চলমান মহামারির মধ্যেই বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর আকাশে ওজোন স্তরে ১০ লাখ বর্গ কিলোমিটারের একটি বিশাল গর্ত সৃষ্টির খবর দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থ অবজারভেশন প্রোগ্রাম 'কোপারনিকাস'। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ওজোনে এ গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় ভয়াবহ আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। এর ফলে সরাসরি হুমকির মুখে পড়ত পৃথিবীবাসী। তবে সেই গর্ত নিজে থেকেই আবার সারিয়ে তুলেছে পৃথিবী। কোপারনিকাস এক টুইট বার্তায় সে খবরই দিল ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল।
ওজোন স্তর কী?
উচ্চতা, উষ্ণতা ও উপাদানের ভিত্তিতে পৃথিবীর চতুর্দিকের বায়ুমন্ডলকে ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, আয়নোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার, ম্যাগনেটোস্ফিয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়েছে।
ওজোন স্তরের ৯০ শতাংশই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে থাকে, এই স্তরটি হলো আমাদের গ্রহে আটকে থাকা প্রতিরক্ষামূলক গ্যাসের ভর। সাধারণত এর অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০-১৭ কিলোমিটারের মধ্যে শুরু হয়ে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯৩০ সালে প্রথম ওজোন স্তরের খোঁজ পান। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ জি এম বি ডবসন এ স্তর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনি ওজোন পর্যবেক্ষণ স্টেশনসমূহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন।
ওজোন স্তরে ওজোনের পরিমাণ খুবই কম। প্রতি ১০ মিলিয়ন বায়ুকণার মধ্যে গড়ে তিনটি ওজোন কণা থাকতে পারে। ওজোনের এ ঘনত্ব কম হলেও পৃথিবীর জন্য এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ওজোন স্তরের কারণে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের তাপ বাড়তে থাকে, কারণ সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ এই স্তরে এসে বাধা পায়, অর্থাৎ শোষিত হয়ে যায়। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর মধ্যম মাত্রার (তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) শতকরা ৯৭-৯৯ অংশই শোষণ করে নেয়, যা কি না ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত জীবনসমূহের ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম।
মধ্যম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সূর্যের এই অতিবেগুনি রশ্মি মানব দেহের ত্বক, এমনকি হাড়ের ক্যান্সারসহ অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টিতে সমর্থ। এই ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীর জীবজগতের সকল প্রাণের জন্যই তীব্র হুমকিস্বরূপ। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর প্রতিনিয়তই এই মারাত্মক ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রাণীকূলকে রক্ষা করছে।
ওজোন স্তরে গর্ত বা ক্ষয় হয় কীভাবে?
ওজোন অণু, যা কেবলমাত্র তিনটি অক্সিজেনযুক্ত পরমাণু দিয়ে তৈরি, সর্বদা ধ্বংস হয়ে প্রাকৃতিকভাবে সংস্কার হয়ে যাচ্ছে। তবে বাতাসে থাকা সিএফসি (ক্লোরোফ্লুরো কার্বন) ওজোনের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বাধা দিচ্ছে, যে কারণে সংস্কার প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে যায়। ওজোন স্তর, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কেবলমাত্র ০.০০০০৬ শতাংশ তৈরি করে, প্রতিনিয়ত পাতলা হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এই পাতলা হওয়ার দরুন ওজোন স্তরে একধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়।
সাধারণত ওজোন স্তরে দু'ধরনের ক্ষত সৃষ্টির ব্যাপারে জানা যায়, যেগুলো প্রায় একরকমই। প্রথমটি খুবই ধীরগতিতে ঘটে, যাতে ক্ষতের পরিমাণ এক দশকে প্রায় ৪ শতাংশ। ১৯৭০ এর দশক থেকে এটি নিয়মিত ঘটছে। অন্যটি বড় পরিসরে মেরু অঞ্চলে মৌসুমভিত্তিক ঘটে।
ওজোন হ্রাসের জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে, তবে উভয় প্রবণতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি হচ্ছে পারমাণবিক ক্লোরিন এবং ব্রোমিন দ্বারা ওজোনটির অনুঘটক ধ্বংস করা। উভয়ই বায়ুমণ্ডলে ফোটনগুলোর মাধ্যমে ভেঙে যাওয়া ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) থেকে আসে। এই সিএফসি মূলত মানুষের তৈরি একধরনের রাসায়নিক, যার বড় উৎস বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনার। এরা বায়ুমণ্ডলে স্থিতিশীল অবস্থায় ২০-১৩০ বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। এদের এই আপেক্ষিক স্থিতিশীলতার কারণে সিএফসিগুলো বৃষ্টি বা অন্য কোনো উপায়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে না বা অন্যান্য রাসায়নিকের দ্বারা ধ্বংসও হয় না। সিএফসিগুলো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উঠে যায়, যেখানে তারা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়।
এর ফলে তাদের মুক্ত ক্লোরিন নিঃসরণ হয়। ক্লোরিন অক্সিজেনের সাথে প্রতিক্রিয়া করে, যা ওজোন অণুগুলোকে ধ্বংস করার রাসায়নিক প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যায়। শেষ অবধি ওজোনটির দুটি অণু, তিনটি আণবিক অক্সিজেন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। এরপরে ক্লোরিন ওজোন ধ্বংস করতে অক্সিজেনের অণুগুলোর সাথে আবার প্রতিক্রিয়া করে এবং প্রক্রিয়াটি প্রতি অণুতে ১ লাখ বার পুনরাবৃত্তি করে। প্রাকৃতিকভাবে থাকা ক্লোরিনেরও একই প্রভাব রয়েছে ওজোন স্তরে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় এই সিএফসিকে।
