রোগব্যাধির ধারণা এলো যেভাবে

রোগ কী? সহজভাবে, স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিপরীত অবস্থাকেই আমরা রোগ বলি। তবে রোগব্যাধিকে সংজ্ঞায়িত করা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। রোগের ধারণা অনেক বিস্তৃত। একটি রোগের রয়েছে নানা পর্যায়। মৃদু অসুস্থতা থেকে শুরু করে মৃত্যু ঝুঁকি- এ দুয়ের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ নিয়ে হাজির হয় একেকটি রোগ। আবার দেহে জীবাণু প্রবেশের পরও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো লক্ষণ প্রকাশ না-ও পেতে পারে- এ অবস্থাকে বলা হয় ‘সুপ্তাবস্থা’। কখনো আবার একটি রোগের কারণ হিসেবে কাজ করে একাধিক জীবাণু। তাই রোগব্যাধিকে সংজ্ঞার বেড়াজালে আবদ্ধ করা খুব কঠিন। এজন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা প্রদান করলেও রোগের কোনো পরিষ্কার সংজ্ঞা দিতে সক্ষম হয়নি। 

Image Source: Brewminate

প্রাচীনকাল থেকেই রোগব্যাধির ধারণার এ জটিলতা মানুষকে ভুগিয়ে আসছে। একসময় মানুষ অশুভ শক্তিকে রোগের কারণ হিসেবে ভাবতে শুরু করল। ঈশ্বরের অভিশাপ, দেহের নির্দিষ্ট কোনো তরল, দূষিত বায়ু- এসবকে মনে করা হতো রোগব্যাধির কারণ। তখনও জীবাণুর ধারণা মানুষের কল্পনাতেও আসেনি। পরবর্তীতে জীবাণুর ধারণা যখন সামনে এলো তখন দেখা গেল- শুধু জীবাণুই না, একটি রোগের পেছনে আরো নানা বিষয়ও কারণ হিসেবে কাজ করে। এভাবে কালের বিবর্তনে রোগের ধারণায় উঠে এসেছে নানা তত্ত্ব। 

অশুভ শক্তির আস্ফালন

মানব সভ্যতার শুরুর দিকে তিনটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ধর্ম, দর্শন ও চিকিৎসা। রোগব্যাধির ধারণাতেও তাই এর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে। অনেকে মনে করত- অশুভ শক্তি সরাসরি দেহে প্রবেশ করে অসুখের সৃষ্টি করে। আবার কেউ কেউ অসুখকে মানুষের খারাপ কাজের কর্মফল হিসেবে মনে করত। সৃষ্টিকর্তার শাস্তিস্বরুপ এসব রোগব্যাধিকে বরণ করে নিতেন তারা। 

এভাবে প্রায় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোগ সম্পর্কে মানুষের ধারণায় মিশে ছিল কুসংস্কার, ধর্ম, জাদু ও অশুভ শক্তির ছোঁয়া। এগুলোকে বলা হয় রোগের সুপারন্যাচারাল থিওরি

হিউমর তত্ত্ব

গ্রিকরা রোগের এ সুপারন্যাচারাল থিওরিকে মেনে নিতে পারলেন না। বরং হিপোক্রেটিস, গ্যালেনদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা রোগকে প্রাকৃতিক উপায়েই ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। তাদের ধারণা ছিল- মানুষের শরীরের সাথে পরিবেশের মাটি, বায়ু, আগুন ও পানির ওতপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান। পরিবেশের এসব উপাদানের যথাক্রমে ঠাণ্ডা, শুষ্ক, গরম ও আর্দ্র হওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে দেহের চার ধরনের তরল (humor)- শ্লেষা, হলুদ পিত্ত, রক্ত ও কালো পিত্ত।

