কেমন হতো, যদি একটি যন্ত্র চলত অবিরামভাবে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে? আর অবিরামভাবে চলার এই শক্তি জোগান দিত সে নিজেই? চিরন্তন গতির যন্ত্র বা ইংরেজিতে পারপেচুয়াল মোশন মেশিন মানুষ তৈরি করতে চাচ্ছে সহাস্রব্দেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু এমন যন্ত্র তৈরি করা কি চাট্টিখানি কথা? বছরের পর বছর ধরে এ যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টায় মানুষ ব্যর্থ হয়েছে, তবে একজন দাবি করেছিলেন, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তিনি এতটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যে ১৭২৫ সালে পিটার দ্য গ্রেট নিজেই জার্মানিতে গিয়ে এই যন্ত্র কিনতে চেয়েছিলেন! কিন্তু যদি তার তৈরি করা যন্ত্র আসলেই কাজ করত, তাহলে আজও কেন আমরা খুঁজছি চিরন্তন গতির যন্ত্র? কারণ সেসময় তার যন্ত্রটি ছিলো একটি বিশাল চালাকির সৃষ্টি। তো চলুন আজকে জেনে আসা যাক সেই যন্ত্র তৈরির রহস্য।
চিরন্তন গতির যন্ত্র কেমন?
রহস্য জানার আগে খানিকটা যন্ত্রটি সম্পর্কে জানা যাক। আগেই বলা হয়েছে, এ যন্ত্র নিজের চলার শক্তির জোগান নিজেই দিতে পারে। আপনি যদি একটু কৌতূহলী হয়ে থাকেন, তাহলে সম্ভাবনা রয়েছে জীবনে কখনও আপনিও এমন যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন! কী? অবাক লাগছে? তাহলে এই যন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে একটু বলি। ১১৫৯ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (দ্বিতীয়) নিচের ছবির মতো একটি চাকার নকশা তৈরি করেছিলেন।
এখানে যে বক্রাকার রেখাগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো একপ্রকার জলাধার বিশেষ, যেখানে তিনি পারদ রাখার কথা বলেছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, যখন চাকাটিকে ঘোরানো হবে, তখন পারদগুলো প্রতিটি জলাধারের নিচে চলে আসবে এবং একটি পাশ অপরটির থেকে সবসময়ই ভারি থাকবে। আর এই ভারসাম্যহীনতার ফলে চাকাটি চিরন্তনভাবে ঘুরতে থাকবে। ভাস্কারাচার্যের এ নকশা চিরন্তন গতির যন্ত্রের সবচেয়ে পুরোনো ধারণাগুলোর মাঝে একটি। চিরন্তন গতি বলতে শুধু গতির যন্ত্রকেই বোঝানো হয় না। যদি এমন একটি অবস্থা তৈরি করা যায়, যেখানে একটি আলো তার নিজ শক্তিতেই চিরন্তনভাবে জ্বলবে, সেটিও হবে একপ্রকার চিরন্তন গতির যন্ত্র। এ যন্ত্র আমাদের পৃথিবীর সকল কিছুকে বদলে দিতে পারে। শক্তির সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে হবে, যদি এটি তৈরি করা যায়। কিন্তু সমস্যা একটিই, এগুলোর একটিও কাজ করে না।