উত্তর মেরুর আর্কটিক অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গেলে সেখানকার পোলার ভর্টেক্স বা মেরু ঘূর্ণাবর্ত অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে অঞ্চলটিতে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরিন ও ব্রোমিনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতিও বেড়ে যায়, যা ওজোন স্তরকে নষ্ট করে দিতে সক্ষম।
ওজোন স্তর বাঁচাতে বৈশ্বিক পদক্ষেপ
সত্তরের দশক থেকেই বিশ্ব নেতৃত্বকে ওজোন স্তরের এই নিয়মিত ক্ষয় বেশ ভাবাতে শুরু করে। প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়। ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো এ ইস্যুতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভিয়েনা কনভেনশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো ওজোন স্তরকে সংশোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে এমন মানবিক ক্রিয়াকলাপের ফলে বা ফলস্বরূপ প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে মানবস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মত হয়। এ কনভেনশন একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছিল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যাগুলোর প্রভাব অনুভূত হওয়ার আগে বা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হওয়ার আগেই এটি মোকাবেলায় নীতিগতভাবে সম্মত হন।
এটি আনুষ্ঠানিক রূপ পায় এর বছর দুয়েক পর কানাডার মন্ট্রিলে। ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিলে ৪৬টি দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৭টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর রয়েছে। এ পর্যন্ত মন্ট্রিল প্রটোকল চারবার সংশোধিত হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওজোন স্তর ক্ষয়কারী পদার্থের উৎপাদন এবং ব্যবহার হ্রাসে সম্মত হয়।
দেশগুলো ১৯৯৮ সালের মধ্যে সিএফসির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা, ১৯৯২ সালের মধ্যে হ্যালনের ব্যবহার বন্ধসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই মধ্যে সিদ্ধান্তগুলোর বেশিরভাগই কার্যকর হয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, মন্ট্রিল প্রটোকলের সাফল্যের জন্য ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থগুলোর উৎপাদন এবং ব্যবহার ৯৯ শতাংশ হারে কমেছে। গবেষণা বলছে, এমন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আশির দশকের রূপে ফিরবে ওজোন স্তর। একইসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় বিশ মিলিয়ন মানুষের ত্বকের ক্যান্সারজনিত ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
ওজোন স্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের এক সিদ্ধান্তে ১৯৯৪ সাল থেকে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে।
আর্কটিকে কী হচ্ছে?
গত ৬ এপ্রিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস আর্থ অবজারভেশন সার্ভিস তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পৃথিবীর সর্ব উত্তরের অঞ্চল আর্কটিকে বৃহৎ অংশ জুড়ে ওজোন স্তরের নাজুক অবস্থার কথা জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যান্টার্কটিক ওজোন স্তরের এই গর্ত মূলত ক্লোরিন এবং ব্রোমিনসহ মানবসৃষ্ট রাসায়নিকগুলোর দ্বারা ঘটে। এই রাসায়নিকগুলো শক্তিশালী পোলার ঘূর্ণিগুলোর অভ্যন্তরে জমা হয়, প্রতি শীতে অ্যান্টার্কটিকের উপরে যার বিস্তৃতি ঘটে এবং সেখানে তারা অন্ধকারে রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে। ঘূর্ণিতে তাপমাত্রা মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে এবং মেরুস্তরীয় বায়ু (পিএসসি) গঠন করতে পারে, যা ওজোন স্তর ক্ষয়কারী পদার্থগুলোর সংস্পর্শে এসে এ অঞ্চলে সূর্যের আলো ফিরে এলে ওজোন স্তরের ক্ষতি করে।
প্রায় প্রতি বছরই এমন ঘটে, তবে মন্ট্রিল প্রটোকলের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিগত বছরগুলোয় এই ক্ষয়ের হার তুলনামূলক কম ছিল। এমনকি গত ৩৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালের নভেম্বরে এ ক্ষয়ের হার ছিল সবচেয়ে কম। ২০২০ সালে এই হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে অবশ্য দুটি কারণও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এ বছর আর্কটিকের মেরু ঘূর্ণি অন্যবারের তুলনায় বেশ শক্তিশালী এবং দীর্ঘকালীন ছিল। ২০২০ সালের শুরুর কয়েকমাস যাবত আর্কটিক স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা খুবই কম থাকায় এটি পিএসসি গঠনের জন্যও সুবিধাজনক ছিল। ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে মাস না ঘুরতেই সুখবর দিয়েছে কোপারনিকাস। টুইটারে প্রকাশিত এক বার্তায় তারা নিশ্চিত করেছে যে, আশঙ্কা সৃষ্টিকারী এ গর্তটি নিজে থেকেই মিলিয়ে গেছে। সেখানে তারা এ সম্পর্কিত স্যাটেলাইট ইমেজও প্রকাশ করেছে, যেখানে ক্ষত সেরে ওঠার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তবে এ ঘটনার সাথে কোনোভাবেই করোনাভাইরাস বা লকডাউনের প্রভাবের সম্পর্ক নেই বলে নিশ্চিত করেছে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা। টুইটারে দেয়া এক বার্তায় কোপারনিকাসও বলেছে, করোনাভাইরাসের সাথে ওজোন স্তরের এই ক্ষতের কোনো সম্পর্ক নেই।
This is a Bangla article. This is about the decaying of the Ozone layer, most important part of the atmosphere. Recent observations are briefly discussed.
Featured Image: New Atlas
References:
1. Earth Finally Fixed Largest Ozone Layer Hole Above Arctic, Healing 1 Million Square Km
4. International Day for the Preservation of the Ozone Layer, 16 September