হিউমর তত্ত্ব;Image Source: gavi.org

তাদের অনুমান ছিল- দেহের চার ধরনের এসব তরলের সাম্যাবস্থাই হচ্ছে সুস্থ থাকা। আর এ চার তরলের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা হলেই দেহে বাসা বাধবে রোগ। দেহে রক্তের আধিক্যের কারণে অসুস্থতা ঘটছে- এমনটি মনে হলে কিছু রক্ত দেহ থেকে বের করে দিয়ে সাম্যাবস্থায় আনার চেষ্টা করা হতো! যদিও হিউমর থিওরি অনেকাংশেই বিজ্ঞানসম্মত ছিল না, তবুও ভারত, চীন ও মিশরেও গ্রিকদের মতো এমন ধারণার প্রচলন ছিল।

মিয়াজমা তত্ত্ব

পরবর্তীতে রোগের কারণ হিসেবে উঠে আসে মিয়াজমা থিওরি। এখানে নিচু বদ্ধ জলাভূমিতে জৈব বস্তুর পচনে তৈরি একপ্রকার বাষ্পকে রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে দেখা হতো। অদৃশ্য, অস্পৃশ্য এ বাষ্পকে বলা হতো ‘Miasm’। ১৮৮০ সালের দিকে জীবাণু তত্ত্ব আবিষ্কারের পূর্বে এ মিয়াজমা তত্ত্বই ছিল ব্যাপক প্রচলিত একটি ভুল ধারণা। তখন ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগও দূষিত বায়ুর মাধ্যমে ছড়ায় বলে মনে করা হতো। ‘Malaria’ শব্দটিই মূলত একটি ইতালিয়ান শব্দ, যার অর্থ ‘দূষিত বায়ু’।

প্লেগ ডাক্তার;Image Source:  ARTEFACT, ALAMY/National Geographic

এমনকি প্লেগ মহামারির কারণ হিসেবেও এ দূষিত বায়ুকে দায়ী করা হতো। প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দুর্গন্ধ এড়াতে ডাক্তাররা অদ্ভুত একপ্রকার মুখোশ ব্যবহার করত। মুখোশের মধ্যে আবার ফুল, লতাপাতা, মধু দিয়ে ভর্তি করা থাকত! ইতিহাসে তারা প্লেগ ডাক্তার নামে পরিচিত। একসময়ে কলেরাকেও এ দূষিত বায়ুর ফল হিসেবে দেখা হতো। ১৮৫০ সালের দিকে জন স্নো দেখান যে- বায়ু না, বরং দূষিত পানির মাধ্যমেই ছড়ায় কলেরা।

সংক্রমণ তত্ত্ব

হিউমর ও মিয়াজমা থিওরির পাশাপাশি রোগ সম্পর্কে আরও একধরনের ধারণার প্রচলন ছিল- গুটি বসন্তের মতো রোগগুলো একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিয়ান চিকিৎসক ফ্রাকাসটরো এ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তখনও অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার না হওয়ায় এরূপ সংক্রমণের পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তুলে ধরা সক্ষম হয়নি।

জীবাণু তত্ত্ব

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশীর্বাদ হিসেবে ধরা দেয় এ জীবাণু তত্ত্ব বা জার্ম থিওরি। কেননা, কোনো রোগের চিকিৎসা করতে হলে আগে তার কারণ জানা আবশ্যক। জীবাণু তত্ত্ব বলে- প্রত্যেক রোগের পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট জীবাণু। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাকসহ যেকোনো জীবাণুই হতে পারে এটি। রোগের এ জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন লুই পাস্তুর ও রবার্ট কখ। ১৮৬০ সাল পরবর্তী সময়ে একে একে আবিষ্কার হয় অ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, কলেরা, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি রোগের জীবাণু। এ যেন অণুজীব বিজ্ঞানের এক স্বর্ণালী যুগ। আর রোগের কারণ চিহ্নিত করা মানেই তার চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের অর্ধেক কাজের সমাপ্তি! সেসময় একের পর এক ওষুধ ও ভ্যাক্সিনের উদ্ভাবন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করে। 

