Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহাকাশযান এবং কৃত্রিম উপগ্রহদের সমাধিক্ষেত্র!

কোনো যন্ত্রই চিরস্থায়ী নয়। এমনকি কোটি কোটি ডলার খরচ করে নির্মিত মহাকাশযানও নয়। অন্য যেকোনো যন্ত্রের মতোই মহাকাশযান এবং কৃত্রিম উপগ্রহেরও নির্দিষ্ট জীবনকাল আছে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, গ্রহ-নক্ষত্রের উপাত্ত সংগ্রহ, কিংবা টেলি যোগাযোগ, যে উদ্দেশ্যেই তাদেরকে মহাকাশে প্রেরণ করা হোক না কেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়; বা বলা যায় তারা মৃত্যুবরণ করে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই সব মহাকাশযানের বিকল যন্ত্রাংশগুলোকে বা মৃতদেহকে তখন কী করা হয়?

মহাকাশযানের সমাধিক্ষেত্র; Source: scienceabc.com

কোনো মহাকাশযান যখন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, তখন তাকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে রেখে দেওয়া অলাভজনক এবং ক্ষতিকর। নিয়ন্ত্রণহীন এই মহাকাশযানগুলো পৃথিবীর নিকটবর্তী কক্ষপথে উদভ্রান্তভাবে ঘুরে বেড়ালে যেকোনো সময় অন্য কোনো মহাকাশীয় বস্তুর সাথে সংঘর্ষ হতে পারে, কাছাকাছি অবস্থিত অন্যান্য মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, অথবা কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর অভিমুখেও ছুটে আসতে পারে। এছাড়াও তাদের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাকাশীয় আবর্জনার সৃষ্টি করতে পারে, যেগুলো অন্যান্য মহাকাশযান এবং কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এসব কারণে বিজ্ঞানীরা এসব বিকল মহাকাশযানের জন্য তিনটি নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রথমত, তাদের অবস্থান যদি পৃথিবীর নিকটবর্তী কোনো কক্ষপথে হয় এবং তাদের আকার যদি ছোট হয়, তাহলে জ্বালানী শেষ হওয়ার আগেই তাদের গতিবেগ কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ বলের প্রভাবে এরা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীর অভিমুখে ছুটে আসতে শুরু করে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে প্রচণ্ড ঘর্ষণে জ্বলে উঠে নিঃশেষ হয়ে যায়। অধিকাংশ উল্কাপিণ্ডের মতোই অধিকাংশ ছোট মহাকাশযান শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে পারে না। তার আগেই ঘর্ষণের ফলে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে যেভাবে মহাকাশযান পুড়ে যায়: Source: nasa.gov

দ্বিতীয়ত, যদি মহাকাশযানের অবস্থান হয় পৃথিবী থেকে দূরবর্তী কোনো কক্ষপথে, তাহলে অনেক সময় বাড়তি কিছু বেগ সৃষ্টি করে মূল কক্ষপথ থেকে সরিয়ে এদেরকে দূরবর্তী একটি কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। এই কক্ষপথটিকে বলা হয় গ্রেভইয়ার্ড অরবিট (Graveyard Orbit) বা সমাধিক্ষেত্রের কক্ষপথ। এর অবস্থান পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২,৪০০ মাইল (৩৫, ৮৪০ কিলোমিটার) উঁচুতে, যা সবচেয়ে দূরবর্তী সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহ থেকেও অন্তত ২০০ মাইল বা ৩২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে এখানে অবস্থিত মৃত মহাকাশযানগুলো জীবিত এবং সক্রিয় মহাকাশযানের চলাচলে এবং কার্যক্রমে কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে না।

এই সমাধিক্ষেত্রের কক্ষপথেরও অবশ্য একটি ঋণাত্মক দিক আছে। অচল মহাকাশযানগুলো এখানে প্রতিনিয়ত মহাকাশীয় জঞ্জালের সৃষ্টি করছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে অনেক দূরে হওয়ায় এই কক্ষপথের পরিধি অনেক বিশাল। সেই তুলনায় এই জঞ্জালের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অচল মহাকাশযানগুলো এই কক্ষপথে শত শত বা হাজার হাজার বছর ধরে অবস্থান করতে পারে। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো এগুলো মহাকাশচারীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে। কিন্তু আপাতত বিজ্ঞানীরা এদের অবস্থান নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না।

মহাকাশযান সমাধিক্ষেত্রের কক্ষপথ; Source: scienceabc.com

বিকল মহাকাশযানগুলোর অবস্থান যদি পৃথিবীর নিকটবর্তী কোনো কক্ষপথে হয় এবং তাদের আকার যদি যথেষ্ট বড় হয়, যে তাদেরকে ঘর্ষণের মাধ্যমে জ্বালিয়ে ফেলা সম্ভব না, তখন তাদের জন্য তৃতীয় নিয়তিটি নির্ধারণ করা হয়। তাদেরকে তখন পৃথিবীতেই ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তাদের অবশিষ্ট অংশ যেন লোকালয়ের উপর এসে না পড়ে, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিধ্বস্ত করানো হয়। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন রাখার জন্য বিকল মহাকাশযানগুলোর অন্তিম গন্তব্য হিসেবে মহাকাশ বিষয়ক সংস্থাগুলো এমন একটি স্থানকে বেছে নিয়েছে, যেটি যেকোনো লোকালয়, তথা যেকোনো স্থলভূমি থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত।

