Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিষ্কারের ইতিহাস: নেপথ্যে ল্যাভেরন এবং রসের অসামান্য অবদানগাথা

প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যের সময়কালের ঘটনা। বেশ কিছুদিন ধরে এথেন্সের বাজারগুলো নীরব। এমনকি গঞ্জের নাট্যমঞ্চগুলোয় কোনো নাট্যকার দাঁড়িয়ে কসরত প্রদর্শন করছে না। বছরজুড়ে উৎসবমুখর থাকা শহর প্রাঙ্গনে আজ কোনো শোরগোল নেই। পুরো শহরের উপর যেন কোনো অশরীরী আত্মা ভর করেছে। যেন অজানা নরক থেকে কোনো দানব নেমে এসেছে দেবতাদের অভিশাপে। এর আসল কারণ পুরো শহর তখন জ্বরের প্রকোপে কাঁপছে। এথেন্সের এমন কোনো ঘর বাকি নেই, যেখানে কেউ জ্বরে ভুগছিলো না। বড় অদ্ভুত সেই জ্বর। কিন্তু হঠাৎ করে এই জ্বর হওয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে গ্রিক রাজ বদ্যি শহরের পশ্চিমের বিশাল ডোবা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। নাকের উপর সাদা কাপড় চেপে তিনি সেদিকে আঙুল তুলে ইশারা করলেন। কিন্তু জ্বরের সাথে এই ডোবার সম্পর্ক কী? রাজবদ্যি তখন জানালেন, ডোবার পানি থেকে উঠে আসা বিষাক্ত বাতাসের প্রভাবে পুরো শহর জুড়ে মানুষ জ্বরের প্রকোপে ভুগছে। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে রোগের নামও রাখা হয়েছে ম্যালেরিয়া, যার অর্থ ‘বিষাক্ত বাতাস’

শুধু গ্রিক সাম্রাজ্যের গণ্ডিতে এই বিশ্বাস আবদ্ধ ছিল না। প্রাচীনকালে পুরো পৃথিবীর মানুষের বিশ্বাস ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রধান কারণ বদ্ধ পানির বিষাক্ত জলীয় বাষ্প। কিন্তু বিজ্ঞান কোনো অমূলক মতবাদ কিংবা আন্দাজের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই এই বিষাক্ত বাতাসের সন্ধানে শুরু হয় গবেষণা। শত বছরের একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে একসময় বেরিয়ে আসে ম্যালেরিয়ার আসল রূপ। খুলে যায় মিথ্যা মুখোশ। আর সেই মুখোশ উন্মোচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন দুই প্রজন্মের কিংবদন্তি বিজ্ঞানী চার্লস ল্যাভেরন এবং রোনাল্ড রস।

একনজরে ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়ার শব্দটি আমাদের নিকট কোনো নতুন শব্দ নয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বইয়ের মাধ্যমে আমরা অনেক ছোট থেকেই ম্যালেরিয়া রোগের সাথে পরিচিত হই। সায়েন্টিফিক আমেরিকার তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ১২৫ ধরনের ম্যালেরিয়া জ্বরের সন্ধান পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়া জ্বর মূলত স্তন্যপায়ী বিভিন্ন প্রাণী, পাখি এবং সরীসৃপদের আক্রান্ত করে থাকে। এদের মধ্যে Plasmodium গণের মাত্র চারটি প্রজাতি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে- P. falciparum, P. malariae, P. vivax এবং P. ovale. 

