Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সূর্যের পানে পার্কার সোলার প্রোব

পৃথিবীর জন্মের শুরু থেকেই সূর্য তার সঙ্গী। মানবজাতির উৎপত্তির পর থেকেই সূর্য থেকে উপকার গ্রহণ করে আসছে। পৃথিবীতে যত প্রাণ আছে তাদের প্রায় সবই বেঁচে আছে সূর্যের কৃপায়। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, পরিধান করা, প্রকৃতি দেখা ইত্যাদি যা-ই বলা হোক না কেন তাদের সকলের মাঝেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে সূর্য। প্রাণীজগৎ টিকে আছে সূর্যের কারণে, সভ্যতা গড়ে উঠেছে সূর্যের কারণে। কীভাবে? জানতে হলে দেখুন এখানে

শুধু উপকারই না, সূর্য আমাদের জন্য বড় হুমকিও। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি যদি সরাসরি আমাদের ত্বকে লাগে তাহলে তাতে স্কিন ক্যানসার হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সূর্যের পৃষ্ঠে তৈরি হওয়া ঝড় (Solar Flare) মাঝে মাঝে ধেয়ে আসে পৃথিবীতে। এই ঝড়ে প্রচুর পরিমাণ চার্জিত কণা নিঃসৃত হয়। এই ঘটনায় বিঘ্নিত হয় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। গণ্ডগোল বাধে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও মোবাইল নেটওয়ার্কে। সঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করতে পারে না আবহাওয়া সহ অন্যান্য স্যাটেলাইট। ভূমি থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আকাশে ভাসমান উড়োজাহাজের। বড় ধরনের কোনো ‘সৌর-দুর্ঘটনা’য় পৃথিবীতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে।

সৌর ঝড়ে বিঘ্নিত হতে পারে পৃথিবীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; Image: qrznow.com

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি শুষে নেয়, যার কারণে আমাদের তেমন বেশি ক্ষতি হয় না। কিন্তু যারা বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে থাকে কিংবা ভবিষ্যতে যারা ভিনগ্রহের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করবে তাদের বেলায় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির ঝুঁকিটা থেকেই যায়। এসব থেকে বাঁচতে কিংবা বাঁচার উপায় খুঁজে বের করতে হলে দরকার সূর্যকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা।

কোনো রোগ যখন মানুষকে আক্রমণ করে তখন বিজ্ঞানীরা লেগে যান রোগের জীবাণু কিংবা রোগের উপাদান নিয়ে। শুরুতেই ওষুধ তৈরিতে লেগে যান না। আগে জীবাণুর নাড়ি-নক্ষত্র বের করে তারপর সে অনুযায়ী ওষুধ। জীবাণু সম্বন্ধে আগে ভালোভাবে না জেনে ওষুধ দিলে সেটি হবে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো। তাই সূর্যের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচতে হলে কিংবা সূর্যের শক্তিকে আরো বেশি করে লাজে লাগাতে হলে দরকার সূর্য সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য। সেই তথ্য অর্জনের জন্য পৃথিবীতে বসে এবং পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করে অনেক গবেষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে আর কতদূর হয়? জীবাণুতে আক্রান্ত রোগীর ছবি দেখে গবেষণা করা আর জীবাণুর নমুনা মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে গবেষণা করা কি এক? এক না, আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তেমনই পৃথিবীতে বসে সূর্য সম্বন্ধে গবেষণা করা আর সূর্যের কাছে গিয়ে গবেষণা করার মাঝেও আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

ভূপৃষ্ঠে বসানো একটি সোলার অবজারভেটরি; Image: Institute of Solar-Terrestrial Physics

তাই বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন সূর্যের বুকে নভোযান পাঠাতে। যে যান সূর্যের খুব কাছে গিয়ে সূর্যকে আবর্তন করে করে সূর্যের ছবি তুলে পাঠাবে এবং সূর্য থেকে নিঃসৃত গ্যাসীয় ও চার্জিত কণা নিয়ে গবেষণা করবে।

