আগের পর্বে আমরা ডাইনোসরদের গঠন, শ্রেণীবিন্যাস, আচরণ, বংশবৃদ্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে অল্পবিস্তর জেনেছি। এখন মেসোজোয়িক মহাযুগের প্রথম ধাপ ট্রায়াসিক সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক।
৫১ মিলিয়ন বছরব্যাপী দীর্ঘ এ যুগের সূচনা হয় আজ থেকে প্রায় আড়াইশো মিলিয়ন বছর আগে। একে আবার ৩টি কালে ভাগ করা হয়েছে-
১. প্রাক-ট্রায়াসিক বা Pre Triassic (সময়: ২৫২ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ২৪৭ মিলিয়ন বছর আগপর্যন্ত)
২. মধ্য-ট্রায়াসিক বা Mid Triassic ( সময়: ২৪৭ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ২৩৫ মিলিয়ন বছর আগপর্যন্ত)
৩. শেষ ট্রায়াসিক বা Late Triassic (সময়: ২৩৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ২০১ মিলিয়ন বছর আগপর্যন্ত)
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান জীবাশ্মবিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ অগাস্ট ভন আলবের্তি মধ্য জার্মানিতে অবস্থিত একটি পাথরের স্তরবিন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম ট্রায়াসিক শব্দটি ব্যবহার করেন। এ স্তরটি অবস্থান করছিল পার্মিয়ান যুগের পাথরের স্তর এবং জুরাসিক যুগের পাথরের মধ্যে। ট্রায়াসিক শব্দটি পাথরের তিনটি স্তরকে বোঝাচ্ছিল- বান্টার, মুশেলকল্ক এবং কিপার।
আলবের্তির এ পাথরের স্তরের বিন্যাস পরিচিত 'Germanic facies' নামে। ট্রায়াসিক যুগের স্তরবিন্যাসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এর অনেক অপূর্ণতা ছিল। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে অষ্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং উত্তর ইতালিতে প্রাপ্ত 'Alpine facies' ট্রায়াসিক স্তরকে মোটামুটিভাবে তুলে ধরে। তবে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, উত্তর আমেরিকায় সম্পূর্ণ বিন্যাস আবিষ্কৃত হয়, এবং এটাই এখন ট্রায়াসিক যুগের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত।
ইতোমধ্যে সমুদ্রতলের ভাঙন এবং টেকটোনিক প্লেটের ওপর গবেষণার ফলে ট্রায়াসিক যুগের ভৌগলিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ উদ্ভাবিত হয়েছে, যা আমাদের ধারণা দিয়েছে সেই যুগে প্রাণীজগতের ক্রমবিকাশ এবং বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে। কেন এক যুগ থেকে আরেক যুগে প্রবেশের সময় পৃথিবী অন্তত পাঁচবার গণবিলুপ্তির সম্মুখীন হলো, তা আবিষ্কার করতে জীবাশ্মবিদেরা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভৌগলিক অবস্থা
ট্রায়াসিক যুগের শুরুতে পৃথিবীর মহাদেশগুলো এখনকার অবস্থানে ছিল না। সকল মহাদেশ একত্র অবস্থায় C-আকৃতির বিশালাকার অতি মহাদেশ বা Super Continent অবস্থায় ছিল যার নাম প্যানজিয়া (Pangea)। এর উত্তরে অবস্থিত মহাদেশগুলোকে একত্রে বলা হয় লরেশিয়া (Laurasia) এবং দক্ষিণে অবস্থিত মহাদেশগুলোকে বলা হয় গন্ডোয়ানা (Gondwana)। পৃথিবীর বাকি অংশ ঢাকা ছিল প্যানথালাসা (Panthalassa) নামক এক অতিকায় মহাসাগর দিয়ে, যা প্রস্থে বর্তমান প্রশান্ত মহাসাগরের অন্তত দ্বিগুণ। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ছিল এর বিস্তার। ট্রায়াসিক বিষুবরেখার ত্রিশ ডিগ্রি প্যানাথালাসার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কিছু দ্বীপ, পর্বত এবং আগ্নেয়গিরি সমৃদ্ধ দ্বীপমালা। এদের মধ্যে কোনোটা প্রবালপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাংশ এবং অন্যান্য জায়গায়।
