আজ বাতাসের চাপ কেমন? বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? এসব জানার একটি সহজ উপায় হলো ব্যারোমিটারের সাহায্যে বায়ুচাপ নির্ণয়। কী এই ব্যারোমিটার? ব্যারোমিটার হলো মূলত বায়ুচাপ নির্ণয়ের একটি যন্ত্র। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই আবিষ্কারের পেছনে একটি মজার ইতিহাস আছে যা অনেকেরই অজানা। কী সেই ইতিহাস? চলুন জেনে নেয়া যাক।
'ব্যারোমিটার' শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'ব্যারোস’ এবং 'মেট্রোন’ থেকে। 'ব্যারোস’ শব্দের অর্থ ওজন এবং 'মেট্রোন’ শব্দের অর্থ 'পরিমাপ'। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইতালিতে অনেক বিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে ভ্যাকুয়াম এবং বায়ুচাপ সম্পর্কিত তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যেই একজন হলেন টরিসেলি। তাকেই মূলত ব্যারোমিটারের উদ্ভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়।
গ্যালিলিও এর সেই বিখ্যাত ' টাওয়ার অব পিজা'-এর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? তিনি দেখিয়েছিলেন, বায়ুর বাধা না থাকলে ভারী এবং হালকা বস্তু একই সময়ে নিচে এসে পড়ে। এখান থেকে আমরা বায়ুচাপ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বায়ুচাপের তারতম্য দেখা যায়। সমুদ্র সমতলে বায়ুচাপ সবচেয়ে বেশি। যত উপরে ওঠা যায়, বায়ুচাপ ততই কমতে থাকে। এমনকি একটি স্থানের বায়ুচাপও কখনও ধ্রুবক থাকে না, পরিবর্তিত হতে থাকে। এর কারণ হলো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ক্রমাগত ঘুরছে। ফলে বিভিন্ন স্থান বিভিন্ন পরিমাণ তাপ গ্রহণ করছে। টরিসেলি বায়ুচাপের তারতম্যের এ বিষয়টি খেয়াল করেন। বায়ুচাপকে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করলে প্রতি বর্গক্ষেত্রে প্রযুক্ত বলকে বোঝায়। এ থেকে বোঝা যায়, বায়ুরও ওজন আছে। টরিসেলি প্রকৃতপক্ষে বায়ুচাপকে ওজনে রূপান্তর করেই কাজ করেছিলেন।
কীভাবে টরিসেলি বায়ুচাপের তারতম্যের বিষয়টি বুঝেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে গ্যালিলিও এ ধারণার সূচনা করেন। বহু শতাব্দী পূর্বে অ্যারিস্টটলসহ কয়েকজন প্রাচীন দার্শনিক মতবাদ দেন, প্রকৃতিতে ভ্যাকুয়াম বা বায়ুশূন্য ফাঁকা স্থান থাকা সম্ভব নয়। বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা এ ধারণার সাথে একমত পোষণ করে এসেছিলেন। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে এ ধারণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা যায়। কী ছিল এই বিভ্রান্তির কারণ?