ম্যালেরিয়া জীবাণু Plasmodium vivax; Source: Wikimedia Commons

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ম্যালেরিয়া এক মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্রবীণত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কিত প্রথম ঐতিহাসিক দলিলটি লিখিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ অব্দে প্রাচীন মিশর সাম্রাজ্যে। এর প্রায় এক হাজার বছর পরে গ্রিক সভ্যতায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রত্যাবর্তন হয়। তবে ঐতিহাসিক দলিলে ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত যেসব তথ্য লাভ করা হয়, তার বেশিরভাগই অবৈজ্ঞানিক ছিল। এসব পাণ্ডুলিপিতে ম্যালেরিয়া রোগের জন্য আর্দ্র বায়ুকে দায়ী করা হয়েছে। তাছাড়া আবদ্ধ জলাশয়ের জলীয় বাষ্পের কারণে ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাব হয় বলে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ম্যালেরিয়ার নামকরণ করা হয় ইতালিয়ান ভাষায়, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘বিষাক্ত বায়ু।’ 

প্রাচীনকালে মানুষ ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে আবদ্ধ জলাশয়ের বাতাসকে দায়ী করতো; Source: Baron Jean François Maurice Dudevan

ম্যালেরিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনচক্র

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে মানুষ ধীরে ধীরে ম্যালেরিয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়। আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, ম্যালেরিয়ার জীবাণুর নাম Plasmodium এবং এর বাহক স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা। এই মশার কামড়ে মানবদেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু প্রবেশ করে এবং লোহিত রক্তকণিকায় আক্রমণ করে থাকে। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে, অ্যানোফিলিস মশা মানুষের রক্ত শুষে নেয়ার সময় ম্যালেরিয়া জীবাণুর স্পোরোজয়েট আমাদের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্রকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়- অযৌন চক্র এবং যৌন চক্র। মানবদেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু মূলত অযৌন চক্র সম্পন্ন করে থাকে। মশার মাধ্যমে প্রবেশ করা স্পোরোজয়েট প্রাথমিকভাবে যকৃতে অবস্থান করে। পরবর্তীতে স্পোরোজয়েটগুলো অসংখ্য মেরোজয়েট উৎপাদন করে।

ম্যালেরিয়ার জীবনচক্র; Source: Research Gate

এই মেরোজয়েটগুলো রক্তের লোহিত কণিকায় আক্রমণ করে। এভাবে একের পর এক লোহিত রক্তকণিকা মেরোজয়েট দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ধ্বংস হয়ে যায়। তখন আমরা জ্বর অনুভব করি। একপর্যায়ে কিছু মেরোজয়েট গ্যামিটোসাইটে রূপান্তরিত হয় যা ম্যালেরিয়ার যৌনচক্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে কোনো অ্যাানোফিলিস মশা যখন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয়, তখন এই গ্যামিটোসাইটগুলো মশার দেহে প্রবেশ করে এবং বেশ কয়েকটি ধাপে স্পোরোজয়েটে রূপান্তরিত হয়। পুনরায় সে মশার কামড়ে সুস্থ কোনো মানুষ ম্যালেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। এভাবে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া জ্বর ছড়িয়ে থাকে। এককালে মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য আর্দ্র বায়ুকে দোষারোপ করতো। প্রাচীনকালের এই ভ্রান্ত ধারণার আড়ালে মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অ্যানোফিলিস মশা দিব্যি এই মহামারী ছড়িয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে সেই সত্যকে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেই আবিষ্কার সম্ভব হলো, তা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বের পৃথিবীতে।

হাজার বছর পূর্বে

চীনের সম্রাট হুয়াং তি কর্তৃক সম্পাদিত চিকিৎসা বিষয়ক ঐতিহাসিক গ্রন্থ Nei Ching-এ প্রথম ম্যালেরিয়ার লক্ষণসমূহ একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো। মিশর, চীন এবং গ্রিসের বিভিন্ন জনবহুল শহরে মৌসুমি ব্যাধি হিসেবে ম্যালেরিয়া ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ম্যালেরিয়ায় প্রাদুর্ভাবে শহরের পর শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে থাকে। এই ভয়ংকর ব্যাধি নিয়ে গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক হিপোক্রেটস বেশ কিছু পুস্তিকা সংকলন করেন। তার পুস্তিকায় ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাব সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের চিকিৎসকগণ সর্বপ্রথম ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হিসেবে আবদ্ধ জলাশয়ের জলীয় বাষ্পকে দায়ী করেন। অপরদিকে ভারতবর্ষের এক সংস্কৃত পণ্ডিত The Compendium of Susruta নামক গ্রন্থে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হিসেবে কোনো বিষাক্ত পতঙ্গের যোগসূত্রতার সম্ভাবনা উল্লেখ করেন। কিন্তু ম্যালেরিয়া রোগের প্রকৃত কারণ, উৎস এবং প্রতিকার বের করতে ব্যর্থ হন তৎকালীন চিকিৎসকগণ।