চিরন্তন গতির যন্ত্র সবসময় পদার্থবিজ্ঞানের তাপগতিবিদ্যার এক বা একের অধিক সূত্রকে লঙ্ঘন করে। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, শক্তি সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস করা সম্ভব না। অর্থাৎ, আপনি যা শক্তি প্রয়োগ করবেন, বিপরীতে আপনি ততটুকুই পাবেন। তো চিরন্তন গতির যন্ত্রে যেটুকু শক্তি দেয়া হবে, সে ততটুকুই ফেরত দেবে, এটি দিয়ে অন্যকিছু চালানো সম্ভব নয়। আচ্ছা, সেটা সম্ভব না হোক, যন্ত্রটি নিজের শক্তিতে নিজেই চলতে পারবে না? উত্তর হচ্ছে- না। এ চিন্তাধারা নিয়ে অনেক মডেল তৈরি করা হয়েছিল, যা অনেকটা ভাস্করাচার্যের যন্ত্রেরই পরিবর্তিত রূপ, কিন্তু একটিও কাজ করেনি। যখনই যন্ত্রটির উপাদানগুলো ঘুরতে ঘুরতে নিচের দিকে নেমে আসে, তখন এর ভরকেন্দ্রও মাঝখান থেকে সরে আসে। এর ফলে এটি পেন্ডুলামের মতো শুধু সামনে আর পেছনে দুলতে থাকে এবং একসময় গিয়ে থেমে যায়।
একসময় দেখা গিয়েছে, বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ না করলে চাকা কাজ করে না। অর্থাৎ, তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রই যন্ত্র তৈরিতে বাধা দিচ্ছে। যদি ধরে নিই, বিজ্ঞানীরা কোনোভাবে এ বাধা কাটিয়ে উঠেছেন, কিন্তু তাদেরকে আবার থেমে যেতে হবে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের কাছে। দ্বিতীয় সূত্র আমাদের বলে, শক্তি সবার মাঝে ছড়িয়ে যায়, যেমন ঘর্ষণ শক্তিতে ব্যয় হয়। যে যন্ত্রতেই কোনো চলন্ত অংশ কিংবা বায়ু বা তরলের সাথে সংযোগ থাকবে, সেখানেই ঘর্ষণ ও তাপের সৃষ্টি হবে। আর তাপ উৎপন্ন হওয়া মানেই শক্তি রূপান্তরিত হয়ে বাইরে চলে যাওয়া, এভাবে শক্তি কমতে কমতে একসময় যন্ত্রটি থেমে যাবে। এ পর্যন্ত এই দুই সূত্র এমন যন্ত্র তৈরি করার ধারণাকে পুরো বানচাল করে দিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যন্ত্রটি কোনোদিন তৈরি করা সম্ভব নয়, কারণ এখনও মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানা আমাদের অনেক বাকি। হয়তো একদিন এমন কোনো পদার্থ আমরা পাব, যার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও আমাদের নতুন করেই লিখতে হবে।
পিটার দ্য গ্রেটের কিনতে চাওয়া যন্ত্রটি
জার্মানিতে কাউন্সিলার অরফাইরেস নামে এক ব্যক্তি 'তৈরি' করেছিলেন চিরন্তন গতির যন্ত্র। এ যন্ত্র কেনার জন্য রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেট ১৭১৫ থেকে ১৭২২ সালের মধ্যে পত্রালাপ চালিয়েছিলেন, যার একটি বিরাট অংশ এখনও মহাফেজখানায় সংরক্ষিত রয়েছে। স্বয়ংচালিত যন্ত্র তৈরি করে দেশ জুড়ে খ্যাতির অধিকারী এই লোকটি রাজকীয় মূল্যের বিনিময়েই শুধু এটি বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন। পিটার দ্য গ্রেট তার গ্রন্থাগারিক সুমাখারকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করতে। সেখানে তিনি এই যন্ত্রটির দাম নিয়ে কথা বলেন কাউন্সিলরের সাথে। কাউন্সিলর এর দাম চেয়েছিলেন এক লক্ষ থেলারস। পিটার দ্য গ্রেট এরপর নিজে গিয়েই এই যন্ত্র কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ ইচ্ছা সফল হওয়ার আগেই তার মৃত্যু ঘটে। তো কে এই অরফাইরেস, আর কেমন ছিল তার যন্ত্র?
