Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিছু সাধারণ বিপাকীয় ব্যাধি এবং এদের ভবিষ্যৎ

“অসুখ মানেই সুখ নেই”- কথাটি মোটামুটি সবারই জানা আছে বা শোনা হয়ে গেছে বহুবার। সকলেরই কিন্তু প্রায়ই অসুখ হয়। অসুখ মানেই সুখের অভাব হলেও সব অসুখ একই ধরনের নয়। মানুষের শরীরে যত ধরণের অসুখ হয়, তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এসব অসুখের মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শ্রেণী হলো মেটাবোলিক ডিজঅর্ডার বা বিপাকীয় ব্যাধি। সুপ্রিয় পাঠক আজ আমাদের আলোচনার বিষয় বিপাকীয় ব্যাধি।

মেটাবোলিজম বা বিপাক কী?

দেহে চলমান জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর মধ্যে যেসব বিক্রিয়া শক্তির ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত সেগুলোকে একত্রে মেটাবোলিজম বলা হয়। মেটাবোলিজমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আমরা প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করি সেগুলোতে শর্করা, আমিষ বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য থাকে। এই সমস্ত খাদ্য উপাদানগুলো যথেষ্ট জটিল থাকে, যে কারণে শরীর তাদেরকে সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না আর তাই প্রয়োজন পড়ে খাদ্যের সরলীকরণের। পরিপাকতন্ত্রে উপস্থিত বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচকের সুনির্দিষ্ট কার্যকারিতায় খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান ভেঙে শরীরের ব্যবহারের উপযুক্ত হয় এবং দেহের বিভিন্ন কোষের প্রয়োজনানুযায়ী এদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং কোষসমূহ এদের জ্বালানী হিসেবে কাজে লাগায়।

ক্যাটাবোলিজম এবং অ্যানাবোলিজম; Source: britannica.com/

  • ক্যাটাবোলিজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহে উৎপন্ন বিভিন্ন জৈব অণু যেমন- শর্করা, আমিষ, স্নেহ জাতীয় পদার্থের ভাঙন ঘটে এবং শরীরের বিভিন্ন নিয়মিত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
  • অ্যানাবোলিজম প্রক্রিয়ায় ঘটে ঠিক এর বিপরীত ঘটনা অর্থাৎ বিভিন্ন জৈব অণু গঠিত হয় এবং সঞ্চিত হয় দেহে।

মেটাবোলিক ডিজঅর্ডার বা বিপাকীয় অসুস্থতা কী?

দেহের স্বাভাবিক বিপাকীয় কার্যাদি যখন ব্যাহত হয় তখন বিপাকীয় ব্যাধির সৃষ্টি হয়। ফলাফল হিসেবে একটি মেটাবোলাইট দেহে যতটুকু পরিমাণে থাকা দরকার তার চেয়ে হয় অধিক থাকে অথবা কম থাকে।

বিপাকীয় ব্যাধির রকমফের; Source: medikoe.com

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপাকীয় ব্যাধিগুলো বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হয়, যদিও অনেক আক্রান্ত ব্যক্তিকেই দীর্ঘ সময়ব্যপী সুস্থ থাকতে দেখা যায়। এসব ব্যাধির লক্ষণগুলো বিশেষত তখন প্রকাশিত হয় যখন শরীরের মেটাবোলিজমকে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিছু কিছু বিপাকীয় ব্যাধির জন্য জন্মপূর্ব রোগ নির্ণয় সম্ভব। এই ধরনের রোগ নির্ণয় সাধারণত যেসব পরিবারে পূর্বে কোনো শিশুর বিপাকীয় ব্যাধি ছিল তাদেরকে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়াও কখনও কিছু নির্দিষ্ট জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত ব্যক্তিদের মাঝে এই ধরণের পরীক্ষা বেশি প্রচলিত থাকে, যেমন অ্যাশেকেনাজি ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝে টে-শাস রোগ নির্ণয়ের হার বেশি।