চোষণ পাম্পে পানি উত্তোলন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দেখা দেয় চিন্তাশীলতা। যেসকল বিজ্ঞানী পানির ঘনত্ব ও স্তম্ভের উচ্চতা সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, গ্যালিলিওকে তাদের মধ্যে অন্যতম ধরা হয়। শোনা যায়, তিনি একটি লম্বা টিউবকে কুয়ায় ডোবান যা একটি পাম্প দ্বারা চালনা করা হয়। কিন্তু তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন, যত পরিশ্রমই করা হোক না কেন, ৯.৭ মিটারের বেশি উচ্চতায় পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি পরীক্ষায় একই ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি উপলব্ধি করলেন, প্রকৃতপক্ষে বায়ুচাপই পানির পৃষ্ঠে বল প্রয়োগ করে পানি উত্তোলন করে থাকে। এজন্য প্রথমে পাম্প থেকে বাতাস অপসারণ করে ভ্যাকুয়াম অবস্থার সৃষ্টি করা দরকার।
গ্যালিলিওর শিক্ষার্থী হিসেবে টরিসেলি গ্যালিলিওর পরীক্ষা নিয়ে কাজের জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। তিনি মূলত গ্যালিলিওর ভ্যাকুয়াম তত্ত্ব নিয়েই কাজ করছিলেন। গ্যালিলিওর তত্ত্ব ব্যারোমিটারের উদ্ভাবনকে এগিয়ে নিতে অনেকটা সহায়ক ছিল। গ্যালিলিওই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি ভ্যাকুয়াম যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল 'ভ্যাকুয়াম তত্ত্ব'-এর অনুমোদন। তবে এক্ষেত্রে তিনি পরিবেশের বায়ুচাপের তারতম্য নির্ণয়ের জন্য কোনো প্রচেষ্টা চালাননি। যদিও তার ভ্যাকুয়াম নীতিই ব্যারোমিটারের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
যা-ই হোক, টরিসেলি তার পরীক্ষায় প্রথমে একটি লম্বা টিউবকে পানিপূর্ণ করলেন। পরবর্তীতে তিনি এ টিউবকে উল্টিয়ে পানির একটি ধারকের মধ্যে রাখলেন। টিউবে পানির ধীর অপসারণ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, পানির উপর যে একমাত্র বল কাজ করছিল সেটি নিশ্চিতভাবে বায়ুর বল বা ওজন। তবে দু'ধরনের বলের মধ্যে ভারসাম্য কাজ করছিল-
১. পরিবেশের বাতাস দ্বারা পানিতে প্রযুক্ত বল।
২. টিউবের অভ্যন্তরে পানির বল।
তবে টরিসেলি তার পরীক্ষার প্রথমেই বিপত্তির শিকার হন। কেননা, তখন তিনি তরল হিসেবে এ পরীক্ষায় পানি ব্যবহার করেন। পানি ব্যবহারে এখানে বিপত্তিটা কোথায়? পানি অপেক্ষাকৃত হালকা হওয়ায় টরিসেলির প্রথম ব্যারোমিটারটির উচ্চতা হওয়া প্রয়োজন ছিল প্রায় ৩৫ ফুট, যা তার বাড়ির ছাদ ফুঁড়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়! এক্ষেত্রে তিনি তার বিশাল পানির স্তম্ভের উপর একটি পুতুল বসান যাতে তার নড়াচড়া থেকে পরিবেশের বায়ুচাপের তারতম্য নির্ণয় করতে পারেন।
কিন্তু এটি আরেক সমস্যার সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশিরা গুজব শুরু করে। অনেকে সন্দেহ করে, টরিসেলি জাদুবিদ্যার চর্চা শুরু করে দিয়েছেন! এ ধরনের গুজবের মুখোমুখি হলে টরিসেলি উপলব্ধি করেন, তাকে আরও গোপনে কাজ করতে হবে এবং সেজন্য তাকে আরও ভারী কোনো তরল ব্যবহার করতে হবে। ভারী তরল পদার্থ হিসেবে তিনি বেছে নেন পারদ বা 'মার্কারি’। ফলে এবার আর ৩৫ ফুট লম্বা স্তম্ভের দরকার হলো না, ৩২ ইঞ্চি ছোট টিউব দিয়েই কাজ হলো। এতে করে প্রতিবেশিদের অভিযোগ ছাড়াই গোপনে কার্যক্রম চালাতে পারলেন টরিসেলি।
