে দেখা যায় EPSA1 জিনের ডেনিসোভান সংস্করণ, যা তাদের পাহাড়ের উপর কম অক্সিজেনের মধ্যে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেখা যায়- যেসব ব্যক্তির মধ্যে নিয়ান্ডার্থালদের জিন ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে, তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।

তার এমনসব গবেষণা পৃথিবীতে এক অনন্য প্রজাতি হিসেবে মানুষের পথচলার কারণ অনুসন্ধানের ভিত্তি  হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পৃথিবীতে এক অনন্য প্রজাতি হিসেবে মানুষের পথচলার কারণ অনুসন্ধানের ভিত্তি  হিসেবে কাজ করবে বিজ্ঞানী পেবোর গবেষণা; Image source: nobelprize.org

নেপথ্যের নায়ক

১৯৫৫ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন সোয়ান্তে পেবো। আপসালা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৬ সালে পিএইচডি করেন তিনি। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ছিলেন।  ১৯৯০ সালে জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ড. পেবো। ১৯৯৯ সালে জার্মানির লিপজিগে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভলুশনারি অ্যানথ্রোপলজি প্রতিষ্ঠা করে গবেষণার কাজ চালিয়ে যান তিনি। এছাড়া ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর হিসেবেও যুক্ত আছেন সোয়ান্তে পেবো। 

Language: Bangla

Topic: Nobel Prize in Physiology or Medicine 2022

Necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Niklas Elmehed © Nobel Prize Outreach

 

Related Articles