Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তারা সব হীরার থেকে দামী

ইতিহাস বলে যে, মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই অলংকার পরিধান করে আসছে। অলংকার সভ্যতার প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যায় ঝিনুক, শামুক বা হাড়ের টুকরা। পরবর্তীতে অলংকার হিসেবে ব্যবহার হয় নানা রকম উজ্জ্বল পাথর এবং আধুনিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের জেমস্টোন (gemstones) বা রত্নপাথর যা সোনা, রূপা বা তামার উপর বসানো হয়ে থাকে। প্রকৃতিতে এসব রত্নের স্ফটিক (Crystal) তৈরীতে লেগে গিয়েছে বহু মিলিয়ন বছর। সেসব ক্রিস্টালের সামান্য অংশই আমরা পেয়ে থাকি এবং জেমস্টোন হিসেবে ব্যবহার করি।

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের ধারণাই এই যে, ডায়মন্ড বা হীরকই পৃথিবীতে দাম এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে একমাত্র মূল্যবান রত্ন। এমনকি সন্তানকেও তার অভিভাবকেরা ‘হীরার টুকরা’ ছেলে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর থাকেন সবসময়। তবে সত্য কথা বলতে হীরকই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবথেকে দামী রত্ন নয়। এর থেকেও অনেক দামী রত্নের অস্তিত্ব আছে পৃথিবীতে। এসব রত্নেরা কিছুটা দুর্লভও বটে। এই লেখায় থাকবে সেই সব রত্নপাথরদের নানা কথা। চলুন জানা যাক সেসব দামী ও দুর্লভ রত্নদের সম্বন্ধে।

১) পেইনাইট (Painite)

পেইনাইট টুকরা

মূল্যবান রত্ন পাথরের তালিকায় প্রথমেই আসে পেইনাইটের কথা। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ খনিজবিদ আর্থার সি. ডি. পেইন (Arthur C. D. Paine) অসচরাচর বৈশিষ্ট্যের এই খনিজ আবিষ্কার করেন। প্রথমদিকে এটি বেশ দুর্লভ থাকলেও এখন ঠিক ততটাও দুর্লভ না। কারণ আবিষ্কারের পরে প্রায় এক দশক পর্যন্ত এই খনিজের মাত্র দুইটি খণ্ডই বিদ্যমান ছিলো সারা পৃথিবীতে। সাম্প্রতিক সময়ে এই পাথরের আরো কয়েকটি খনিজ টুকরা পাওয়া গিয়েছে। মূলত মায়ানমারকেই এই পাথরের মূল প্রাপ্তিস্থান হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে মগক (Mogok) এলাকার ২টি অঞ্চলে পেইনাইটের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু পেইনাইটই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর দুর্লভ রত্ন পাথরের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এর মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে আছে ক্যালসিয়াম, জিরকোনিয়াম, বোরন, এলুমিনিয়াম, অক্সিজেন।

২) আলেক্সান্ড্রাইট (Alexandrite)

আলেক্সান্ড্রাইট

রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারের নামানুসারে এই পাথরের নামকরণ করা হয় আলেক্সান্ড্রাইট। ১৮৩০ সালের দিকে রাশিয়ার উরাল পর্বতের কাছাকাছি এই খনিজের সন্ধান পাওয়া যায়। আলেক্সান্ড্রাইট ক্রিস্টালের মূল আকর্ষণ হচ্ছে এর অদ্ভুত ধরণের আলোকীয় চরিত্র। কারণ আপতিত আলোর বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এই ক্রিস্টালের রং পরিবর্তনের (লাল থেকে সবুজ) ক্ষমতা অসাধারণ এবং আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে একই আলোর জন্যও দর্শণ কোণের উপর ভিত্তি করে এর রঙ আলাদা হয়ে যেতে পারে। আপতিত আলো ও দর্শণ কোণের উপর ভিত্তি করে ক্রিস্টালের বর্ণ পরিবর্তনের এই ক্ষমতাকে বলা হয় ‘প্লেওক্রোইজম’ (Pleochroism)। আর আলেক্সান্ড্রাইট এদিক থেকে অতিমাত্রায় প্লেওক্রোইক।