গন্ডোয়ানা এবং লরেশিয়ার মাঝে পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ বরাবর প্যানথালাসার একটি আবদ্ধ জলাধার ছিল, যার নাম টেথিস সাগর। কাকতালীয়ভাবে, বর্তমানে সেই জায়গায় ভূমধ্যসাগরের অবস্থান। টেথিস সাগর পরবর্তীতে শেষ ট্রায়াসিক সময়ে লরেশিয়া এবং গন্ডোয়ানার মধ্যে ফুটো করে, জিব্রালটার হয়ে এগিয়ে যায়। এভাবে যেতে যেতে অবশেষে মধ্য জুরাসিক এবং শেষ জুরাসিক সময়ে এটি প্যানথালাসার পূর্বাংশের সাথে যুক্ত হয় এবং প্যানজিয়া অতিমহাদেশকে সম্পূর্ণ দু'ভাগে ভাগ করে ফেলে। জীবাশ্মবিদেরা বর্তমানে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে এ দুটি মহাদেশকে পুনরায় জুড়তে সক্ষম হয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো বর্তমান মহাদেশগুলোর বাইরের আকার, শিলার রকমভেদ, পর্বতজনিত ঘটনা এবং বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবাশ্ম। এছাড়াও কার্বোনিফেরাস এবং ট্রায়াসিক যুগে বর্তমান আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার মিলিত হওয়া এবং পরবর্তীতে শেষ ট্রায়াসিকে পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নির্দেশ করে ঠিক কখন টেথিস সাগর দুটো মহাদেশকে আলাদা করেছিল।
জলবায়ু
ট্রায়াসিক যুগের জলবায়ু ছিল পুরো পৃথিবী জুড়ে অনেকটা একই রকম। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মধ্যরেখা এবং মেরুরেখার মধ্যে তাপমাত্রার খুব একটা হেরফের ছিল না। যার ফলে জীববৈচিত্র্য ছিল কম। বিশাল প্যানজিয়া মহাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে ছিল শুষ্কতা। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কোনো কোনো অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হত। বিশেষত সেখানে, যেখানে জলাধারের আধিক্য ছিল।
উষ্ণ জলবায়ু ও উচ্চ তাপমাত্রার আরেকটি কারণ ছিল কয়লা বর্জ্য। এদের উপস্থিতিতে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আদ্রতা বৃদ্ধি পেত এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হত। জলনির্গমণের রাস্তার অভাবে অনেক স্থানেই ঘন ঘাস জন্মাত এবং তৈরি হয়েছিল প্রচুর জলাধার। এসব জলাধার ও উদ্ভিদ পরবর্তীতে পিট-এ পরিণত হত। এরকম আর্দ্র পরিবেশ দেখা যেত শেষ ট্রায়াসিক যুগে, বিশেষ করে উঁচু স্থানে। কানাডা, রাশিয়া, ইউক্রেন, চীন, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং এন্টার্কটিকায় শিলার ট্রায়াসিক বিন্যাসের মধ্যে বিজ্ঞানীরা কয়লার এ উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছেন।
ট্রায়াসিক বিলুপ্তি
ট্রায়াসিক যুগের শেষভাগে পৃথিবী আবার সাক্ষী হয় একটি গণবিলুপ্তির, এবং সূচনা হয় জুরাসিক যুগের। বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রজাতি যেমন- কনোডন্টস এবং ট্রায়াসিক সেরাটিটিড অ্যামোনয়েডস অদৃশ্য হয়ে যায়। কেবলমাত্র ফাইলোসেরাটিটিড অ্যামোনয়েডস বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়, যাদের মাধ্যমে পরবর্তীতে জুরাসিক যুগে উত্থান ঘটে সেফালোপডসদের। ব্র্যাকিওপড, গ্যাস্ট্রোপড, বিভালভস এদের বিভিন্ন গোত্র এবং বহু সামুদ্রিক সরীসৃপেরও বিলুপ্তি ঘটে। এছাড়াও স্থলজ মেরুদন্ডী প্রাণীদেরও একটি বিশাল অংশের বিলুপ্তি ঘটে ট্রায়াসিকের শেষভাগে। ডাইনোসর, টেরোসর (উড়ন্ত সরীসৃপ), কুমির, কচ্ছপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং মাছের বেশ ক্ষতিসাধন হয় এ পরিবর্তিত পরিবেশের প্রভাবে।
