Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি!

প্রাণীজগতে অত্যন্ত শৃঙ্খলা, প্রচণ্ড পরিশ্রম আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জন্য মৌমাছির জুড়ি নেই। সারাদিন খাদ্য সংগ্রহ, নতুন লার্ভার লালন-পালন, মৌচাকের দেখাশোনা- সত্যি সত্যিই মৌমাছির “দাঁড়াবার সময় তো নাই“!

একটি মৌচাকে প্রত্যেকটি মৌমাছির জন্য কাজ নির্দিষ্ট কাজ করা আছে। সবাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের কাজ করে। অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এত ছোট একটা প্রাণীর কত ছোট মস্তিষ্ক! সেখানে কী করে তারা নিজেদের এত ভিন্ন ভিন্ন কাজের ভারসাম্য বজায় রেখে চলে? এর উত্তর আসলে লেখা আছে তাদের ডিএনএ অনুলিপিতে।

আবার মৌচাকের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সবগুলো মৌচাকের ঘরগুলো (Cell) একই আকৃতির। সেটা হলো একটা ষড়ভুজ। এটা কিন্তু কোনো কাকতালীয় ঘটনা না। এর পেছনে আছে প্রকৃতির স্থাপত্যবিদ্যার এক অনন্য নজির, সরাসরি গণিতের ব্যাপার-স্যাপার। অর্থাৎ বোঝা গেল, মৌমাছি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভোলানাথের মতো গণিতে ফেল করে না, রীতিমতো জ্ঞানী এক প্রজাতি এরা!

ষড়ভুজাকৃতির মৌচাক
মৌচাকের প্রতিটা সেল হয় ষড়ভুজাকৃতির, Image Source: sciencefriday.com

“ভোলানাথ লিখেছিল তিন-চারে নব্বই
গণিতের মার্কায় কাটা গেল সর্বই।
তিন-চারে বারো হয়, মাস্টার তারে কয়;
লিখেছিনু ঢের বেশি, এই তার গর্বই!”

আমাদের আলোচনায় আমরা মূলত মৌচাকের এই গণিতটাই বোঝার চেষ্টা করবো। তার পাশাপাশি এদের কিছুটা বায়োলজি নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে!

নানান-জাতের মৌমাছি

বর্তমান বিশ্বে প্রায় বিশ হাজারের ওপর প্রজাতি আছে, যাদের মধ্যে কেবল চারটি প্রজাতিই মধু উৎপাদন করতে পারে। এদের মধ্যে আবার প্রতিটি মৌচাকে মোটামুটি তিন রকমের মৌমাছি থাকে- রানী, কর্মী ও পুরুষ মৌমাছি। খুব সংক্ষেপে এদের কাজগুলো জেনে নেওয়া যাক।

রানী মৌমাছি

পুরো মৌচাকে একজনই রানী মৌমাছি থাকে। এদের প্রধান কাজ ডিম দেয়া ও সন্তান জন্ম দেওয়া। একমাত্র রানী মৌমাছিই পুরুষ-নারী উভয় প্রকারের সন্তান জন্ম দিতে পারে। অন্যান্য মৌমাছির তুলনায় এদের আকারও বড়সড়।

রাণী মৌমাছি
বড় আকারের রানী মৌমাছি, Image Source: wired.com

কীভাবে রানী নির্বাচন করা হয়?

একটি মৌচাকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে রানী মৌমাছির কাঁধে। তাই রানী মৌমাছির মৃত্যুর পর খুব দ্রুত আরেকজন রানী মৌমাছির দরকার পড়ে। সাধারণত সবগুলো লার্ভা (যেখান থেকে মৌমাছি তৈরি হয়) একই রকম খাবার পায়। কিন্তু যারা রানী-মৌমাছির প্রার্থী, তাদের দেওয়া হয় অত্যন্ত পুষ্টিমানের খাবার, একে বলা হয় দ্য রয়্যাল জেলি। এখানে হাই-প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ, সুগার, অ্যামাইনো অ্যাসিড- সবরকম খাবারের এক সুষম মিশ্রণ থাকে।

এতে রানী-মৌমাছির প্রার্থীরা খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে যায়। এখন রানী-মৌমাছির প্রার্থী কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে, আপাতত ধরে নেওয়া হয় এই কাজ করা র‍্যান্ডমলি।

সেখান থেকে প্রথম যে রানী-মৌমাছি প্রার্থী পূর্ণাঙ্গ মৌমাছিতে রূপান্তরিত হয়, সে খুবই স্বাভাবিকভাবে অন্য সব প্রার্থীকে হত্যা করে। আর একইসাথে যদি একাধিক মৌমাছি বের হয়, তাহলে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত কেবল একজনই টিকে থাকে। এভাবে কেবল একজন রানী মৌমাছিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে এবং পুরো জীবনকালে তার জন্য বরাদ্দ থাকে সেই রয়্যাল জেলি।

Royal Jelly
রয়্যাল জেলিতে রানী-লার্ভার লালন-পালন, Image Source: evolving-science.com