যেমন- সূর্যের আলোয় এর বর্ণ হয়ে থাকে সবুজাভ নীল, কিন্তু হাল্কা ইঙ্ক্যান্ডিসেন্ট (incandescent) আলোয় এর বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায় লালাভ বেগুনী রঙে (চিত্রে দেখানো হয়েছে)। প্রধানত টাইটেনিয়াম, আয়রন ও ক্রোমিয়ামের সমন্বয়ে তৈরী এই ক্রিস্টালকে পান্না (emerald) বর্গের ক্রাইসোবেরিল (Chrysoberyl) গোত্রের সদস্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়। উল্লেখ্য টাইটেনিয়াম, আয়রন ও ক্রোমিয়ামের এই সমন্বয় খুবই দুর্লভ, ফলে এই খনিজটিও দুর্লভ।

(Chrysoberyl: বেরিলিয়াম ও এলুমিনিয়ামের অক্সাইড-এর সমন্বয়ে তৈরী একপ্রকার সবুজাভ অথবা হলুদাভ সবুজ রঙের খনিজ)।

৩) তাঞ্জানাইট (Tanzanite)

তাঞ্জানাইট

তাঞ্জানাইট সম্পর্কে বলতে গেলে বলতেই হয় যে এটি হীরকের থেকেও প্রায় ১০০০ গুণ বেশি দুষ্প্রাপ্য। এর প্রাপ্তিস্থান মূলত উত্তর তাঞ্জানিয়ার কিলিমাঞ্জারো পর্বতের পাদদেশে, যদিও এর সরবরাহ খুবই নগন্য। আলেক্সান্ড্রাইটের মতো তাঞ্জানাইটেরও নিজের বর্ণ পরিবর্তনের আশ্চর্য ক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়। এর বর্ণ পরিবর্তন নির্ভর করে মূলত আপতিত আলোর প্রকৃতির উপর এবং ক্রিস্টালের ক্রিস্টালিনিটির (Crystallinity) উপর।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে উল্লম্ব সমবর্তিত (Polarized) আলো, অসমবর্তিত আলো এবং অনুভূমিক সমবর্তিত আলোর জন্য তাঞ্জানাইটের বর্ণের পরিবর্তন কীরূপ হয়ে থাকে। মূলত তাঞ্জানাইট ক্রিস্টালে উপস্থিত ভ্যানাডিয়ামের কারণেই এর এরূপ বর্ণ পরিবর্তন হয়ে থাকে। এর প্রাপ্যতা সীমিত হওয়ার কারণে প্রায় ২০-৩০ বছর পর পর এর উত্তোলন করা হয়ে থাকে। তাঞ্জানাইটের মূল উপাদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যালসিয়াম, এলুমিনিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, সিলিকন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন।

৪) বেনিটোইট (Benitoite)

বেনিটোইট

নীল বর্ণের অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই রত্নপাথরের নামের সাথেই মিশে আছে এর একমাত্র বাসস্থানের নাম। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বেনিটো বিভাগের স্যান বেনিটো নদীর প্রধান শাখার কাছাকাছিই এই পাথরের সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও কিছু কিছু উৎস থেকে জানা যায় যে জাপান ও আরকান্সাসে সীমিত পরিমাণ বেনিটোইট পাওয়া যায়। তবে সেগুলো ঠিক জেমস্টোনের মতো নয়। শুধুমাত্র স্যান বেনিটোর তীরে পাওয়া পাথরকেই মূলত বেনিটোইট রত্নপাথর হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বেনিটোইটকে স্যাফায়ার (sapphire) বা নীলকান্তমণি বর্গের সদস্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

বেনিটোইটের একটি আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্ট্রাভায়োলেট আলোর নিচে যদি একে রাখা হয় তবে এটি অত্যন্ত উজ্জ্বল নীল বর্ণের আলোক স্মারক প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে। এই পাথরের প্রতিপ্রভা সৃষ্টির ক্ষমতা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারলেও ঠিক কোন রাসায়নিক উপাদানের জন্য এমনটা হয়ে থাকে তা এখনো অজানাই থেকে গেছে। বেনিটোইটের মূল গাঠনিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে বেরিয়াম, টাইটেনিয়াম, সিলিকন ও অক্সিজেন।

