Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুক্তা তৈরির কৌশল

বহু শতক ধরেই সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের অনন্য উপাদান হিসেবে মুক্তা করে নিয়েছে এক বিশেষ জায়গা। বিভিন্ন ধরণের জেমস্টোন বা দুর্লভ ক্রিস্টালের মধ্যে মুক্তা একটি অন্যতম রত্ন। এর একমাত্র কারণ হয়তো এই যে মুক্তা জীবিত প্রাণীর অভ্যন্তরেই গঠিত হয়ে থাকে। প্রাণীর অভ্যন্তরে রত্ন তৈরীর এই প্রক্রিয়াও কম আশ্চর্যজনক নয়।

সাধারণত মুক্তা তৈরী হয় বিশেষ প্রজাতির ঝিনুকের (Oyster) দেহাভ্যন্তরে। যদিও এরা ওয়েস্টার ধরণের ঝিনুক না। তবে বাণিজ্যিকভাবে এদের ওয়েস্টার হিসেবে গণ্য করা হয়। ঝিনুকের এই বিশেষ প্রজাতি মোলাস্কা বিভাগের কনকিফেরা উপবিভাগের সদস্য। তবে সব ঝিনুকই মুক্তা উৎপাদন করতে পারে না। গবেষণায় দেখা যায়, মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ৫৩০ মিলিয়ন বছর আগে, যা প্রথম জৈব জেমস্টোন হিসেবে মুক্তার সন্ধান দেয়।

প্রাকৃতিক মুক্তা

সাধারণ অর্থে প্রাকৃতিক মুক্তা খুব একটা পাওয়া যায় না। এখন বেশীরভাগ মুক্তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা তৈরীর ঘটনা খুব দুর্লভ এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। প্রাকৃতিক মুক্তা তৈরী হয় যখন বাহ্যিক কোনো উত্তেজক পদার্থ প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুকের অভ্যন্তরে আটকে যায়। ইতিহাস বলে, পারস্য উপসাগরে প্রাকৃতিক মুক্তার সিংহভাগ পাওয়া যেত একসময়। প্রাকৃতিক মুক্তা সাধারণত অসম আকৃতির হয়ে থাকে। চলুন জানা যাক কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে মুক্তা তৈরী হয়।

প্রাকৃতিক মুক্তা; সূত্র: gemstonebuzz

আগেই বলা হয়েছে, ঝিনুকের অভ্যন্তরে যখন প্রাকৃতিকভাবে বাহ্যিক উত্তেজক পদার্থ (হতে পারে খোলসের ভগ্নাংশ, হাড়ের টুকরা, আঁইশ, এমনকি পরজীবী) আটকে যায়, তখন মুক্তা তৈরী হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশে বিশেষ প্রজাতির ঝিনুকই কেবল মুক্তা তৈরী করতে পারে।

হলুদ রঙের প্রাকৃতিক মুক্তা; সূত্র- gemstonebuzz

যখন এই বাহ্যিক উত্তেজক পদার্থ ভেতরে আটকে গেলো, তখন ঝিনুক নিজেকে প্রতিরক্ষা করতে গিয়ে বাহ্যিক বস্তুটির চারপাশে ন্যাকারের আস্তরণ তৈরী করে এবং ধীরে ধীরে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই আস্তরণ বাড়তে থাকে। ফলে বাহ্যিক উত্তেজক ন্যাকার আস্তরণের মধ্যে থেকে যায়। এই উত্তেজক পদার্থটিকে তখন বলা হয় নিউক্লিয়াস। এই প্রক্রিয়া পরবর্তী বেশ কয়েক বছর ধরে চলে। গঠিত মুক্তার আকৃতি নির্ভর করে নিউক্লিয়াসের আকার-আকৃতি উপর।

সুতরাং বছরের পর বছর এই ন্যাকার আস্তরণে আবৃত হওয়া উত্তেজকই একসময় হয়ে ওঠে মূল্যবান রত্ন। তবে প্রায় দশ হাজার ঝিনুকের মধ্যে প্রায় একটি ঝিনুক মুক্তা তৈরী করতে পারে। আবার সেই মুক্তাটি থেকে সঠিক জেমস্টোন না-ও পাওয়া যাতে পারে। তাই কৃত্রিমভাবে এখন মুক্তার চাষ করা হচ্ছে।

কালচারকৃত মুক্তা

প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা তৈরীর প্রক্রিয়া ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে গবেষকরা এখন কালচার ফার্মেই বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম মুক্তা তৈরী করছেন, যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা জটিল। কাজেই বেশ গুরুত্বের সাথে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আর এ কারণেই মুক্তার দামটাও কিছুটা চড়া হয়ে থাকে। তবে এই মুক্তাগুলো নির্দিষ্ট আকার আকৃতির হয়ে থাকে। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত আকৃতির মুক্তা তৈরী করা যায় এই পদ্ধতিতে।