স্পেসক্র্যাফট সিমেটারি (Spacecraft Cemetery) তথা মহাকাশযানের সমাধিক্ষেত্র নামে পরিচিত এই স্থানটি স্বাভাবিকভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত। এর একেবারে কেন্দ্রের ঠিকানা ৪৮ ডিগ্রি ৫২.৬ মিনিট দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং ১২৩ ডিগ্রি ২৩.৬ মিনিট পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ, যা পয়েন্ট নিমো (Point Nemo) নামে পরিচিত। নিমো শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ ‘কেউ না’। মহাসাগরের গভীরে এই বিন্দুতে কোনো মানুষের যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বলেই এর এই নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এই স্থানটি Oceanic Pole of Inaccessibility তথা মহাসাগরীয় অগম্য মেরু নামেও পরিচিত।

পয়েন্ট নিমো; Source: lifescience.com

পয়েন্ট নিমো স্থানটির চতুর্দিকে অন্তত আড়াই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো স্থলভূমি নেই। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থলভূমি হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার কিছু দ্বীপ, যা এই পয়েন্ট থেকে ১,৬৭০ মাইল (২,৬৮৮ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত। সেই তুলনায় বরং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের যাত্রীদের অবস্থান পয়েন্ট নিমো থেকে অনেক নিকটবর্তী। এটি যখন পয়েন্ট নিমোর উপর দিয়ে উড়ে যায়, তখন এর দূরত্ব থাকে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার!

পয়েন্ট নিমো এবং এর চতুর্দিকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল এলাকা জুড়ে কোনো কোনো যাত্রী বা মালবাহী জাহাজের চলাচল নেই। এমনকি, এর বিশেষ ধরনের স্রোত প্রবাহের কারণে এই এলাকায় মাছের সংখ্যাও খুবই কম, যার কারণে কোনো মাছ ধরার নৌকাও এদিকে আসে না। এসব কারণেই এই স্থানটিকে বিকল মহাকাশযান বিদ্ধস্ত করার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বাছাই করা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন; Source: Nasa

১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এই সমাধিক্ষেত্রে অন্তত ২৬০টি মহাকাশযানকে সমাহিত করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার গভীরে, পয়েন্ট নিমোর সমুদ্রের তলদেশে অন্তত ১,৫০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এসব বিকল বা মৃত মহাকাশযান চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। শুধু মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহই না, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মীর স্পেস স্টেশন এবং একটি স্পেস-এক্স রকেটের ধ্বংসাবশেষও আছে এই সমাধিক্ষেত্রে।

তবে সমাধিক্ষেত্র বলতে যেরকম বোঝায়, পয়েন্ট নিমোর তলদেশে মহাকাশযানগুলো সেভাবে অখণ্ড বা দুই-তিন খণ্ডে খণ্ডিত অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে শায়িত না। বরং সেগুলো হাজার হাজার টুকরায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেখানে বিশৃঙ্খলভাবে পতিত হয়েছে। যত বড় আর যত মজবুত মহাকাশযানই হোক, পৃথিবীতে প্রবেশের সময় বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে তার অধিকাংশই পুড়ে যায়। খুব ক্ষুদ্র একটি অংশই পৃথিবীতে পৌঁছে। উদাহরণস্বরূপ, মীর স্পেস স্টেশনের মূল ভর ছিল ১৪৩ টন, কিন্তু এর পৃথিবীতে এসে পৌঁছানোর পর এর ধ্বংসাবশেষের ভর ছিল মাত্র ২০ টন।

পয়েন্ট নিমো থেকে স্থলভাগের দূরত্ব; Source: Red Bull

মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই চেষ্টা করে, তাদের যানগুলোর ধ্বংসাবশেষ যেন পয়েন্ট নিমোতে এসে পড়ে। কিন্তু সব সময় তা সম্ভব হয় না। মাঝে মাঝে বিকল হয়ে যাওয়া যানগুলোর উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৯ সালে যখন মার্কিন মহাকাশযান স্কাইল্যাবকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, তখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন যানটি আছড়ে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়ার এসপেরান্স শহরের কাছাকাছি একটি বনভূমিতে।

গত বছর চীনও তাদের প্রথম স্পেস স্টেশন তিয়াংগং-১ এর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে এটি মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গবেষকরা আশা করছেন, আগামী বছরের শুরুর দিকে এটি পৃথিবীতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যেহেতু এর উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই এটিও যে সমাধিক্ষেত্রেই বিধ্বস্ত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদিও আশা করা হচ্ছে, এটি স্পেন থেকে অস্ট্রেলিয়ার মাঝামাঝি স্থানে সমুদ্রের উপরে বিধ্বস্ত হবে, কিন্তু বিধ্বস্ত হওয়ার কয়েকদিন আগে ছাড়া তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

পৃথিবীর চারপাশে মহাকাশীয় আবর্জনার প্রতীকি চিত্র; Source: pulse.nh

সৌভাগ্যবশত, পৃথিবীর ৭১ শতাংশই জলভাগ। এবং স্থলভাগের মধ্যেও মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, বনাঞ্চল সহ জনবিরল ভূমির পরিমাণই বেশি। তাই মাঝেমধ্যে এ ধরনের নিয়ন্ত্রয়ণবিহীন মহাকাশযান পৃথিবীতে প্রবেশ করলেও, এখনো পর্যন্ত লোকালয়ের উপর আছড়ে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ফিচার ইমেজ- Nasa.gov

Related Articles