Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পারমাণবিক শক্তি নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচকতার উৎপত্তি কোথায়?

২০১৫ সালের কথা, প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তনের মহামঞ্চে বিশ্বনেতারা জলবায়ু পরিবর্তনকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিলেন। পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে উন্নতির চাকা চালু রাখতে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর বিকল্প নেই এই ব্যাপারটিও অকপটে সবাই স্বীকার করে নিলেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানী হিসেবে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন জৈব জ্বালানীর গুরুত্ব উঠে আসে। কিন্তু পরিচ্ছন্ন এবং বিপুল শক্তির অন্যতম উৎস পারমাণবিক শক্তির সম্ভাবনার ব্যাপারে সবাই নীরব! পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে জনমনে আছে ভীতি আর শঙ্কা। রাজনীতিবিদেরাও তাই এড়িয়ে যেতে চান পারমাণবিক শক্তির অসীম সম্ভাবনার ব্যাপারটি। তবে পারমাণবিক শক্তি শুধুই কি হুমকি?

পারমাণবিক শক্তির আছে অসীম সম্ভাবনা; Image source: www.smithsonianmag.com

পৃথিবীর চাকাকে গতিশীল রাখতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তা জলবিদ্যুৎ, সৌর কিংবা বায়ুশক্তির মতো উৎস দিয়ে পূরণ করার মতো নয়। গাণিতিক হিসেবানুযায়ী, ১০০ মিটারের একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের পেছনে থাকা এক কেজি পরিমাণ পানি থেকে শক্তি পাওয়া যাবে ৩,৬০০ কিলোওয়াট প্রতি ঘন্টার মাত্র একভাগ। সেখানে এক কিলোগ্রাম কয়লা পুড়িয়ে শক্তি পাওয়া যাবে সরাসরি সাত কিলোওয়াট, সুতরাং কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন তুলনামূলক বেশি সহজ।

পারমাণবিক শক্তির কার্বন নিঃসরণের হার অনেক কম; Image source: Yale School of Forestry & Environmental Studies

তাই কয়লাকে জলবিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চাইলে বিশাল আকৃতির অবকাঠামো, বিনিয়োগ এবং পরিশ্রম দরকার। বর্তমানে পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি চীনের। ২২,৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে তিনশত কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ১৩ লক্ষ অধিবাসীর পুনর্বাসন করতে হয়েছে প্রকল্প এলাকা থেকে। এই বিশালাকার অবকাঠামোর নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও মোটেই কম নয়।

চীনের দানবাকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প; Image source: businessinsider.com

নবায়নযোগ্য শক্তির আরেক উৎস বায়ুশক্তির দিকে তাকালে দেখা যাবে এর যান্ত্রিক দক্ষতা (Efficiency) বেশ কম। বিশাল আকারের সব বায়ুমিলের টারবাইন ঘুরিয়েও গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটার থেকে শক্তি পাওয়া যায় নয় মেগাওয়াট। এক গিগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সমান বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে কয়েকশত বায়ুচালিত টারবাইনের প্রয়োজন। সৌরশক্তির যান্ত্রিক দক্ষতার ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা। বিপুল পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন হয় এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পৃথিবীতে বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ কমে আসার সাথে সাথে তাই এটিও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে বিশ্বনেতাদের।

বায়োফুয়েল কিংবা জৈব জ্বালানীর পরিবেশগত দিকের ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা যথেষ্ঠ সন্দিহান। জৈব জ্বালানী হিসেবে ইথানল কিংবা বায়োডিজেল উৎপন্ন করতেও দরকার বিপুল পরিমাণ জায়গা আর বিনিয়োগ। অন্যদিকে জৈব জ্বালানী পুড়িয়ে জ্বালানী সংকট দূর করা গেলেও এটিও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। ফলে একে পরিবেশবান্ধব জ্বালানীও বলা যাচ্ছে না। 

এদিক থেকে পারমাণবিক শক্তি অনেক বেশি দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। এই জ্বালানী উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণের হারও অনেক কম। এক গিগাওয়াটের একটি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের জন্য দরকার মাত্র পনের হেক্টর জমি। তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জটিল অবকাঠামো নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যদিও কোনো অংশেই কম নয়। তবে পরিকল্পনামাফিক নির্মিত একেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যায় ৬০ বছরের অধিক সময় জুড়ে আর একবার নির্মিত হয়ে গেলে পাওয়া যায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ।

পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খনি থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানী সংগ্রহ করা যায়। তবে বায়ু, কয়লা, সৌরশক্তি কিংবা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়ে এই পারমাণবিক প্রকল্প অনেক বেশি দক্ষতার সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু এত সুবিধা থাকার পরও এই ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং নির্মাণে আগ্রহ নেই অনেক দেশের। এমনকি অনেক দেশে চলতে থাকা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তির প্রতি জনমনে একধরনের নেতিবাচক ধারণার কারণেই নতুন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে এত অসুবিধা।   

বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের পরিসংখ্যান; Image source: www.world-nuclear.org

