Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দারিদ্র্য: মানব মস্তিষ্কের উপর যার রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গেলেই অবধারিতভাবে চলে আসত ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ কথাটি। পরিস্থিতি বদলে গিয়ে এখন দেশ স্থান করে নিয়েছে উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকায়। অনেক কথাই তো বলা হয় দারিদ্র্য বিমোচন, দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসরত মানুষদের দুরবস্থা এসব নিয়ে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন যে মানব মস্তিষ্কের উপর দারিদ্র্যের প্রভাব কতটা? কীভাবে দরিদ্রতা মানুষের মস্তিষ্কের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন এবং বৃদ্ধিতে দরিদ্রতা কী ধরণের প্রভাব বিস্তার করে- এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

অর্থাভাব এবং মস্তিষ্ক

দরিদ্রতা মানুষকে সঠিক উপায়ে চিন্তা করতে বাধা প্রদান করে। মানব মস্তিষ্কের জ্ঞানমূলক দক্ষতা বা Cognitive Function বলতে বোঝানো হয়ে থাকে তার অর্জিত জ্ঞানকে কতটা চমৎকারভাবে সে ব্যবহার করতে পারছে? অর্থাৎ প্রতিনিয়ত লব্ধ জ্ঞান বা তথ্যের সমাবেশ, যৌক্তিকতা বিচার, কারণ খোঁজা, স্মৃতি সংরক্ষণ, মনোযোগ প্রদান ইত্যাদি কাজ একজন মানুষ কতটা দক্ষভাবে করতে পারবে সেটা নির্ধারণ করবে তার মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় সামর্থ্য। দারিদ্র্য ঠিক এই জায়গাটাতেই সমস্যার সৃষ্টি করে। খুব সহজভাবে যদি ব্যাখ্যা করতে হয় তাহলে বলতে হয়, একজন মানুষ যখন আর্থিক সংকটে থাকেন তখন তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অথচ ঠিক একই ব্যক্তি যখন আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকেন তখন তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম তিনি খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে করতে পারেন।

সাত থেকে নয় মাস বয়সী শিশুদের এমআরাই স্ক্যান, Source: theguardian.com

অর্থাভাবে থাকলে একজন মানুষের উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অনেকাংশেই কমে যায়। এর কারণ হল, দরিদ্রতা একধরনের বোঝা হিসেবে কাজ করে মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অংশের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এর ফলে মস্তিষ্কের ওই অংশটির কার্যক্ষমতা ব্যহত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি আর্থিক লেনদেনের বিষয় মানুষের জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রভাব রাখতে সক্ষম। আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কিত নয় এমন সব কাজের উপরও অর্থ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

একটি শিশুর এমআরআই স্ক্যান করানো হচ্ছে, Source: theguardian.com

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক ব্যক্তিগত গাড়ি মেরামত করা। ব্যক্তি যদি তুলনামূলক কম আয় করে থাকেন তখন তার জন্য নিত্যদিনের কাজগুলো সঠিকভাবে করা কঠিন হয়ে পড়ে, কিন্তু একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে গাড়ির মেরামত খরচ যদি সাধ্যের ভেতরে থাকে তখন তার অন্যান্য কাজকর্মে কোনো ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। তাহলে এই একই বিষয়টা একজন বিত্তশালীর ক্ষেত্রে কিরকম হবে? গাড়ির মেরামত খরচ কম অথবা বেশি যা-ই হোক না কেন, যদি গাড়িটির মালিক হন প্রাচুর্যের মাঝে বাস করা কেউ তাহলে কোনো ক্ষেত্রেই তার জীবনে গাড়ির মেরামত খরচের কোনোরকম প্রভাব থাকে না। কারণ কোনো দুশ্চিন্তা তার জ্ঞানীয় দক্ষতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। এবারে আরেকটি ভিন্ন উদাহরণের দিকে নজর দেওয়া যাক। তামিলনাড়ুর আখ চাষিদের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল সংগ্রহের পর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান ফসল সংগ্রহের পূর্বের চেয়ে উন্নত হয়েছে।

যেভাবে মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমানোর জন্য দায়ী আর্থিক সংকট

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের একটি অংশ হল Pre-Frontal Cortex যেটি মস্তিষ্কের জ্ঞানমূলক কাজগুলোর দেখভাল করে থাকে।

একজন মানুষ যখন দরিদ্রতার মাঝে বসবাস করেন তখন তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র প্রতিনিয়ত প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সে শঙ্কা এবং ভয়ের বার্তা পাঠায়। ফলাফল হিসেবে মস্তিষ্কের এই অংশটির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান, লক্ষ্য স্থির করা, যেকোনো কাজ সবচেয়ে সুচারুরূপে সম্পাদন করার দক্ষতা কমে যায়। ধনী-গরিব সবারই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কর্মক্ষমতা হ্রাস অন্যান্য আরও কিছু বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এই নিয়ামকগুলো হতে পারে কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম, পারিবারিক ক্রান্তিকাল অথবা মানসিক অস্থিরতা।