কৃত্রিম মুক্তা; সূত্র- gia.edu

কৃত্রিম পদ্ধতিতে মুক্তা উৎপাদনের জন্য প্রথমে বিশেষ প্রজাতির ঝিনুক বাছাই করে নেয়া হয় যেগুলো মুক্তা উৎপাদন করতে পারে। শিশু ঝিনুকগুলোকে এরপর কালচার ফার্মে বা সমুদ্রের পানিতে মুক্তা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়, অর্থাৎ পরিপক্ক বয়স না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। কারণ অপরিপক্ক অবস্থায় নিউক্লিয়াস প্রবেশ করালে এদের মৃত্যু হতে পারে। এদের পরিপক্ক হতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যায়।

নিউক্লিয়াস প্রবেশ করানো হচ্ছে। সূত্রঃ northyorkmoorsnationalpark

যা-ই হোক, উপযুক্ত বয়সে কালচার ফার্মে একটি সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে এদের খোলসের ভেতর মাতৃ নিউক্লিয়াসের দানা (Nuclear bead) প্রবেশ করানো হয়। এই নিউক্লিয়াস তৈরী করা হয় মূলত আরেকটি ঝিনুকের কব্জির কাছাকাছি অংশের শাঁস থেকে। কালচার রুমে ঝিনুকের খোলস দুটি খুলে টিক দিয়ে রাখা হয় এবং আরেকটি ঝিনুকের ম্যান্টেলসহ নিউক্লিয়াসকে ঝিনুকের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। বাহ্যিক ম্যান্টেলটি অভ্যন্তরের ম্যান্টেল থেকে ন্যাকার নিঃসরণ ত্বরান্বিত করে।

বিশ্রামে রাখা ঝিনুক; সূত্র- wikimedia commons

অনুপ্রবেশকৃত নিউক্লিয়াসের আকৃতি অনুযায়ী মুক্তা গঠিত হয়। উত্তেজকের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছুক্ষণ এদের বিশ্রামে রাখা হয়। এ অবস্থায়ও কিছু ঝিনুক অসুস্থ হতে পারে বা নিউক্লিয়াস বর্জন করতে পারে অথবা মৃত্যুবরণ করতে পারে। বিশ্রামের পর এদের জাল বা তারজালির তৈরী বড় খাঁচায় ভরে সমুদের বিশেষ জায়গায় (পার্ল বেড) ভাসিয়ে দেয়া হয়। তারপর অপেক্ষা করা হয় কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর।

সী বেডে ভাসিয়ে দেয়া ঝিনুক ভর্তি খাঁচা; সূত্র- framepool.com

এই দুই-তিন বছরের মধ্যে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ন্যাকার আস্তরণ পড়তে থাকে। সবশেষে খাঁচা উঠিয়ে আনা হয় এবং ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ করা হয়। এরপর এদের ব্রাশ করার জন্য পাঠানো হয় যাতে করে এদের উপরিভাগ মসৃণ আর দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। সাধারণত ঠান্ডা পানিতে ন্যাকার নিঃসরণ ধীর গতিতে হয়ে থাকে, ফলে উন্নতমান সম্পন্ন ও উজ্জ্বল মুক্তার জন্য সমদ্রের শীতল অংশে ঝিনুকগুলোকে ভাসানো হয়।

ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ; সূত্র- framepool.com

মুক্তা তৈরীতে নিউক্লিয়াসের পাশাপাশি যে জিনিসটি প্রয়োজনীয় সেটা হচ্ছে ন্যাকার আস্তরণ। কারণ একদিকে যেমন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ন্যাকার আস্তরণ জমে মুক্তা গঠিত হয়, তেমনি অন্যদিকে ন্যাকারের রঙ এবং উজ্জ্বলতার উপর নির্ভর করে মুক্তার রঙ এবং উজ্জ্বলতা। রাসায়নিকভাবে ন্যাকার হচ্ছে জৈব-অজৈব কম্পোজিট পদার্থ, যেখানে প্রায় ৯৫% ভাগ শক্ত কিন্তু ভঙ্গুর ক্যালসিয়াম কার্বোনেট যা আরাগোনাইট নামে পরিচিত। যদিও ঝিনুকের প্রজাতি ভেদে ন্যাকারের উপাদানের ভিন্নতা দেখা যায়।

