Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাবরিনা প্যাস্টার্স্কি: নতুন যুগের ‘আইনস্টাইন’

মিডিয়াতে তার পরিচয় ছড়িয়ে গেছে ‘নতুন আইনস্টাইন’ নামে। তবে এই তকমায় তার আগ্রহ নেই। বরং নিজের নামেই খুশি তিনি। বয়স সবে ২৪, পিএইচডি করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র দুই যুগের জীবনকালেই তার মেধার খ্যাতি আকাশছোঁয়া। তার যথেষ্ট কারণও আছে। অ্যামাজন আর নাসায় তার জন্য চাকরির সুযোগ ঝুলে আছে। বয়ঃসন্ধির শুরুতে, আমরা যখন সবচেয়ে উড়ুউড়ু মন নিয়ে ঘুরি, সেই সময়ে একটা আস্ত আকাশযান বানিয়ে ফেলার রেকর্ডও আছে তার। ক্ষুদ্র জীবনকালে তার অর্জন নেহায়েত কম নয়। বলছি এ যুগে বিজ্ঞানের জগতে নতুন ধ্রুবতারা সাবরিনা প্যাস্টার্স্কির কথা।

সাবরিনা প্যাস্টার্স্কি; source: hypeness.com.br

কিউবান বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাবরিনা গঞ্জালেজ প্যাস্টার্স্কি। ১৯৯৩ সালের ৩ জুন শিকাগোতে মার্ক প্যাস্টার্স্কি ও মারিয়া গঞ্জালেজের ঘরে জন্ম নেন। তার বাবা একইসাথে একজন অ্যাটর্নী ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বিজ্ঞানের সাথে সখ্যটা যে ডিএনএ থেকেই পাওয়া, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ছোটবেলা থেকেই আশ্চর্য প্রতিভাধর সাবরিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে এডিসন রিজিওনাল গিফটেড সেন্টারে। ২০১০ সালে তিনি ইলিনয় ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাকাডেমি থেকে গ্রাজুয়েট হন। আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছাটা বরাবরই ছিল, আর তাই ১০ বছর বয়সেই বিমান চালনা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন সাবরিনা। তার দশম জন্মদিনে দাদুর কাছ থেকে একটি Cessna 150 প্লেন উপহার পেয়েছিলেন তিনি। সেই প্লেনেরই ইঞ্জিন খুলে একজন মেকানিকের সহায়তায় সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে পরবর্তীতে একটি নতুন ইঞ্জিন তৈরি করেন তিনি। সেই সাথে একটি নতুন প্লেনের কাঠামো দাঁড় করিয়ে ২০০৬ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের পুরোদস্তুর একটি ব্যক্তিগত প্লেন বানিয়ে ফেলেন তিনি। ৩৬৩ দিন লাগে তার নিজের প্লেনটি দাঁড় করাতে। যে বয়সে সবাই ভিডিও গেমস নিয়ে পড়ে থাকে, সে বয়সে সাবরিনা তার প্রাইভেট প্লেনের ইঞ্জিন চালু করার আগে শেষবারের মতো হাত বুলাচ্ছেন, ভাবা যায়!

ছোট্ট সাবরিনা বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেছিলেন, “বলেছিলাম না বাবা, আমি বলেছিলাম না!” সমুদ্রের পাড় ধরে ১৩ বছর বয়সী এক মেয়ে নিজের বানানো একটি প্লেনে করে উড়ছে, অনুভূতিটা কি পড়ে বোঝার মতো! নিজের সেই অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে সাবরিনা ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ এ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এ এক অপূর্ব অনুভূতি, একদম আলাদা একটা দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়। সবকিছু খুবই ছোট লাগে।” পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের পর সাবরিনা তার ১৪তম জন্মদিনের দু’দিন আগে নিজেই তার প্লেন উড়িয়ে কানাডা থেকে ঘুরে আসেন। এর একটি ভিডিও চিত্রও তিনি তৈরি করে রাখেন। নিজের প্লেন ওড়ানো সবচেয়ে কমবয়সী মানুষটি সাবরিনা।