কিছু বিপাকীয় ব্যাধি

সিস্টিনোসিস (Cystinosis)

সিস্টিনোসিস এর আরেক নাম হচ্ছে সিস্টিন স্টোরেজ ডিজঅর্ডার। এই অসুখটি হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন টিস্যুতে “সিস্টিন” অ্যামিনো অ্যাসিড সঞ্চিত হতে থাকে। এসব টিস্যুর মাঝে সবচেয়ে সাধারণ হচ্ছে অস্থিমজ্জা, যকৃত, চোখের কর্নিয়া এবং বৃক্ক। এই রোগটির তিনটি ধরণ হতে পারে- নেফ্রোপ্যাথি, ইন্টারমিডিয়েট এবং নন-নেফ্রোপ্যাথিক।

চোখের কর্নিয়ায় সিস্টিনের ক্রিস্টাল; Source: disorders.eyes.arizona.edu

এরা একে অন্যের চেয়ে তীব্রতা এবং বিস্তারের দিক থেকে ভিন্নতর।

CTNS জীনে মিউটেশনের ফলে সিস্টিনোসিস হয়; Source: disorders.eyes.arizona.edu

CTNS নামক জীনে মিউটেশনের দরুন এই রোগটি হয়ে থাকে। CTNS জীন মূলত কোড করে সিস্টিনোসিন নাম প্রোটিনকে। CTNS জীনে মিউটেশনের কারণে প্রকৃত প্রোটিনের বদলে একই প্রোটিনের একটি অকার্যকর রূপ সংশ্লেষিত হয় দেহে।

সিস্টিনিউরিয়া (Cystinuria)

সিস্টিনিউরিয়া এমন একটি অসুখ যেটি হলে মূত্রের মাধ্যমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চারটি অ্যামিনো অ্যাসিড দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। এই চারটি অ্যামিনো অ্যাসিড হল সিস্টিন, লাইসিন, আরজিনিন এবং অর্নিথিন। এই রোগটিতে মূল সমস্যা হয় বৃক্কে সিস্টিনের পাথর তৈরী হওয়ার মাধ্যমে। লাইসিন, আরজিনিন এবং অর্নিথিন এই তিনটি অ্যামিনো অ্যাসিডের মত সিস্টিনের দ্রবীভূত হওয়ার মাত্রা খুব বেশি না হওয়ায় যখন মূত্রের পরিমাণ কমে আসে, বিশেষত রাতে, তখন বৃক্কে এর স্বল্প দ্রাব্যতার কারণে পাথর তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

ফ্যাব্রি’স ডিজিজ (Fabry’s disease)

এই রোগটির আরেকটি নাম হচ্ছে অ্যানজিওকেরাটোমা কর্পোরিস ডিফিউসাম। এটি একটি লিঙ্গ জড়িত বংশগতিজনিত রোগ যেটির কারণে আলফা গ্যালাক্টোসাইডেজ এনজাইম অনুপস্থিত থাকে এবং ফলাফল হিসেবে রক্তনালীতে গ্লাইকোস্ফিংগোলিপিড জমা হতে থাকে অস্বাভাবিক হারে। এই অস্বাভাবিকতার ফলে বিভিন্ন হৃদরোগ এবং বৃক্কের সমস্যার কারণে পরিণতিতে আয়ুষ্কাল কমে আসে।

গ্যালাক্টোসেমিয়া (Galactosemia)

দুধের মধ্যে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেট হলো ল্যাকটোজ যেটি একটি ডাইস্যাকারাইড এবং এর দুটি উপাদান মনোস্যাকারাইড হলো গ্লুকোজ এবং গ্যালাক্টোজ। অসুখের নাম শুনেই অনুমান করা যাচ্ছে যে সমস্যা গ্যালাক্টোজকে নিয়েই। সাধারণত দেহে গ্যালাক্টোজ বিপাকে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে গ্লুকোজ হিসেবে অংশগ্রহণ করে।