নোনাপানি ও স্বাদুপানির মুক্তা

প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত মুক্তা আবার নোনাপানি ও স্বাদুপানি– উভয় জলাশয়েই পাওয়া যায়, নির্ভর করে কোন প্রজাতির ঝিনুক ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর।

নোনাপানির মুক্তাগুলো বিশেষত চীন ও জাপান প্রস্তুত করে থাকে। চীন ও জাপান এ্যাকোয়া কালচার (Akoya culture) পদ্ধতি ব্যবহার করে। নোনাপানির এই মুক্তাগুলো সর্বনিম্ন ২ মিলিমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং রঙ সাধারণত সাদা (বা কখনো কখনো ক্রিম রঙের)।

এ্যাকোয়া কালচার পার্ল; সূত্র- blog.genisi.com

অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন অঞ্চলে পাওয়া যায় দক্ষিণ সাগরীয় মুক্তা। এই মুক্তাগুলো সাধারণত সবচেয়ে বড় আকৃতির হয়ে থাকে যা সর্বনিম্ন ৯ মিলিমিটার থেকে সর্বোচ্চ ২০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয় এবং সাধারণত সাদা, ক্রিম বা সোনালী রঙের হয়ে থাকে।

দক্ষিণ সাগরীয় মুক্তা; সূত্র- pearl-guide

আরেক ধরণের মুক্তা পাওয়া যাদের বলা হয় তাহিতিয়ান মুক্তা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের উপস্থিতি কেবল ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার তাহিতি দ্বীপেই সীমাবদ্ধ না, বরং পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি দ্বীপে এদের পাওয়া যায়। সর্বনিম্ন ৮ মিলিমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত এদের আকৃতি হয়ে থাকে। এই বিশেষ মুক্তাকেই বলা হয় ব্ল্যাক পার্ল। তবে এরা শুধু কালো ছাড়াও ধূসর, নীল, সবুজ বা বেগুনী রঙেরও হতে পারে।

ব্লাক পার্ল; সূত্র- bbci.co.uk

স্বাদু পানির মুক্তাগুলো অনেকটা এ্যাকোয়া কালচার মুক্তার মতোই হয়ে থাকে। তবে এদের বেশিরভাগই নিউক্লিয়াসবিহীন হয়। এদের প্রস্তুতিতে বাহ্যিক নিউক্লিয়াস প্রয়োগ করা হয় না। কেবল এক টুকরা জীবিত টিস্যু ব্যবহার করা হয় যার চারপাশে ন্যাকার আস্তরণ পড়ে। মূলত চীনে এ ধরণের মুক্তা বেশি চাষ করা হয়।

প্রাকৃতিক মুক্তা খুবই দুর্লভ একটি জিনিস, যদিও বর্তমানে মুক্তা কৃত্রিমভাবে চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক মুক্তা ও কৃত্রিম মুক্তার মধ্যে পার্থক্য আছে যথেষ্ট। কারণ প্রাকৃতিক মুক্তায় প্রাকৃতিকভাবে নিউক্লিয়াস দানার চারপাশে বহু বছর ধরে ন্যাকার আস্তরণ পড়তে থাকে, ফলে এদের ন্যাকার আস্তরণের পরিমাণ হয় নিউক্লিয়াসের তুলনায় বহুগুণ বেশি। অপর দিকে কৃত্রিম মুক্তায় নিউক্লিয়াসের আকার আগে থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় এবং সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়, ফলে ন্যাকার আস্তরণ হয় অনেক কম। নিচের ছবিটি দেখলেই পার্থক্য বোঝা যাবে।

কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক মুক্তা। সূত্রঃ media.licdn.com

আবার কৃত্রিম মুক্তার আকৃতি নির্ভর করে নিউক্লিয়াসের পূর্বনির্ধারিত আকৃতির উপর। কিন্তু প্রাকৃতিক মুক্তায় আকৃতি যেকোনো রকম হতে পারে। যদিও বর্তমানে ইমিটেশন মুক্তা পাওয়া যায়। ইমিটেশন মুক্তা হচ্ছে কাচের আস্তরণ যুক্ত বীড, যা অনেকটা আসল মুক্তার পদ্ধতিকে অনুকরণ করে তৈরী করা।

কিন্তু এত কৃত্রিমতা ছাপিয়েও মুক্তা এখনো হয়ে আছে সৌন্দর্যবর্ধন ও অলংকরণের এক অনন্য উপকরণ হিসেবে, এবং আশা করা যায় প্রকৃতিতে জীবিত প্রাণীর অভ্যন্তরে উৎপন্ন হওয়া এই রত্ন হয়ে থাকবে এক বিস্ময়।

ফিচার ইমেজ- fastcompany.net

Related Articles