কাউন্টেস অফ সিংকোনকে সিংকোনা দ্বারা চিকিৎসা করা হয়; Source: Wikimedia Commons

প্রাচীন যুগ পেরিয়ে পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার দিকে ধাবিত হতে থাকে, ঠিক তখন ম্যালেরিয়া গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে একদল স্প্যানিশ যাজক ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে জ্বর নিরাময়ে এক আশ্চর্য ঔষধের সন্ধান লাভ করেন। কিছু নির্দিষ্ট গাছের বাকল নিঃসৃত রস পান করার মাধ্যমে ভারতীয় কবিরাজগণ জ্বর নিরাময় করতেন। তারা এই গাছের বাকল ইউরোপে নিয়ে যান। পরবর্তীতে পেরুর ভাইসরয় কাউন্টেস অফ সিংকোন ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হলে তারা সেই বাকলের নির্যাস প্রয়োগ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি আরোগ্য লাভ করলে তার নামানুসারে গাছের নাম রাখা হয় সিংকোনা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া নিরাময়ে ব্যবহৃত সকল ঔষধের মধ্যে সিংকোনা থেকে তৈরিকৃত কুইনাইন সবচেয়ে বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ম্যালেরিয়া রোগের নিরাময় আবিষ্কৃত হলেও এর রোগের উৎস এবং অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য তখনও বের করা সম্ভব হয়নি।

চার্লস ল্যাভেরনের চমক

চার্লস লুই আলফানসো ল্যাভেরন ১৮৪৫ সালের ১৮ জুন প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ফ্রান্স সামরিক বাহিনীর নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক। পিতার আদর্শে বড় হয়ে উঠা ল্যাভেরন তাই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনিও ফ্রান্স সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের বিভিন্ন জটিল সমস্যা নিয়ে নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতেন ল্যাভেরন। ১৮৭৮ সালের ল্যাভেরনকে আলজেরিয়াতে বদলি করে দেয়া হয়। ঘটনাক্রমে তখন আলজেরিয়া জুড়ে ম্যালেরিয়া মহামারি চলছিলো। প্রতিনিয়ত শত শত রোগী হাসপাতালে এসে ভর্তি হতে থাকলো। আর দিনভর চিকিৎসা করে অবসর সময়ে ল্যাভেরন রোগীদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতেন। ১৮৮০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এক রোগীর রক্তের নমুনাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ৪০০ গুণ বড় করে পরীক্ষা করছিলেন। তখন তিনি লোহিত রক্তকণিকার ভেতর বেশ অদ্ভুত কিছু বস্তু লক্ষ্য করেন। প্রাথমিকভাবে দেখতে অনেকটা ব্যাক্টেরিয়ার মতো মনে হচ্ছিলো। চৌকস গবেষক ল্যাভেরন আরো কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, এগুলো ব্যাক্টেরিয়া নয়। বরং এই জীবগুলো অন্য প্রজাতির কোনো জীবাণু। এর মাধ্যমে যেন হাজার বছরের অধরা রহস্য সমাধান করে ফেলেন তিনি। খুব দ্রুত তিনি এই আবিষ্কারের কথা জানিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র প্রদান করেন। এভাবে ফরাসি সেনাবাহিনীর এক নিষ্ঠাবান ডাক্তারের হাত ধরে শুরু হয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু Plasmodium-কে আবিষ্কারের যাত্রা।

