লেখার শিরোনাম পড়েই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আসলেই কি এটি সম্ভব? নাকি এটি কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার কাহিনী? সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ’ (The Wandering Earth) মুভিটি যারা দেখেছেন তাদের মনেও একই প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক কিছু না। এই মুভিটিতে দেখানো হয়েছে যে, পৃথিবীকে সূর্যের প্রসারণ এবং বৃহস্পতি গ্রহের সাথে সংঘর্ষের হাত থেকে বাঁচাতে ‘থ্রাস্টার’ (Thruster) ব্যবহার করা হয়। এসব বিরতিহীনভাবে চলা থ্রাস্টারের কাজ হচ্ছে পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে খানিকটা সরিয়ে নেয়া বা সহজ কথায় নতুন কক্ষপথ তৈরি করে দেয়া। ব্যাপারটা অনেকটা রকেট উৎক্ষেপণের মতোই। কেবল পার্থক্য এই যে, রকেটের ওজন পৃথিবীর তুলনায় অত্যধিক নগণ্য হওয়ায় এই ধাক্কার কারণে রকেট মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতে পারে।
তো, আসল প্রশ্নটিতে আবার ফিরে আসা যাক। প্রশ্নটি যেমন অস্বাভাবিক, তেমনই সভ্যতার জন্য অনেকাংশে জরুরিও বটে। কেননা আগামী কয়েক বিলিয়ন বছর পরে আমাদের সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র সূর্য তার সকল জ্বালানি হারাতে শুরু করবে। সেই সাথে আস্তে আস্তে প্রসারিত হতেও শুরু করবে। এখন যেমন সূর্য আমাদের সকল শক্তির যোগানদাতা, তেমনি বিজ্ঞানীদের ধারণা আগামী পাঁচ বিলিয়ন বছর পরে সেটি আমাদের জন্যে হবে অত্যধিক দূর্বিষহ। আর সূর্য যদি প্রসারিত হতে থাকে তাহলে সেটি অবশ্যই পৃথিবীকে কোনো একসময় অবশ্যই গ্রাস করবে সন্দেহ নেই।
সূর্যের অভ্যন্তরে অনবরত হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরী হচ্ছে এবং সেই সাথে তৈরি হচ্ছে অত্যধিক শক্তি। সূর্যকে বলা যায় বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন এক পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র। তো, এটি যেমন শক্তির যোগানদাতা সেই সাথে এর ঝুঁকিও কিছু কম নয়। গত কয়েকবছরে অনুভূত হওয়া তীব্র উষ্ণতাই এর প্রমাণ দেয়। সেই সাথে আছে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট। ফলাফল এই যে, এই দুইয়ে মিলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাজেই যদি কোনোভাবে পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে কিছুটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে হয়তো ভালো কিছু হতেও পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা আসলেই করা যাবে কি না। তত্ত্বগতভাবে পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নতুন কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয় যদিও।
বেশ কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করা গ্রহাণুদের প্রযুক্তির সাহায্যে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। যদি এরা নিজেদের কক্ষপথে ঘুরতো, তাহলে কোনো না কোনো সময়ে পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হওয়া ছিলো খুবই বাস্তব। কিন্তু এসব গ্রহাণুর অবস্থানের পরিবর্তন করার ফলে সেই আসন্ন সংঘর্ষের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এসব প্রযুক্তির মধ্যে আছে গ্রহাণুর পৃষ্টে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ বা অতি দ্রুত গতির মহাকাশযানের সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে এদের গতিশক্তি প্রদান করা। এছাড়াও কখনো কখনো স্পেসক্রাফট এসব গ্রহাণুর পৃষ্ঠে স্থাপন করে এদের বিরতিহীনভাবে মহাকর্ষের বিপরীতে চালনা করা হয়ে থাকে।
কিন্তু মুশকিলের বিষয় হচ্ছে, এই গ্রহাণুসমূহ পৃথিবী থেকে অনেক ক্ষুদ্র। কাজেই এসব প্রযুক্তি হয়তো পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হবে না। কিংবা হলেও সেখানে প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে অত্যধিক।
এখন দেখা যাক কী কী উপায়ে আমাদের পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নতুন কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের তত্ত্বের দ্বারা পৃথিবীকে তার কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেয়ার অনেক রকম উপায় বের করা যাবে। যেমন- অতিবিশাল টেলিপোর্টার তৈরই করে এবং পৃথিবীকে ভাগ করে কণার পর কণা অন্য অবস্থানে সরিয়ে আবার জোড়া দেয়া যেতে পারে, অর্ধেক পৃথিবীকে রূপা দিয়ে মুড়ে দেয়া যেতে পারে যাতে করে সূর্যের আলো প্রতিফলনের সাহায্যে পৃথিবী সরে যেতে পারে, যেহেতু আলো ভরবেগ আছে অথবা পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত বিশাল গর্ত খুঁড়ে ভেতরের জ্বালানির উদ্গীরণের মাধ্যমেও পৃথিবীকে সরিয়ে নেয়া যেতে পারে।