৫) পাউড্রেটেইট (Poudretteite)

পাউড্রেটেইট

যদিও পাউড্রেটেইট প্রথম পাওয়া যায় ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি, কিন্তু নতুন প্রজাতির রত্ন পাথরের স্বীকৃতি পেতে সময়টা গড়িয়ে গিয়েছিলো ১৯৮৭ পর্যন্ত। মূলত কুইবেক প্রদেশের মন্ট সেইন্ট হিলাইর (Mont Saint Hilaire) অঞ্চলেই এই পাথরের প্রাপ্তিস্থান। কিন্তু অনেকে এর সম্বন্ধে জানেই না। এই ক্রিস্টালটি প্রাকৃতিকভাবে হালকা গোলাপী বর্ণের হয়ে থাকে। এর মূল গাঠনিক উপাদানের মধ্যে আছে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, বোরন, সিলিকন ও অক্সিজেন।

৬) গ্রান্ডিডায়ারাইট (Grandidierite)

গ্রান্ডিডায়ারাইট

নীলাভ সবুজ বর্ণবিশিষ্ট এই খনিজের সন্ধান পাওয়া যায় একমাত্র মাদাগাস্কার অঞ্চলে। যদিও এই খনিজের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র যে ক্রিস্টালটি, সেটা শ্রীলংকা থেকে আবিষ্কার করা হয়েছিলো। আলেক্সাড্রাইট ও তাঞ্জানাইটের মতো গ্রান্ডিডায়ারাইটও প্লেওক্রোয়িক ধরণের হয়ে থাকে। এই ক্রিস্টালটি নীল, সবুজ ও সাদা রঙের আলোই প্রতিসরিত করতে পারে। এর মূল গাঠনিক উপাদানের মধ্যে আছে ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, এলুমিনিয়াম, বোরন ও অক্সিজেন।

৭) লোহিত হীরা (Red Diamonds)

রেড ডায়মন্ড

এই ক্রিস্টালের নাম থেকে সহজেই ধরে নেয়া যায় যে এটি হীরক গোত্রের। যদিও হীরকের কথা শুনলে আমাদের কল্পনায় প্রথমেই চলে আসে স্বচ্ছ বর্ণের হীরকখণ্ড। কিন্তু বাস্তবে হীরক হলুদ, বাদামী, বর্ণহীন, নীল, সবুজ, কালো গোলাপী, কমলা, বেগুনী বা লাল রঙের হতে পারে। তবে এগুলো খুবই দুষ্প্রাপ্য। লোহিত হীরা বা লাল হীরা এদেরই একটি।

প্রকৃতপক্ষে আপনার হাতের কাছে জুয়েলারির দোকান থেকে যেটাকে আপনি হীরা ভেবে কিনে শান্তি পাচ্ছেন, সেটা কিন্তু আসলেই এত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য হীরাদের কাছে কিছুই না। রেড ডায়মন্ড-এর দুষ্প্রাপ্যতা এতই যে পৃথিবীতে পাওয়া এর বৃহৎ খণ্ডটির ওজন ছিলো প্রায় ৫.১১ ক্যারাট (প্রায় ১ গ্রামের সমান)। কিন্তু সাধারণ হীরকের একটি বৃহৎ খণ্ডের ওজন হতে পারে প্রায় ৩১০৬.৭৬ ক্যারাট। এখান থেকেই পার্থক্যটা বোঝা যাচ্ছে ভালোভাবে।

৮) মাসগ্রাভাইট (Musgravite)