জীবাণু, ব্যক্তি ও পরিবেশের ত্রিভুজ সম্পর্ক

জীবাণু তত্ত্বের আবিষ্কারে রোগব্যাধির ধারণা আধুনিক যুগে প্রবেশ করলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন: যক্ষা রোগের জীবাণু দ্বারা যক্ষা রোগ হলেও এ জীবাণুর সংস্পর্শে আসা সকলেরই কিন্তু যক্ষা হয় না। কেননা, এখানে জীবাণুর (Agent) পাশাপাশি জীবাণুর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির দেহ (host) ও পরিবেশের (environment) বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য প্রভৃতি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জীবাণু ,ব্যক্তি ও পরিবেশের এই ত্রিভুজ সম্পর্কই এপিডেমিওলজিকাল ট্রায়াড। পরবর্তীতে অবশ্য এখানে সময়ের ভূমিকাও রয়েছে বলে মত দেন গবেষকরা।

জীবাণু,ব্যক্তি ও পরিবেশের ত্রিভুজ সম্পর্ক; Image Source: thebiologynotes.com

রোগের বহুমুখী কারণ

জার্ম থিওরির বদৌলতে পাওয়া আশীর্বাদ ভ্যাক্সিন, এন্টিবায়োটিক ও ওষুধের কল্যাণে অনেক রোগই নিরাময় করা সম্ভব হয়। কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ‘আধুনিক’ অসুখ ক্যান্সার, করোনারি হৃদরোগ, মানসিক অসুস্থতা প্রভৃতি, যেগুলো কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য হয় না। সিডেনহ্যাম প্রথম রোগের কারণ হিসেবে বহুমুখী বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। একটি রোগের পেছনে জীবাণু ছাড়াও উঠে আসে জিনগত ও পুষ্টিগত কারণ, মেটাবলিক, মনস্তাত্ত্বিকসহ নানা বিষয়। যেমন: করোনারি হৃদরোগের কারণ হিসেবে কাজ করে অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ, স্থূলতা, ধূমপান, স্বল্প শারীরিক পরিশ্রম প্রভৃতি।

রোগের কারণজাল

যেসব রোগের পেছনে কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণ থাকে না বরং দীর্ঘদিন ধরে বহুমুখী বিষয়ের প্রভাবে হয়, এমন রোগকে বর্ণনায় ম্যাকমেহান ও পিউফ একটি ধারণা দাঁড় করান- ওয়েব অব কজেশন। দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়- এখানে অনেকগুলো বিষয় একটি অপরটির সাথে নানাভাবে সম্পর্কিত, ঠিক যেন জালের মতোই। 

হার্ট অ্যাটাকের কারণজাল; Imagesource:jaypeedigital.com

যেমন: অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাদ্যগ্রহণ, স্থূলতা, ধূমপান প্রভৃতি মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান বা হার্ট অ্যাটাকে ভূমিকা রাখে। এই বিষয়গুলো আবার একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অতিরিক্ত খাদ্যাভ্যাস থেকে স্থূলতা যেমন একাই হার্ট অ্যাটাকের প্রভাবক হতে পারে, তেমনি স্থূলতা থেকে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে সেটিও হার্ট অ্যাটাক ঘটাতে পারে। দুশ্চিন্তা থেকে দীর্ঘস্থায়ী ধূমপায়ী ব্যক্তির যেমন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, তেমনি দুশ্চিন্তা থেকে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়েও তা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। রোগের কারণগুলোর এমন আন্তঃসম্পর্ক তার চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনেও দারুণ ভূমিকা রাখে। আন্তঃসম্পর্কের বিভিন্ন ধাপে বাধার সৃষ্টি করে অসুখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

সময়ের পরিক্রমায় রোগব্যাধির গবেষণায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ধারণা। কোনো রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণায় এর চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রধান হাতিয়ার। অতীতে এই হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। 

Language: Bangla

Topic: Theories Concerning The Causation Of Disease

Necessary references are hyperlinked inside & mentioned below.

References:
1.K. Park.(2021).Park's text book of preventive & social medicine, 26th edition,1-8,39-41

2.Dharmashree Satyarup , Manish Kumar, Radha Prasanna Dalai , Sharmistha Mohanty, Karishma R. Rathor.Theories of Disease Causation: An Overview.Indian Journal of Forensic Medicine & Toxicology, October-December 2020, Vol. 14, No. 4,8075-8079.

Featured Image: thecurrentmsu.com

Related Articles