নিজের এয়ারক্রাফটের সাথে; source: pagenews.gr

প্রবল ইচ্ছা নিয়ে ২০১১ সালে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (MIT) ভর্তির আবেদন করেন সাবরিনা। কিন্তু এই অমিত প্রতিভাধর মেয়েটি প্রথমবারে এমআইটির ওয়েটিং লিস্টে চলে যান। যা-ই হোক, অবশেষে যখন ভর্তি হতে পারলেন, তারপরে চলতে থাকলো তার বাজিমাতের খেলা। তিনি জিতে নেন ফ্রেশম্যান অ্যাওয়ার্ড ফর এন্ট্রাপ্রেনারশিপ। এরপর এমআইটির পাঠ চুকিয়ে যখন বের হন, তখন তিনি হন সর্বোচ্চ জিপিএ ৫.০০ পয়েন্টধারী গ্র্যাজুয়েট। প্রথম নারী হিসেবে ২০১৩ সালে এমআইটি ফিজিক্স অরলফ স্কলারশিপও লাভ করেন সাবরিনা। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ডে ডক্টরেট করছেন। স্টিফেন হকিং, ম্যালকম জে পেরি ও অ্যান্ড্রু স্ট্রমিগনার (হার্ভার্ডে তার পিএইচডি অ্যাডভাইজার) এর সহযোগে একটি রিসার্চ পেপারও প্রকাশ করেছেন তিনি।

তুলনাটা আইনস্টাইনের সাথে; source: twitter.com

নিজ প্রতিভা ও কৃতিত্বগুণে সাবরিনা কাজের আমন্ত্রণ পেয়েছেন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের কাছ থেকে। অ্যারোস্পেস ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’ থেকেও এসেছে আমন্ত্রণ। ওদিকে নাসা তো কবে থেকে তাকে নেয়ার জন্য তৈরি! কিন্তু স্থিতঃধী ও বিনয়ী সাবরিনা আগে নিজের পড়াশোনা শেষ করতে আগ্রহী। তিনি ভালো করেই জানেন, ক্ষমতার সাথে দায়িত্ব আসে, প্রতিভার সাথে আসে বিড়ম্বনা। তাকে নিয়ে সবার এতো উচ্চাভিলাষ তাই বিনম্রতার সাথেই তিনি এড়িয়ে যেতে চান।

নিজের ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছিলেন, “আমি শুধুই একজন স্নাতকের শিক্ষার্থী, আমার অনেক কিছু শেখার আছে। এত মনোযোগ আমার প্রাপ্য নয়। এক সাক্ষাৎকারে সাবরিনা বলেন, “তুমি যা করতে পারো বলে বিশ্বাস করো, তাতে আশাবাদী হও। বড় হয়ে তুমি কী করবে বা কী হবে এমন অনেক কথাই তুমি ছোটবেলা বলে থাকো, আমি মনে করি সেই সব স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” এখনও অবধি যতটা খ্যাতি তিনি পেয়েছেন, সেটিই তার দায়িত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়েই তিনি বলেছেন, “আমার অবশ্যই মনে হয় আমার আরও অনেক কিছু করার আছে। এখন স্বীকৃতি পাওয়াটা অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার, কিন্তু আশা করি এটা কোথাও একটা নিয়ে যাবে।”

সাবরিনা সবসময় নিজেকে নতুন করা আবিষ্কার করতে চান, নিজের সীমানা ভাঙার সার্বক্ষণিক একটা তাড়না তাকে ঘিরে থাকে। এর বীজটা বোধহয় হাই স্কুলে থাকতেই এসেছিল তার মধ্যে। একবার তার এক শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার অর্জন কী?” তিনি জবাব দিলেন, “আমি একটা প্লেন বানিয়েছি।” প্রত্যুত্তরে শিক্ষক বললেন, “ভালো, কিন্তু সম্প্রতি তুমি কী করেছো?” নিঃসন্দেহে এক বিরাট মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন সেই শিক্ষক।