মাসগ্রাভাইট

১৯৬৭ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মাসগ্রেভ এলাকায় এই পাথরের খনিজ পাওয়া যায় সর্বপ্রথম। কিন্তু এর বিস্তৃতি কেবল অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ না। কিছু পরিমাণ মাসগ্রাভাইট মাদাগাস্কার, গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্টিকা অঞ্চলেও পাওয়া যায়। এই পাথরের সর্বপ্রথম পাওয়া নমুনাটি ছিলো তুলনামূলকভাবে বেশ বড় যা জেমস্টোন তৈরীর জন্য উপযুক্ত। তবে ধারণা করা হয় যে সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত মোটামুটি আটখানা মাসগ্রাভাইট খণ্ড বর্তমান। এর মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে আছে ম্যাগনেসিয়াম, বেরিলিয়াম, এলুমিনিয়াম, জিংক, আয়রন ও অক্সিজেন।

৯) জেরেমেজেভাইট (Jeremejevite)

জেরেমেজেভাইট

ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে সাইবেরিয়ার আডুন-চিলন পর্বতে (Adun-Chilon Mountains) এই ধরণের খনিজের সন্ধান পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত হওয়া এর ক্রিস্টালগুলো জেমস্টোন তৈরী করার জন্য যথেষ্ট বড় ছিলো। মূলত সাইবেরিয়া অঞ্চলে পাওয়া গেলেও সীমিত পরিমাণে জেরেমেজেভাইট নামিবিয়া অঞ্চলেও পাওয়া যায়। মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে আছে এলুমিনিয়াম, বোরন, অক্সিজেন, ফ্লোরিন ইত্যাদি। এই জেমস্টোনের দৃঢ়তা প্রায় কোয়ার্টজের সমান।

১০) রেড বেরিল (Red Beryl)

রেড বেরিল

পান্না বর্গের অন্তর্গত রেড বেরিল (বা স্কারলেট বেরিল) সম্পর্কে প্রথম বিবৃত করা হয় ১৯০৪ সালে। যদিও এর রাসায়নিক গঠন পান্না বা আরো সঠিকভাবে একুয়ামেরিন-এর (Aquamarine; নীলাভ সবুজ বর্ণের পান্না) সদৃশ, তারপরেও রেড বেরিল পান্না হতে অত্যাধিক দুর্লভ। এই খনিজের লাল বর্ণের জন্য ক্রিস্টালে উপস্থিত ম্যাংগানিজ আয়নকেই দায়ী করা হয়। যদিও প্রকৃতিতে বিশুদ্ধ বেরিল বর্ণহীন হয়। নিউ মেক্সিকো ও উতাহ অঞ্চলেই এর বিস্তৃতি। এর বিশেষ লাল বর্ণের জন্য অনেক খনিজবিদের ধারণামতে এটি রুবির গোত্রের অন্তর্গত। রেড বেরিল সাধারণত স্বর্ণের থেকে প্রায় ১০০০ গুন বেশি মূল্যবান। এর মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে আছে বেরিলিয়াম, এলুমিনিয়াম, সিলিকন ও অক্সিজেন।

রত্নপাথর যে কেবল মাত্র মানুষের অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, এমনটা নয়। এসব রত্নপাথরের ক্রিস্টালগুলো আলোক-বিজ্ঞানে আলোক প্রকৃতি ব্যাখ্যায় যেমন ব্যবহার হয় মাঝে মধ্যে তেমনি বস্তুর ক্রিস্টালিনিটি ও এমর্ফসনেস (crystallinity & amorphousness) ব্যাখ্যায়ও এদেরকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়া হয়ে থাকে। তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রায় ৪,০০০+ রকমের খনিজ পদার্থ সঞ্চিত আছে, যাদের হয়তো বাস্তবে দেখা সম্ভব হবে না। এই বিপুল সংখ্যক খনিজের মধ্যে রত্নপাথরও যে থাকবে না, সেটাও অসম্ভব।

তথ্যসূত্র

১) io9.gizmodo.com/5902212/ten-gemstones-that-are-rarer-than-diamond

২) discovery.com/tv-shows/game-of-stones/

৩) truefacet.com/guide/top-10-rarest-gemstones/

৪) forbes.com/sites/trevornace/2015/11/02/12-most-expensive-gemstones-world/#41748db81538

Related Articles