মূলত পারমাণবিক শক্তির প্রতি সাধারণের মনে লুকিয়ে থাকা ভয়ের উৎপত্তি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং এর পরবর্তী সময়ে। হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাত এবং স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে ভীতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গণমাধ্যম আর রাজনৈতিক নেতারা পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে বরাবরই দিয়ে এসেছেন নেতিবাচক বার্তা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের অসুস্থ দ্বৈরথ মানুষকে পারমাণবিক শক্তির অশুভ দিককেই সামনে নিয়ে এসেছে বারবার।

সোভিয়েত-মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রের দ্বৈরথ; Image source: www.timetoast.com

কিন্তু পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইডবিহীন শক্তির পাশাপাশি ক্যান্সারকেও জয় করা যেতে পারে। রেডিওথেরাপি ব্যবহার করে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্যান্সার সারিয়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তির সম্ভাবনার কথা যতটা না প্রচার পেয়েছে তার চেয়ে এটির ধ্বংসের চিত্রই বেশি ফুটে উঠেছে গণমাধ্যমগুলোতে। তাই পারমাণবিক শক্তির প্রতি ভীতি কাটিয়ে উঠা সাধারণ মানুষের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মারাত্মক দুর্যোগ এবং বিভিন্ন সময় এই দুর্যোগের ভুল ব্যাখ্যাও মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে।

চেরনোবিল দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি; Image source: thehistoryopedia.com

১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্যোগটিকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পারমাণবিক দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এই দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি জনমনে পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে আবারো নেতিবাচকতা সঞ্চার করে। এই ঘটনায় পারমাণবিক কেন্দ্রে কর্মরত দুজন তাৎক্ষণিক এবং ২৮ জন কর্মী পারমাণবিক বিষাক্ততার শিকার হয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান।

পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই কেন্দ্রের সাথে জড়িত অনেকেই মারা গিয়েছেন পারমাণবিক বিষাক্ততার শিকার হয়েই। প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষকে সরে যেতে হয়েছে চেরনোবিলের আশেপাশের এলাকা থেকে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও ছিলো বিশাল। যদিও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে, প্রত্যক্ষ মৃত্যু এবং ক্ষতির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পরোক্ষ ক্ষতি হয়েছে যেগুলো হিসাব করা যায়নি।

জাপানে সুনামির কারণেই ঘটে দুর্ঘটনা; Image source: japanaturaldisasters.weebly.com

২০১১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুতের সুরক্ষা ব্যবস্থা যখন অনেক বেশি পরিণত তখন জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনা আবার নতুন করে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। ২০১১ সালের সুনামির ঘটনায় জাপানে মৃত্যু হয় প্রায় উনিশ হাজার মানুষের। সেই সুনামি একই সাথে জন্ম দেয় ফুকুশিমা দুর্ঘটনারও। তবে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা কিংবা বিষাক্ততার কারণে কারোই মৃত্যু ঘটেনি। এজন্য অবশ্য এক লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ফুকুশিমা এবং এর আশপাশের এলাকা থেকে।

ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের দুর্ঘটনা; Image source: japanaturaldisasters.weebly.com

ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের দুর্ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে কেউই মারা যায়নি। কিন্তু এই ঘটনার পরে জাপানে পারমাণবিক শক্তির প্রতি নেতিবাচকতা চরমে পৌঁছায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ পরিহারের দাবীও উঠতে থাকে জনগণের মধ্যে থেকে। ২০১১ সালে জাপানের বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রায় ত্রিশ শতাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকেই পাওয়া যেতো, ২০১৭ নাগাদ তা একচল্লিশ আর ২০৩০ সাল নাগাদ সেটিকে পঞ্চাশে উন্নীত করার কথাই ভাবছিলো জাপান সরকার। কিন্তু এই সুনামির কারণে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ে নতুন করে আবারো পারমাণবিক শক্তির প্রতি নেতিবাচকতা জেগে ওঠায় সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না জাপানের জন্য।

এই ভূমিকম্পের এবং সুনামি পরবর্তী সময়ে জাপান সম্মুখীন হয় বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতিরও; Image source: japanaturaldisasters.weebly.com

তবে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই পারমাণবিক প্রকল্পের ক্রমান্বয়ে উন্নতি হয়েছে। বিপুল পরিমাণ শক্তির যোগান দিতে সক্ষম এই পারমাণবিক শক্তি শুধু ধ্বংস নয় সৃষ্টিও করতে পারে, চালু রাখতে পারে বিশ্বের চাকা, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের বিকল্প হয়ে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনায় রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তবে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে এর দুর্ঘটনাও বেশ মারাত্মক। তাই গবেষক এবং বিজ্ঞানীদেরও আগ্রহের কমতি নেই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার দিকে নজর দিতে। আর যদি এটি সম্ভব হয় তাহলে আগামী বিশ্বের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে পারমাণবিক বিদ্যুতের বিকল্প নেই।

ফিচার ইমেজ: industrialization.go.ke

Related Articles