পারদ দ্বারা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি দেখলেন, টিউবের মধ্যে পারদ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় এসে থেমে যায় এবং উপরে কিছু স্থান ফাঁকা থেকে যায়। এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, পারদের ভারসাম্য ততক্ষণই বজায় থাকে যতক্ষণ বায়ুর ওজন এবং পারদের ওজনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। টরিসেলি পরবর্তীতে উল্লেখ করেন, প্রতিদিন টিউবের পারদের উচ্চতা পরিবর্তিত হতো। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, প্রতিদিন পরিবেশে বায়ুচাপের পরিবর্তনের কারণে এ পরিবর্তন হয়। এ সম্পর্কে তিনি লেখেন, "প্রকৃতপক্ষে আমরা একটি বায়ুর সমুদ্রে বাস করি এবং নিঃসন্দেহে এ বায়ুর ওজন আছে।" এদিকে সে ময় অধিকাংশ বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করতেন, বায়ুর কোনো ওজন নেই। তাই টরিসেলির এ ধারণা ছিল একেবারেই নতুন।
তবে কেমন ছিল এই ব্যারোমিটারের বায়ুচাপ নির্ণয় প্রক্রিয়া? খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে কিছুটা এরকম- একটি বায়ুশূন্য গ্লাস টিউবকে একটি পারদপূর্ণ পাত্রে নেয়া হয়। পাত্রের পারদের উপর পরিবেশের বাতাস চাপের কারণে টিউবে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পারদের স্তম্ভ থেমে যায়। এ উচ্চতা থেকে বায়ুচাপ নির্ণয় করা হয়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহৃত হয়,
বায়ুচাপ = পারদের স্তম্ভের উচ্চতা × তরলের ঘনত্ব × অভিকর্ষজ ত্বরণ
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৬৪৬ সালের দিকে বিজ্ঞানী প্যাসকেলও টরিসেলির পরীক্ষা-কার্যক্রম নিয়ে কাজ শুরু করেন। কথিত আছে, তিনি তার এক আত্মীয়কে পাহাড়ের উপর নিয়ে ব্যারোমিটারের পারদের উচ্চতা নির্ণয় করতে বলেন। ফলাফলস্বরূপ দেখা যায়, পারদের উচ্চতা নিচে নেমে আসে। তবে এ পরীক্ষার তাৎপর্য কী ছিল? এ পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়েছে উঁচু স্থানে বায়ুচাপ কমে যায়। অর্থাৎ বায়ুর উল্লম্ব ওজন আছে।
সেসময় বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত। সেই কারণে গ্যালিলিও বাইবেলের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণন নিয়ে মতবাদ দেয়ার কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত হন। এদিকে টরিসেলির এ উদ্ভাবনের সাথেও চার্চের সংঘর্ষের উপক্রম হয়েছিল। সেটা কীরকম?
ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানের মতবাদ খ্রিস্টধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ ছিল। কেননা, ধর্মের নীতি অনুযায়ী, সৃষ্টিকর্তার অবস্থান সব জায়গায়। এক্ষেত্রে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান থাকার কোনো অবকাশ নেই। যা-ই হোক, টরিসেলি প্রায় একশো বছর পর তার উদ্ভাবনের স্বীকৃতি পান।
১৬৭০ সালের দিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের যন্ত্র হিসেবে ঘর-বাড়িতে ব্যারেমিটারের ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তী দু'শো বছরের মধ্যে মার্কারি ব্যারোমিটার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমুদ্রযাত্রার জন্য 'মেরিন ব্যারোমিটার’ নামে ব্যারোমিটারের ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন রকম ব্যারোমিটারের উদ্ভাবন হয়। এমনকি উড়োজাহাজের যে প্রথম অ্যাল্টিমিটার বা উচ্চতা মাপার যন্ত্রবিশেষ, সেগুলো একপ্রকার ব্যারোমিটারই ছিল।
বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত সংস্করণের ব্যারোমিটারের ব্যবহার দেখা যায়, যার অধিকাংশই 'অ্যানিরয়েড’। তবে ব্যারোমিটারের মৌলিক সংস্করণের উদ্ভাবনের জন্য টরিসেলিকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। আর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যে ব্যারোমিটারের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ তা তো বলাই বাহুল্য।
This is a Bengali article describing how Barometer had been invented.
Reference:
1. Barometer
4. The barometer experiments made by Blaise Pascal
Featured image- chemistryworld.com