চার্লস লুই আলফানসো ল্যাভেরন; Source: Famous People

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর ইরউইন শেরমান ল্যাভেরন কীর্তি সম্পর্কে মন্তব্য করেন,

“সে নিশ্চিত ছিল এগুলো ব্যাক্টেরিয়া নয়। এত কম ক্ষমতাসম্পন্ন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এত বড় যুগান্তকারী অনুসন্ধান করা শুধু ল্যাভেরনের ক্ষেত্রেই সম্ভব। এমনকি তার জার্নালে বিভিন্ন চিত্র এবং বর্ণনা অত্যন্ত নিখুঁত এবং বিস্তারিত ছিল। একজন গবেষক হিসেবে ল্যাভেরন প্রথম সারির সম্মানের দাবি রাখে।”

কিন্তু ল্যাভেরনের যাত্রা সহজ ছিল না। অনেকেই ল্যাভেরনের আবিষ্কারকে মিথ্যা দাবি করেছিলো। কিন্তু ল্যাভেরন বেশ গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে Plasmodium সম্পর্কিত বিভিন্ন বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটন করেন। তার এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৭ সালে তাকে চিকিৎসায় সম্মানজনক নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়।

স্যার রোনাল্ড রসের কীর্তি

চার্লস ল্যাভেরন যদিও ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, কিন্তু তখনও জলাশয়ের ভূত আমাদের পিছু ছাড়েনি। ঠিক কীভাবে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে, এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞ ছিলেন। এমনকি ল্যাভেরনের ম্যালেরিয়া জীবনচক্রও অসম্পূর্ণ ছিল। এই অজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানকে উদ্ধার করতে দৃশ্যপটে হাজির হন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। রোনাল্ড রসের আবির্ভাবের পূর্বে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ম্যালেরিয়া গবেষণায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন গবেষকদের অনুসন্ধানের ফলে Plasmodium-এর চারটি প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। ইতালীয় বিজ্ঞানী ক্যামিলো গলগি বিভিন্ন ধরনের ম্যালেরিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেন।

স্যার রোনাল্ড রস; Source: Wellcome Library, London

স্যার রোনাল্ড রসের জন্ম ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের আলমোরা অঞ্চলে। তার পিতা স্যার সি সি রস তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে গ্রেট ব্রিটেনে ফেরত পাঠানো হয়। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন তিনি। যদিও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যায়ন করার কোনো অভিলাষ পোষণ করেননি, তার পিতার ইচ্ছানুযায়ী তাকে মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। জেনারেল সি সি রস স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে ডাক্তার হয়ে ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরি করবে। চার্লস ল্যাভেরনের ন্যায় রোনাল্ড রসও একজন সামরিক ডাক্তার হয়ে উঠেন। কর্মজীবনের শুরু থেকেই রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চার্লস ল্যাভেরন এবং প্যাট্রিক ম্যানসনের ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত জার্নাল নিয়ে কাজ করতেন। ল্যাভেরন তার এক জার্নালে ম্যালেরিয়ার সাথে মশার যোগসূত্র থাকার কথা ধারণা করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। রোনাল্ড রস ল্যাভেরনের প্রস্তাবিত তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুদিন পর রোনাল্ড রস ভারতবর্ষে বদলি হয়ে যান। পিতার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে ইংল্যাণ্ডের মায়াত্যাগ করে তিনি বোম্বের জাহাজে উঠে পড়েন। তার পিছু পিছু ম্যালেরিয়ার ভূতও ভারতবর্ষে গিয়ে পৌঁছে। তিনি সেখানে গিয়ে বেশ মজার একটি পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ম্যালেরিয়া রোগীর উপর এই পরীক্ষা শুরু করেন। প্রথমে তিনি সুরক্ষিত পরিবেশে মশার চাষ করেন। তারপর গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তিনি তাদের উপর মশা লেলিয়ে দেন। এই অভিনব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বেশ সমালোচিত হলেও তিনি থেমে যাননি। তিনি সেই মশাগুলোর দেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু সন্ধান করতে থাকেন। প্রথম দু’বছরে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। তবে ১৮৯৭ সালে তিনি রাতারাতি বেশ বড় আবিষ্কার করে ফেললেন।