গ্যালাক্টোসেমিয়ার কারণে হতে পারে সংক্রমণ; Source: ghr.nlm.nih.gov

গ্যালাক্টোজ-১-ফসফেট থেকে গ্লুকোজ-১-ফসফেট তৈরী করার জন্য দায়ী এনজাইম কার্যকর না থাকলে তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলাফল হিসেবে দেহে গ্যালাক্টোজ-১-ফসফেট এর পরিমাণ বেড়ে যায় এবং চোখের ছানি ও যকৃতের বিভিন্ন সমস্যার জন্য এটি দায়ী।

নিম্যান-পিক ডিজিজ (Niemann-Pick disease)

স্ফিংগোমায়েলিনেজ এনজাইমের অভাবের কারণে লেসিথিন এবং স্ফিংগোলিপিড এর ভাঙন যথাযথভাবে হয় না। এর ফলে এই অসুখটি হয় যার কারণে দেহের বিভিন্ন টিস্যুতে এদের উপস্থিতি বেড়ে গিয়ে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি হয়। লক্ষণগুলোর মাঝে দেখা যায় যে, অস্বাভাবিক রকমের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্লীহা ও যকৃত, মানসিক অস্থিরতা এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ফসফোলিপিড সমৃদ্ধ কোষের উপস্থিতি। এই রোগের পাঁচটি ধরণ আছে- টাইপ A, B, C, D এবং E।

পোরফাইরিয়া (Porphyria)

এটি একটি সুনির্দিষ্ট রোগ নয়। পোরফাইরিয়া বলতে এমন কিছু রোগের সমষ্টিকে বোঝানো হয় যেগুলো হলে পোরফাইরিনের অতিরিক্ত উৎপাদন এবং দেহ থেকে নিষ্কাশন চলতে থাকে। হিমোগ্লোবিনের লোহিত বর্ণের জন্য দায়ী লৌহযুক্ত বর্ণকণিকা হিমে পোরফাইরিন উপস্থিত থাকে। এখন পর্যন্ত পোরফাইরিনের দুটি শ্রেণী চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে- ইরাইথ্রোপোয়েটিক এবং হেপাটিক। প্রথমটির ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা থেকে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনে সমস্যা এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে যকৃতে ব্যা ঘাত ঘটে।

পম্পে’স ডিজিজ (Pompe’s disease)

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে গ্লাইকোজেন বিপাকের ক্ষমতা কমে যায়। ফলাফল হিসেবে পেশীর সমস্যা দেখা যায় যেটি জীবনের শুরুর দিকে প্রাণঘাতী পর্যন্ত হতে পারে। মূলত আলফা-১,৪-গ্লুকোসাইডেজ এনজাইমের অনুপস্থিতির কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে। জীনগত এই রোগটি যথেষ্টই বিরল। প্রতি ১,৫০,০০০ মানুষের মাঝে ১ জনে এই রোগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পেশীতে গ্লাইকোজেন সঞ্চিত হওয়ার কারণে হৃদপিণ্ড, যকৃত ও প্লীহা বড় হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা দেখা যায়।

সমাধানের পথ তবে কী?

মেটাবোলিক ডিজঅর্ডারগুলোর চিকিৎসা প্রচলিত পদ্ধতির মত নয়। ট্যান্ডেম ভর বর্ণালিবীক্ষণ ইদানীং একই বিভিন্ন মেটাবোলিটকে একইসাথে শনাক্তকরণের কাজে ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

জিন অগমেন্টেশন থেরাপী; Source: yourgenome.org

জন্মের ঠিক পরপরই যদি শিশুর মাঝে কোনো বিপাকীয় ব্যাধি চিহ্নিত করা যায় তবে খুব দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া যায়। কিছু কিছু বিপাকীয় ব্যাধি বেশ ভালভাবেই দূর করা যায় যদি বেশ আগে থেকেই চিকিৎসা শুরু করা যায়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এই ধরনের রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জীন থেরাপি কার্যকর সমাধান হতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।    

Related Articles