আর্থিক দুশ্চিন্তা মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে; Source: slate.com

দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানুষগুলোকে অন্যান্য আর দশজন মানুষের মতই জীবনের স্বাভাবিক ক্লান্তি গ্রহণ করার পাশাপাশি চিরস্থায়ী অর্থ সংকটে ভুগতে হয়, যেটি তার প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের দুরবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে নিয়ে ভাবার পাশাপাশি পরিবারের সবার কথা ভাবতে হয় এবং সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে সবসময় শুধু হিসেবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়াও রয়েছে সামাজিক শ্রেণী রক্ষার মাধ্যমে নিজের সম্মান বাঁচানোর লড়াই। এসবের প্রতিটি জিনিসই দরিদ্রতার মাঝে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর প্রতিদিনের জীবনে একটু একটু করে অনেকটা অসহ্য অবস্থার তৈরী করে।

এই পুরো অবস্থাটির পিছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে তা একেবারে জলবত তরলং। যখন এত অতিরিক্ত পরিমাণ ভয় এবং দুশ্চিন্তার ভার মস্তিষ্ককে নিতে হয় তখন অন্যান্য কাজগুলো করার সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে।

ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, ম্যাডিসনের একদল গবেষক পারিবারিক আয়ের সাথে শিশুদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব, টেম্পোরাল লোব এবং হিপোক্যাম্পাস অংশে ধূসর পদার্থের উপস্থিতির গভীর সম্পর্ক খুঁজে পান

‘Talk to you Baby’ শীর্ষক শিশুর বৃদ্ধি বিষয়ক অনুষ্ঠানে হিলারি ক্লিনটন; Source: Reuters

২০১৫ সালে সংঘটিত এই গবেষণায় দারিদ্র্য সীমা বিবেচিত হয়েছিল ফেডারেল ব্যাংকের ঠিক করে দেওয়া মানদণ্ড অনুসারে এবং চার সদস্যের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ২৪,২৫০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী পরিবার থেকে আগত শিশুদের মস্তিষ্কের অত্যন্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ধূসর পদার্থের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৮-১০ শতাংশ কম। এমনকি যেসব পরিবারের আয় দারিদ্র্য সীমার চেয়ে কমপক্ষে দেড় গুন বেশি ছিল সেসব পরিবারের শিশুদের মস্তিষ্কেও ধূসর পদার্থের পরিমাণ ছিল আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ৩-৪ শতাংশ কম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব শিশু এই গবেষণায় অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকের বাবা-মা উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। তাই সন্তানের জীবনের একদম শুরুর দিকের মানসিক বৃদ্ধিতে তাদের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল, এটা বিবেচনা করে নেওয়া যায়। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সেসব শিশুর মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল না, অর্থাৎ ওই বয়সে যতটা দক্ষ, বুদ্ধিমান এবং পরিণত হওয়ার কথা ছিল ততটা তারা হতে পারেনি এবং এর পিছনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ছিল পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা।

উত্তরণের উপায়

বিভিন্ন সময় বিজ্ঞানীরা এমআরআই এবং ইলেকট্রনসেফালোগ্রাফীর মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের কার্যক্ষমতা নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রাপ্ত তথ্যমতে, দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আয়ের সামান্য বৃদ্ধিও শিশুর জীবনে যতটা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম ঠিক ততটা স্পষ্ট প্রভাব ধনী পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর হয় না।

ঢাকায় একটি শিশুর মস্তিষ্কের তড়িৎ কার্যক্ষমতা পরিমাপের জন্য করা হচ্ছে ইলেকট্রনসেফালোগ্রাফী, Source: nature.com

অর্থাৎ পারিবারিক আয়ই শিশুর জ্ঞানীয় দক্ষতার একমাত্র নির্ধারক না হলেও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি হলে শিশুর বিকাশে এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ সবশেষে বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে এরকম যে, শুধু বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্য বা কোনো স্বীকৃত সংস্থা কর্তৃক দরিদ্র দেশের তালিকায় উপরের দিকে অবস্থান নেওয়ার জন্য নয়, বরং দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ যারা হবে তাদের জন্যই দরিদ্রতা দূর করা দরকার। তাই দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ক কর্মসূচি শুধু কথা, স্বপ্ন অথবা বিলাসিতা সর্বস্ব না হয়ে বরং হয়ে উঠুক সময়ের দাবী। কারণ আজকের শিশুরাই বিনির্মাণ করবে আগামীর ভবিষ্যৎ।

ফিচার ইমেজ: psychologytoday.com

Related Articles