রাণী মৌমাছির কাজ

রানী মৌমাছির প্রধান কাজ সন্তান দেয়া। কর্মী মৌমাছিরাও ডিম দিতে পারে, তবে এরা শুধু পুরুষ মৌমাছির জন্ম দিতে পারে। কেবল রানী মৌমাছিই সবরকমের ডিম দিতে পারে।

একটি রানী মৌমাছি দিনে গড়ে ১,৫০০ ডিম দেয়, বছরে প্রায় ২৫,০০০। আর পুরো জীবদ্দশায় প্রায় দশ লাখ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। এছাড়া রানী মৌমাছির আরেকটি কাজ হলো ফেরোমেন তৈরি করা, যা দলের অন্যান্য মৌমাছিকে দৈহিক ও আচরণগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

পুরুষ মৌমাছি

Drone
পুরুষ মৌমাছি, Image Source: honeybeesuite.com

পুরুষ মৌমাছির একমাত্র কাজ হলো রানীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া, রানীর ডিমের ফার্টিলাইজেশনে সহায়তা করা। সাধারণত গ্রীষ্মের দিকে এরা নিষেকের কাজটি করে। আসন্ন বসন্তের আগেই নতুন মৌমাছিদের জায়গা দিতে এরা মৌচাক ছেড়ে চলে যায়। মৌচাক ছাড়ার কিছুদিনের মাঝেই এরা আশ্রয় এবং খাদ্যের অভাবে মারা যায়। অর্থাৎ বড়জোর তিন মাসের মতো এদের জীবন স্থায়ী হয়।

কর্মী মৌমাছি

বাকি সবরকমের কাজই আসলে কর্মী মৌমাছিরাই করে। মৌচাক তৈরি, পরিচ্ছন্ন রাখা, মধু উৎপাদন, পরাগ সংগ্রহ- সবই। এদের জন্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজগুলোকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

পর্যায় ১: মোটামুটি ২-৩ সপ্তাহের মাথায় লার্ভা থেকে একেকটি পূর্ণাঙ্গ কর্মী মৌমাছির জন্ম হয়। তখন থেকেই তারা নিজেদের মৌচাক পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি করতে থাকে।

পর্যায় ২: দ্বিতীয় পর্যায়ে এদের পরিচ্ছন্নতার কাজের পাশাপাশি পুরুষ মৌমাছিদের খাওয়ানোর কাজটিও করতে হয়।

পর্যায় ৩: এর পরের ধাপে এরা প্রধানত মৌচাকের মেরামত এবং নতুন নতুন সেল (Cell) তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

পর্যায় ৪: জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে (গড়ে জীবনের ৪১-৫০ তম দিনের মধ্যে) এরা মধু সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ে। 

worker bee
মধু আহরণে ব্যস্ত কর্মী মৌমাছি; Image Source: roysfarm.com

একটি কর্মী মৌমাছি বড়জোর ৬-৭ সপ্তাহ বাঁচে। এরা যখন মধু আহরণের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, তখন নতুনদের জন্য মৌচাক ছেড়ে দেয় এবং পুরুষ মৌমাছির মতো দ্রুত খাদ্যাভাবে মারা যায়। তবে যেসব কর্মী মৌমাছি শীতে জন্ম নেয়, এরা প্রায় ৪-৯ মাস পর্যন্ত বাঁচে। কারণ শীতনিদ্রার জন্য আগেই পর্যাপ্ত খাবারের যোগান থাকে। 

এরপর শীতের শেষে রানী মৌমাছির নেতৃত্বে এরা নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। এই হলো প্রায় সবরকম মৌমাছির জীবনকাল।

মৌমাছির গণিত

এবার আমরা মৌমাছির গণিত নিয়ে আলোচনা করে শেষ করবো। মৌচাক যে প্রকৃতির একটা অনন্য স্থাপত্যবিদ্যার নিদর্শন, গণিতের নিখাদ প্রয়োগ- সে ব্যাপারটা এর আকৃতি দেখেই বোঝা যায়। পৃথিবীর যাবতীয় মৌচাকই দেখতে প্রায় একই আকৃতির, ষড়ভুজ।

এর কারণ বোঝার জন্য আমাদের সবার আগে জানতে হবে কম খরচে বেশি ফলনের বিষয়ে। মৌচাক তৈরি হয় মোম থেকে, মোম আসে তাদেরই তৈরি মধু থেকে। ১ আউন্স মোম তৈরির জন্য দরকার পড়ে প্রায় ৪ আউন্স মধু। আর ১ কিলোগ্রাম মধু তৈরির জন্য গড়ে প্রায় ৪০ লাখ ফুলে প্রায় ৯০ হাজার মাইল ঘোরার দরকার পড়ে।

কম মোম খরচ করে বেশি জায়গা পাওয়ার জন্য মৌচাকের আকৃতি হয় ষড়ভুজাকৃতির; Image Source: wikipedia

খুব স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এই মোমের খরচ করতে হবে খুব বুঝে-শুনে। আবার শুধু কম মোম খরচ করলেই হবে না, দরকার মধু রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। অর্থাৎ সবচেয়ে কম মোম খরচ করে সবজেয়ে বেশি স্টোরেজ তৈরি করা।