যদিও এসব উপায় তত্ত্বগতভাবে নির্ভূল, কিন্তু বাস্তবিকক্ষেত্রে সেগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু একসময়ের কল্পকাহিনী আজকের বিজ্ঞান হয়েছে। আজকের এসব তত্ত্ব যে একসময়ে বাস্তবের দেখা পাবে না সেটাই বা কে বলতে পারে! কারণ পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের কাছে উপায় খুবই কম। কিছু তো করতেই হবে পৃথিবীকে রক্ষা করতে।
ইলেক্ট্রিক থ্রাস্টার
প্রতিবারই যখন কোনো রকেট বা মহাকাশযান পৃথিবী থেকে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, তখন এদের উড্ডয়নজনিত কারণে অল্প-বিস্তর স্পন্দনের সৃষ্টি হয়। এই স্পন্দনের কারণে পৃথিবী সামান্য হলেও উড্ডয়নের বিপরীতদিকে সরে আসে। অনেকটা গুলি ছোড়ার কারণে বন্দুকের পেছনে সরে আসার মতোই। কিন্তু পৃথিবীর উপর এই স্পন্দনের প্রভাব অতিশয় নগণ্য। বর্তমানে ‘স্পেসএক্স’ (SpaceX) এর ‘ফ্যালকন হেভি’ (Falcon Heavy) হচ্ছে বহুল ব্যবহৃত মহাকাশযান। পৃথিবীকে সরিয়ে নিতে এরকম ভারী যানের প্রয়োজন হতে পারে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন বিলিয়ন। এদের সম্মিলিত ভর হবে পৃথিবীর ভরের ৮৫%, যা পৃথিবীকে মঙ্গলগ্রহের দিকে ১৫% সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রিক থ্রাস্টার (Electric Thruster) আরো বেশি কার্যকরী হতে পারে। ইলেক্ট্রিক থ্রাস্টার হচ্ছে সেই যন্ত্র যেখানে আয়নিত কণাসমূহের প্রবাহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর ফলে এরা গতিশক্তির সৃষ্টি করে এবং সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এসব থ্রাস্টার পৃথিবী পৃষ্ঠে স্থাপন করে পরিচালনা করলে হয়তো আমাদের পৃথিবীকে কক্ষচ্যূত করে নতুন কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব।
উচ্চ শক্তির আলোর সাহায্যে
আলো কোনোপ্রকার ভর ধারণ করে না, কিন্তু আলোর ভরবেগ আছে। আলোর এই ভরবেগকে কাজে লাগিয়েও পৃথিবীকে স্থানান্তর করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন হবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আলোর, যা অবিরত ফোকাসড বিম হিসেবে বের হতে থাকবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লেজার রশ্মির কথা। আর এই ফোকাসিংয়ের জন্য শক্তি সরবরাহ করা হবে স্বয়ং সূর্য থেকেই। যদিও এই ধারণা তাত্ত্বিকভাবে সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কখনো সম্ভব হবে কি না তা কেবল সময় এবং বিজ্ঞানই বলতে পারে।
আন্তঃগ্রহ বিলিয়ার্ড
কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান দুটি বস্তুর মধ্যে ভরবেগের বিনিময় এবং এদের বেগের পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি খুবই গ্রহণযোগ্য। মূলত বস্তু দুটির মধ্যে প্যাসেজ তৈরীর মাধ্যমে কিংবা মহাকর্ষ গুলতির (Gravitational Slingshot) মাধ্যমে এই ভরবেগের বিনিময় করা সম্ভব। সাধারণত গ্রহসমূহের অন্তর্বর্তী মহাকাশযানসমূহে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ব্যাপারটা অনেকটা বিলিয়ার্ড খেলার মতই। এখানে প্রতিটি গ্রহই যেন একেকটি বিলিয়ার্ড বল।
পরিশেষে
নাসার কতিপয় ইঞ্জিনিয়ার এবং কয়েকজন আমেরিকান জ্যোতির্বিদ আন্তঃগ্রহ বিলিয়ার্ড পদ্ধতির উপর তাদের ধারণা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, গ্রহাণুসমূহকে যেভাবে পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য এদের পৃষ্ঠে রকেট স্থাপন করা হয়, সেই একই পদ্ধতিতেই যদি গ্রহাণুদের পৃথিবীর পাশ দিয়ে চালনা করা যায়, তাহলে এদের আকর্ষণ শক্তির কিছুটা পৃথিবী লাভ করবে। এতে করে পৃথিবীর গতি কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। আর গতি বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ এটি এর কক্ষপথ হতে কিছুটা দূরে সরে যাবে। অর্থাৎ, কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করবে।
তবে আগেই বলা হয়েছে যে, এসব এখনো বিজ্ঞানী ও গবেষকদের তাত্ত্বিক গবেষণা এবং হিসাব-নিকাশের ফলাফল। এই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবায়ন করাটাই এখন বিজ্ঞানীদের চ্যালেঞ্জ। কারণ অদূর ভবিষ্যতে সূর্যের গ্রাসে ধংস হয়ে যাবে পৃথিবী, সেই সাথে পৃথিবীতে অবস্থান করা সবকিছুই ধংস হবে। কিন্তু এসব সম্ভাবনা নিয়ে খেলাটাও বিপদজনক। কারণ গ্রহাণুদের ব্যবহার করে পৃথিবীকে কক্ষচ্যূত করতে গিয়ে এমনও হতে পারে যে, পৃথিবীর সাথে এর সংঘর্ষ হয়ে যাবে। এসব সম্ভাবনার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু তা কেবল সময়ই বলতে পারে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) কৃষ্ণ বিবর
২) দ্য থিওরি অব এভরিথিং
৩) ছোটদের মহাকাশ পরিচিতি
This article is in Bengali language. It discusses the possiblities of changing the orbit of earth. Necessary references have been hyperlinked inside.
Featured Image © YouTube