হার্ভার্ডে সাবরিনা; source: levraisite.fr

২৪ বছর বয়সী সাবরিনার নেই অ্যালকোহল বা ধূমপানের অভ্যাস। তিনি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না; ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়াগুলো থেকেও দূরে থাকেন। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিকে কাজের অন্তরায় কখনোই করেননি তিনি। ‘ফিজিক্স গার্ল’ নামে একটা ওয়েবসাইট আছে তার শুধু। সেখানেই মাঝে মাঝে তার কাজ ও চিন্তা-ভাবনার জানান দেন তিনি।

পদার্থবিজ্ঞান বরাবরই সাবরিনার প্রিয় বিষয়। তিনি বলেন, “বছরের পর বছর নিজের সক্ষমতার সীমারেখাকে ধাক্কা দেয়াটাই আমাকে পদার্থবিদ্যার দিকে এগিয়ে নিয়েছে।” বর্তমানে সাবরিনার গবেষণার বিষয় ব্ল্যাক হোল, স্পেস টাইম ও গ্র্যাভিটি। স্টিফেন হকিং ও আইনস্টাইনকেও একই বিষয় বরাবর আকর্ষণ করেছে। সাবরিনার ভাষ্যমতে, “বিশৃঙ্খলার মধ্যকার সৌন্দর্য” তার মনোযোগ কাড়ে বেশি। বিশেষত কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তার মূল গবেষণার বিষয়। তিনি গ্র্যাভিটি বা মধ্যাকর্ষণের সাথে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করছেন। তার গবেষণা সফল হলে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অনেক ধারণাই বদলে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা।

আকাশের অসীমে তার মস্তিষ্কের বিচরণ; source: spaceinvader.me

সাবরিনার ঝুলিতে পুরষ্কার ও সম্মাননার অভাব নেই। ২০১০-এ পেয়েছিলেন ইলিনয় এভিয়েশন ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১২ সালে ‘সাইন্টিফিক আমেরিকান’ ম্যাগাজিনে এবং ২০১৫ সালে ফোর্বস এর সেরা ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ লিস্টে আসেন সাবরিনা। তার গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে আড়াই লাখ ডলারসহ হার্টজ ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপও লাভ করেন তিনি। এ বছর ‘মেরি ক্লেয়ার ইয়ং উইমেন অনার’ লাভ করেছেন তিনি। ‘সিলিকন ভ্যালি কমিক কন’ এর হেডলাইনও হয়েছেন। তার গবেষণা কর্মগুলো রাশিয়ান, পোলিশ, চেক, কাটালান, স্প্যানিশ, জার্মান, হিন্দি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দক্ষ বাগ্মী সাবরিনা প্রিন্সটন, হার্ভার্ড, এমআইটি ও ফিলাডেলফিয়ায় ফোর্বসের সম্মেলনে বক্তব্যও রেখেছেন।

চোখ আকাশে, কিন্ত পা মাটিতে; source: colours.id

এত কম বয়সে এই আকাশ ছোঁয়া খ্যাতির পরও জোয়ারে ভেসে যাননি সাবরিনা প্যাস্টার্স্কি। আকাশের ওপারের রহস্যভেদের কাজ নিলেও তার পা জোড়া তিনি মাটিতেই রেখেছেন। ধৈর্য্য, স্থিরতা, বিনয় ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন নিজ গতিতে তিনি। পৃথিবীজোড়া তরুণ-তরুণীদের জন্য বিশাল এক দৃষ্টান্ত সাবরিনা। হ্যাঁ, তার মতো প্রতিভা বিরল। কিন্তু তার জীবনপ্রণালী আর শ্রমের ধরনটি বিরল নয়। সাবরিনার মতো ধ্রুবতারাদের দেখে এগিয়ে যাক স্বপ্নবাজ তরুণদের দল।

ফিচার ইমেজ: freakpills.es

Related Articles