এই জায়গাতেই আসলে লুকিয়ে আছে মৌমাছির গণিত। এবার আমরা একটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবো, সর্বনিম্ন পরিধির কত বাহুর বহুভুজে সর্বোচ্চ ক্ষেত্রফল পাওেয়া যাবে? (যেহেতু উচ্চতা সমান থাকবে, তাই আমরা ত্রিমাত্রায় চিন্তা না করে দ্বিমাত্রায় ভাবছি।)

ভয় পাওয়ার দরকার নেই, আমরা এখন এই পুরো অঙ্কটা সমাধান করবো না! তবে বিষয়টা সাধারণভাবে বোঝার চেষ্টা করা যেতেই পারে। আমরা কিছু সাধারণ তুলনা করলেই এটা বুঝতে পারবো।

আমরা সবাই জানি, যেকোনো বহুভুজের ক্ষেত্রফল থাকে। একটি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল হতে পারে ১ বর্গ একক, আবার একটা চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফলও হতে পারে ১ বর্গ একক। একইভাবে একটি পঞ্চভুজের ক্ষেত্রফলও হতে পারে ১ বর্গ একক। এখন এই ১ বর্গ এককের বহুভুজগুলোর পরিসীমা বের করা যাক।

ক্ষেত্রফল ও পরিসীমার তুলনা; Image Courtesy: Author

একই ক্ষেত্রফলের (১ বর্গ একক) একটি ত্রিভুজের পরিসীমা হবে ৪.৫৬ একক। একই ক্ষেত্রফলে একটি বর্গের পরিসীমা হবে ৪ একক। আর পঞ্চভুজের জন্য সেটা হবে ৩.৮১ একক। অর্থাৎ আমরা বাহুর সংখ্যা যত বাড়াচ্ছি, একই ক্ষেত্রফলে পরিসীমা তত কমে যাচ্ছে। বাহুর সংখ্যা আরও বাড়ালে দেখা যেত আরও কম পরিসীমা লাগছে। আর পরিসীমা যত কম হবে, তত কম মোম লাগবে। 

সহজ কথায়, একই পরিমাণ মধু সংরক্ষণ এবং একইসাথে কম মোম খরচ করার জন্য সেলগুলোর বাহুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। সর্বোচ্চ বাহুর বহুভুজ হলো বৃত্ত (অসীম সংখ্যক বাহু)। তাহলে মৌচাকের সেলগুলো হওয়া উচিত ছিল বৃত্তাকার। নিচের ছবির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, বৃত্তাকার সেলের আশেপাশে বিরাট ফাঁকা জায়গা থাকে। এটাকে মোম দিয়ে ভরাট করা মানে মোমের প্রচুর অপচয়। আবার ফাঁকা রাখলে সেটা খুব সহজে ভেঙে যেতে পারে।

Image Courtesy: Author

তাই একইসাথে মজবুত এবং কম মোম দিয়ে সেল বানাতে চাই, তাহলে সেটা হতে পারে ত্রিভুজাকার, চতুর্ভুজাকার অথবা ষড়ভুজাকার। কারণ ছবিতেই বোঝা যাচ্ছে, পঞ্চভুজ বা সপ্তভুজের জন্য মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ হবে না।

Image Courtesy: Author

একইসাথে সহজ, মজবুত, মাঝখানে ফাঁকা জায়গা নেই, কম মোম দিয়ে বেশি মধু সংরক্ষণের জন্য যুগে যুগে বিবর্তনের মাধ্যমে মৌমাছিরা তাই মৌচাকের আকৃতি হিসেবে ষড়ভুজকেই বেছে নিয়েছে। প্রকৃতি থেকে এই আইডিয়া ধার করে একই সুবিধার জন্য মোবাইল নেটওয়ার্কের সেল হিসেবে কিন্তু মানুষেরাও ষড়ভুজকেই কাজে লাগায়!

একটি বাস্তব মৌচাক, যার প্রতিটি সেল ষড়ভুজাকার; Image Source: sciencefriday.com

মৌমাছির এত পরিশ্রমের ফল যে মধু, তার আছে নানাবিধ ব্যবহার। খাওয়ার পাশাপাশি ত্বকের যত্নে, ওষুধ তৈরিসহ আরও নানা কাজে এর ব্যবহার আছে। এই খাবার অন্যান্য খাবারের মতো পচে না। পরিশ্রমের ফল যে মিষ্টি হয়, এই বিষয়টার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ হলো মৌমাছির মধু।

আমাদের শস্য, ফল যা কিছু আমরা খাই, তার প্রায় তিনভাগের একভাগ আসে মৌমাছির পরাগায়ণের মাধ্যমে। বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলস্বরূপ মৌমাছির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মৌমাছির বিলুপ্তি ঘটলে খাদ্যশস্যের পরাগায়ণ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব অবলুপ্ত হবে। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে হলেও পরিবেশের সকল প্রাণীর সাথে ভারসাম্য বজায় রেখেই আমাদের চলতে হবে।

Related Articles