অরফাইরেসের আসল নাম ছিল বেসলার। জন্ম ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। এ যন্ত্র নিয়ে মাথা ঘামানো শুরুর আগে তিনি চিত্রবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবনের জন্য যে হাজার হাজার লোক চেষ্টা করেছিলেন, তার মাঝে তিনিই বোধহয় সবচেয়ে বিখ্যাত। তার সাথে ভাগ্যবানও বলা যায়, কারণ এ যন্ত্র প্রদর্শন করে তিনি যা আয় করেছিলেন, তাতে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি সুখেই কাটিয়েছেন।
তার যন্ত্র ছিল বিরাট এক চাকার মতো। জ্ঞানী কাউন্সিলর প্রথমদিকে যন্ত্রটিকে বিভিন্ন বাজারে ও মেলায় প্রদর্শন করেন। এতে করে পুরো জার্মানিতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মাঝে তিনি কিছু ক্ষমতাশালী পৃষ্ঠপোষক লাভ করেন। পোল্যান্ডের রাজা উৎসাহ প্রকাশ করেন, এরপর হেস্কেসেলের ল্যান্ডগ্রেভ অরফাইরেসকে উৎসাহিত করেন এবং নিজের প্রাসাদটি তাকে ব্যবহার করতে দেন। তারপর শুরু হয় যন্ত্রের উপর সকল পরীক্ষা।
১৭১২ সালের ১২ নভেম্বর, যন্ত্রটিকে আলাদা একটি ঘরে রেখে চালিয়ে দেয়া হয় এবং ঘরটি তালাবদ্ধ করে দুজন পাহারাদারও মোতায়েন করা হয়। দু'সপ্তাহ পর ল্যান্ডগ্রেভ ঘরে ঢুকে দেখেন, যন্ত্রটি তখনও চলছে এবং এর গতিও কমেনি। চাকাটি এবার থামিয়ে আবার করা হলো পরীক্ষা। সবশেষে আবার ঘরটি সিল মেরে তালা ঝুলিয়ে ৪০ দিন বন্ধ রাখা হলো। পাহারাদার থাকায় কেউ কাছে ঘেঁষারও সাহস পায়নি। আবার খোলার পর দেখা গেল, যন্ত্রটি তখনও চলছে। কিন্তু ল্যান্ডগ্রেভ তখনো সন্তুষ্ট হননি। তাই এবার যন্ত্রটিকে এক নাগাড়ে দু'মাস বন্ধ করে রাখা হলো। এরপরও যখন তিনি ঘুরতে দেখলেন, তখন তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং তিনি অরফাইরেসকে এই মর্মে একটি প্রশসাপত্র দিলেন যে, যন্ত্রটি প্রতি মিনিটে ৫০ পাক খায়, ১৬ কেজি ভারকে ১.৫ মিটার উচ্চতায় তুলতে পারে।
এই সার্টিফিকেট পকেটস্থ করে অরফাইরেস ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়ান। তিনি পিটার দ্য গ্রেটকে ১ লাখ মুদ্রার কমে বিক্রি করতে রাজি হননি, কাজেই বোঝা যাচ্ছে, রোজগার তার রাজকীয় ধরনেরই হয়েছিল। পিটার দ্য গ্রেট বিখ্যাত কূটনীতিক এ. অ্যা অস্টার-ম্যানকে এটি পরীক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করেন। তিনি যন্ত্রটি সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পিটার দ্য গ্রেটের কাছে পেশ করেন।
এরপর অরফাইরেসের উপর বৃষ্টির মতো প্রস্তাব ঝরতে শুরু করে। রাজাদের পুরস্কার থেকে শুরু করে কবিরা কবিতাও রচনা করেন তার চাকা নিয়ে। তবে কিছু লোক তাকে প্রতারক বলে মনে করতেন এবং তার স্বরূপ উদঘাটন করলে ১,০০০ মুদ্রার একটি পুরস্কারেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তো এই রহস্য উন্মোচন হলো কীভাবে?
ঘটনাচক্রে কাউন্সিলরের সাথে তার স্ত্রী ও ভৃত্যের মনোমালিন্য ঘটায় এই চালাকি প্রকাশিত হয়ে যায়। তারা দুজন এই রহস্য জানতো। চাকাটি স্থাপনের জন্য যে থামগুলো ছিল, তারই আড়ালে রাখা চাকার অক্ষের একাংশের উপর দড়ি জড়ানো ছিল। আর সুনিপুণভাবে ভৃত্যটি দড়ি টেনে চাকাটিকে ঘোরাত। প্রকাশ হওয়ার পরেও কাউন্সিলর তার মুখে চুনকালি পড়তে দেননি। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও তিনি সবাইকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তার স্ত্রী ও ভৃত্য কুৎসা রটিয়েছিল। তবে এটা বলতে হয় যে, ভাগ্যিস তাদের মনোমালিন্য হয়েছিল, নাহলে হয়তো আমাদের এখনও অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তে হতো!
This article is about perpetual motion machine and the secrent behind bessler's wheel.
References:
1. Book of Y.I. Perelman (Physics for Entertainment) Page 90-94
2. Why don't perpetual motion machines ever work? - Netta Schramm
Featured Image: YouTube