৬০ বছর হয়ে যাচ্ছে মহাকাশ যুগের। সেই কবে পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে মহাকাশে পা দিয়েছিল। দিনে দিনে মানুষ সৌরজগতের সবগুলো গ্রহের কাছে গিয়েছে, উল্লেখযোগ্য উপগ্রহের কাছেও গিয়েছে। এমনকি সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে আন্তঃনক্ষত্রের পাণেও ছুটছে মানুষের প্রেরিত মহাকাশযান। কিন্তু প্রতিদিন চোখের সামনে থাকা সূর্যের দিকে পাঠানো হয়নি কোনো নভোযান। এ যেন দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুপা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দুর মতো ব্যাপার।

তাই বিজ্ঞানীরা খুব করে চাইলেন সূর্যকে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না, অনুমোদন তো লাগবে। যন্ত্রপাতির ডিজাইনের ব্যাপার, তাদের তৈরি করার ব্যাপার, তাদেরকে মহাকাশযানে করে সূর্যের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপার। অনেক টাকার মামলা। বিজ্ঞানীরা চাইলেই কি আর সাথে সাথে সরকার অনুমোদন দিয়ে দেবে? কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে এর পেছনে যে টাকা ঢালা হবে তা আসলে একদিন লাভ হয়ে ফিরে আসবে আমাদের কাছে। এর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে যদি বিপদ থেকে আগাম সতর্ক হওয়া যায় কিংবা সূর্যের শক্তি আহরণ করে বিদ্যুৎ বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় তাহলে আদতে আমাদের অনেক অনেক লাভ হবে।

২০০৯ সালে অনুমোদন মেলে একটি সোলার প্রোব[1] উৎক্ষেপণের। সেটিই নানা প্রক্রিয়া শেষে উৎক্ষেপণ করা হয় ২০১৮ সালের ১১ই আগস্ট। দীর্ঘ যাত্রা শেষে এটি একসময় সূর্যের কাছে পৌঁছাবে এবং সূর্য সম্বন্ধে অনেক অজানা তথ্য আমাদের জানাবে। এই প্রোবটির নাম দেওয়া হলো পার্কার সোলার প্রোব।

উৎক্ষেপণ মুহূর্তে পার্কার সোলার প্রোব; Image: Astronomy Now
নির্মীয়মাণ পার্কার সোলার প্রোব; Image: NASA

কিন্তু পাঠিয়ে দিলেই তো আর হবে না। সেটি তো সেখানে টিকে থাকতে হবে। সূর্যের তাপ, সে কি যে সে জিনিস? সূর্যের বাইরের স্তর করোনার তাপমাত্রা ১ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। এখানে একটি আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার আছে। সূর্যের ভেতরকার তাপমাত্রা এত বেশি নয়। গড়ে সাড়ে ৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিক হিসেবে ভেতরকার তাপমাত্রার চেয়ে বাইরের তাপমাত্রা কম হবার কথা। কিন্তু কোনো এক কারণে সূর্যে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। কেন? বিজ্ঞানীরা এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। এই রহস্য উদঘাটন করা পার্কার সোলার প্রোবের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

এত বেশি তাপমাত্রায় টিকে থাকার জন্য প্রোবটিকে তৈরি করা হয়েছে বিশেষভাবে। অধিক তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারবে এমন পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে এতে। মূল যন্ত্রটির সামনে বসানো হয়েছে বিশেষ ধরনের সুরক্ষা ঢাল। এর তাপ সহনশীলতা অবিশ্বাস্য। কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। একে বলা হয় ‘হিট শিল্ড’। এটি সূর্যের দিকে মুখ করে থাকবে, ফলে পেছনে থাকা মূল যন্ত্রাংশের মাঝে তাপ পৌঁছাবে না তেমন। তাছাড়াও এর ভেতর আছে অত্যাধুনিক কুলিং সিস্টেম।

পার্কার সোলার প্রোবের হিট শিল্ড। সামনের কালো অংশটি; Image: turbosquid.com

হিট শিল্ড কেমন তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে তা একটি ভিডিও দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ দিয়ে তাপ প্রদান করা হচ্ছে হিট শিল্ডের উপাদানে। পুড়ছে তো না-ই, এমনকি পোড়ার লক্ষণও ধরছে না। যে পাশে প্রবল আগুন দেয়া হচ্ছে তার অপর পাশে একজন অবলীলায় হাত দিয়ে ধরে পরীক্ষা করে দেখছেন উত্তাপ এসেছে কি না এপাশে। আগুনের কোনো খবরই নেই যেন।

সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত দ্রুত বেগে ধাবমান বিভিন্ন ধরনের কণা ও চৌম্বকক্ষেত্র নিঃসৃত হয়। এগুলো সমস্ত সৌরজগতে বিচরণ করে এবং গ্রহগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে। সূর্যের বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে গবেষণা করাও এই প্রোবটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রথম এই ব্যাপারটি সম্পর্কে ধারণা দেন ইউজিন পার্কার নামে একজন বিজ্ঞানী। তার নাম অনুসারেই এই প্রোবটির নামকরণ করা হয়েছে পার্কার সোলার প্রোব।

এই প্রোবটি আরেকটি দিক থেকে বিশেষ। এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র নভোযান যার নামকরণ করা হয়েছে কোনো জীবিত ব্যক্তির নামে।

ইউজিন পার্কার, যার নামে নামকরণ; Image: The New York Times

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একদল বিজ্ঞানীর ডিজাইনে তৈরি এই নভোযানটি কয়েক বছরের ভেতরেই সূর্যের ‘বায়ুমণ্ডল’ স্পর্শ করবে। যানটি সূর্য এবং বুধ গ্রহকে পেচিয়ে আবর্তন করবে। মোট ২৪টি আবর্তনে ধীরে ধীরে এটি ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে আনবে এবং সূর্যের নিকটবর্তী হবে। সূর্যের কাছে আসতে আসতে এক পর্যায়ে এটি সূর্যের বুকে আছড়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

প্রোবটি যাত্রা করেছে মাত্র। সূর্যের কাছে যেতে এখনো অনেক দিন বাকি। কয়েক বছর পর হয়তো আমরা দেখতে পাব এটি সূর্যের অনেক অজানা তথ্য জানাচ্ছে আমাদের। আর ততদিনে সূর্যের দিকে আরো বড় বড় মিশন পাঠানোর সক্ষমতাও হয়ে যাবে আমাদের। এমন একটা দিন হয়তো সত্যিই আসবে যেখানে সূর্যের শক্তিকে বর্তমানের তুলনায় হাজারগুণ বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং সেগুলো দিয়ে অনেক অসাধ্য সাধন করা যাবে। যেগুলো আজকের যুগে প্রায় অসম্ভব বলে ভাবা হচ্ছে সেগুলো সাধারণ বাস্তব বলে বিবেচিত হবে। একদিন হয়তো ঠিকই আসবে যেদিন সূর্য থেকে নিঃসৃত চার্জিত কণা এবং চৌম্বকক্ষেত্র সম্বন্ধে বেরিয়ে আসবে অনেক অজানা তথ্য। সেসব দিয়ে হয়তো মানবজাতির জন্য করে ফেলা যাবে অনেক অবিশ্বাস্য কাজ।

ফুটনোট

[1] স্পেস প্রোব বা প্রোব হলো এমন ধরনের নভোযান যেগুলো পৃথিবীর বাইরে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুকে আবর্তন করে। ভিন্ন কোনো গ্রহ বা উপগ্রহকে আবর্তন করতেই হবে এমন না, পাশ দিয়ে ভ্রমণ করে গেলেও সেটি হবে প্রোব। স্পেস প্রোব কয়েক ধরনের হতে পারে। ল্যান্ডার, যেগুলো বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে অবতরণ বা ল্যান্ড করে। অরবিটার, যেগুলো কোনো গ্রহ, উপগ্রহ কিংবা নক্ষত্রকে আবর্তন বা অরবিট করে। ফ্লাইবাই, যেগুলো কোনো গ্রহ, উপগ্রহ না নক্ষত্রের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। সূর্যকে লক্ষ্য করে যেসব নভোযান পাঠানো হয় সেগুলোকে বলে সোলার প্রোব।

ফিচার ছবি- NASA

Related Articles