স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা; Source: CDC

সেবার রস কিছু দুর্লভ প্রজাতির মশার উপর পরীক্ষা করছিলেন। তখন তিনি মশাগুলোর পাকস্থলীতে এমন কিছু বস্তু লক্ষ্য করেন যার সাথে ম্যালেরিয়াস স্পোরোজয়েটের খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ হওয়া রস এবার আশার আলো দেখতে পান। কিন্তু ওদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রসকে সতর্কবার্তা পাঠানো হলো। এরকম অদ্ভুত অনিরাপদ গবেষণা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রসকে আদেশ প্রদান করা হলো। রস সরকারি আদেশ অমান্য করার দুঃসাহসিকতা দেখাননি। তিনি এবার মানুষের বদলে পাখির উপর গবেষণা শুরু করেন। এই ঘটনা তার জীবনে শাপে বর হয়ে ধরা দিলো। এবার রস আরো দ্রুত ম্যালেরিয়ার জীবনচক্রের অমীমাংসিত ধাঁধা সমাধান করতে সক্ষম হলেন। তিনি পাখির ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র সম্পন্ন করার পর মানুষের ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্রের পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরি করেন। রস প্রমাণ করলেন, ম্যালেরিয়া ছড়ানোর পেছনে দায়ী প্রধান পতঙ্গ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা। এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্যার রোনাল্ড রসকে ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, স্যার রস বিজ্ঞানী ল্যাভেরনের ৫ বছর পূর্বে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন।

রোনাল্ড রসের নোটবুক; Source: LSHTM Library & Archives Service

এভাবে দুই পথিকৃতের হাত ধরে প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া জীবাণুর রহস্য আমাদের নিকট ফাঁস হয়ে যায়। প্রাচীনকালের ভ্রান্ত ধারণার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বিজ্ঞান। এই দুই বিজ্ঞানীর কাজের উপর ভিত্তি করে ম্যালেরিয়ার উপর অন্যান্য যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে থাকে। বিজ্ঞানী জিওভানি বাতিস্তা এবং রবার্ট কচ ল্যাভেরন-রসের জ্ঞানকে আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যান। আবিষ্কার হয় ক্লোরোকুইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণরক্ষাকারী ঔষধ। একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে পড়লো। ১৯০৬ সালের ঘটনা। পুরোদমে পানামা খাল খননের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২৬ হাজার কর্মীর মাঝে ২১ হাজার কর্মী ম্যালেরিয়া এবং পীত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। কী ভয়াবহ অবস্থা! খাল খননের কাজ একেবারে বন্ধ হওয়ার যোগাড়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে খুব দ্রুত ম্যালেরিয়ার ঔষধ সেবন করা প্রয়োজন ছিল। ম্যালেরিয়া চিকিৎসার মাধ্যমে ১৯১২ সালের মধ্যে আক্রান্ত কর্মীর সংখ্যা ৫ হাজারে নামিয়ে আনা হলো। সেই যাত্রায় সবাই বেঁচে যায়। খাল খননের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলে। অথচ কয়েক বছর পূর্বেও মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে এক অজানা অজ্ঞতার অভিশাপে প্রাণ হারাতো। অন্ধের মতো জলাশয়ের ভূতকে তাড়া করতে গিয়ে যেন নিজেই পথ হারিয়ে ফেলতো। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে ল্যাভেরন এবং স্যার রসের ন্যায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। তাদের নিকট চিকিৎসা বিজ্ঞান চিরঋণী।

ফিচার ইমেজ: Expert Chikitsha

Related Articles