ট্রায়াসিক বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় প্যানজিয়ার ভাঙনকে, যার ফলে প্রচুর অগ্নুৎপাত হয় এবং বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। সমুদ্রে এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
ট্রায়াসিক জীবন
পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক বিলুপ্তির সময় মেরুদন্ডী প্রাণীরা অমেরুদন্ডী প্রাণীদের তুলনায় কিছুটা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুশেলকল্কে পাওয়া গিয়েছে সামুদ্রিক সরীসৃপের জীবাশ্ম যেমন প্ল্যাকোডন্ট এবং মাছখেকো নথোসর। এরা ট্রায়াসিক যুগে বেঁচে থাকতে পারেনি, তবে এদের বংশধর ছিল বৃহৎ প্লিসিওসর, যারা জুরাসিক যুগে বেঁচে ছিল। ট্রায়াসিক সমুদ্রে বৃহৎ প্রাণী ছিল ইকথিওসর। এছাড়াও ছিল এখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে পুরোনো সরীসৃপদের মধ্যে অন্যতম, ডিনোসেফালোসরাস। এরা আর্কোসরাসদের (ডাইনোসর, টেরোসর, কুমির) নিকটাত্মীয় ছিল, বেঁচে ছিল প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে।
প্রাক-ট্রায়াসিক যুগের মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে ছিল কটিলোসর, থেরাপসিড, ইওসুচিয়ান্স, থেকডোন্টিয়ান্স এবং প্রোটোরোসর। এদের বেশিরভাগই পার্মিয়ান যুগের শেষে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে থেরাপসিড প্রকৃতির প্রাণীগুলো ছিল স্তন্যপায়ী সদৃশ সরীসৃপ। যেমন- লিস্ট্রোসরাস। এদের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এন্টার্কটিকায়। এর ফলে এটাও প্রমাণিত হয় যে এ অঞ্চলগুলো এককালে সংযুক্ত ছিল। প্রাক-ট্রায়াসিক যুগে প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণীর (যেমন-মর্গ্যানুকোডন) উদ্ভব হয়েছিল এই থেরাপসিড থেকেই। এদের জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়েছে গ্রেট ব্রিটেনে।
ট্রায়াসিক ডাইনোসরদের বেশিরভাগই ছিল দ্বী-পদী এবং এরা ছিল সিউডোসচিয়ান্সদের অন্তর্গত। ধারণা করা হয়, এরাই হলো সরিসচিয়ান্স এবং ওর্নিথিসচিয়ান্সদের আদিপুরুষ যারা শেষ ট্রায়াসিক এবং প্রাক জুরাসিক যুগে বিচরণ করত। এরা খুব দ্রুত দৌড়াতে পারদর্শী ছিল এবং আকারে পরবর্তী যুগের ডাইনোসরদের তুলনায় ক্ষুদ্র ছিল। তবে কিছু কিছু ডাইনোসর আকারে বড় ছিল, যেমন- প্লেটিওসরাস। এরা দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ৭ মিটার।
বিবর্তনের ফলে কোনো এক মুহূর্তে কিছু মেরুদন্ডী সরীসৃপ আকাশে ওড়ার ক্ষমতা অর্জন করে। যেমন- শেষ ট্রায়াসিক যুগের ইকারোসরাস। ধারণা করা হয়, এদের পাঁজরের মাঝের চামড়া, বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুথলিতে পরিণত হয় যা এদের প্রাথমিক পর্যায়ে আকাশে ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। অনেকটা আজকের দিনের উড়ন্ত কাঠবেড়ালির মতো। শেষ ট্রায়াসিক যুগেই আবির্ভাব হয় প্রথম উড়ন্ত সরীসৃপ তথা টেরোসরের। একে বলা হয় শ্যারোভিপটেরিক্স। অবশ্য ট্রায়াসিক যুগের শেষে সকল স্বল্প এবং পূর্ণ টেরোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এদের মাধ্যমেই জুরাসিক এবং ক্রিটেশাস যুগে জন্ম নেয় পরবর্তী টেরোসর।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব:
This article is about a short history of Triassic Era
Reference:
Feature Image Source: alphacoders.com