বিবর্তনের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই পরিবেশে টিকে থাকার তাগিদে আমাদের জিন বিবর্তিত হয়েছে, প্রভাব বিস্তার করেছে আমাদের বৈশিষ্ট্যে ও জীবনধারায়। কিছু জিন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও আচরণে প্রভাব রেখেছে, যেগুলো সাধারণত অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি। খাবার, ব্যয় ও বিনিয়োগ, প্রতারণা, ভয় কিংবা ঘুমের মতো প্রতিদিনের কিছু বিষয়েও জিন ভূমিকা রাখে। এরকম কিছু আচরণের উপর জিনের প্রভাব নিয়ে আজকের আয়োজন।
কেনাকাটা
কেনাকাটার প্রতি মেয়েদের আগ্রহ পুরুষদের তুলনায় একটু বেশি এবং ছেলেরা কেনাকাটা করতে পছন্দ করে না, এমন ধারণা অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই প্রচলিত। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের জেফরি মিলার অবশ্য এই ধারণায় পানি ঢেলে দিয়েছেন। কারণ, তার মতে, জিনগতভাবে এই কেনাকাটার ব্যাপারটি প্রথম পুরুষদের মধ্যেই নিহিত ছিল। মানুষ যখন পরিধানের জন্য পশুর চামড়া বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিল, তখন এই চামড়া বিভিন্নভাবে সাজিয়ে আকর্ষণীয় করে মেয়েদের আকর্ষণ করার প্রবণতা ছিল পুরুষদের মধ্যে।
তাছাড়া শরীরে বিভিন্ন চিত্রকর্ম আঁকানো, পশুর হাড়, পাখির পালক কিংবা গহনা পরেও নিজেকে চিত্তাকর্ষক করে তুলত পুরুষরা। এরপর সময়ের ধারায় পুরুষরা কেনাকাটা ভালোবাসতে শুরু করল মেয়েদের চোখে ধনী ও আকর্ষণীয় হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার জন্য। প্রযুক্তির বিকাশে দামী গাড়ি, ঘড়ি, জামাকাপড় ও ব্যয়বহুল খাবারের পেছনে খরচ করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে পুরুষরা। কিন্তু, উদ্দেশ্য সেই আদিকালের মতোই। বলতে গেলে, লোক দেখানো বা ‘Showing off’। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্দেশ্য হাসিল বা যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাওয়ার পর, পুরুষদের মধ্যে এই অধিক কেনাকাটা বা লোক দেখানো খরচের প্রবণতা কমে যেতে থাকে।
চর্বি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি টান
মানুষকে একটা সময় কাটাতে হয়েছে এমন যে, তিনবেলা খাবারের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। শিকারি সেই মানুষরা শিকার করতে পারলে ভরপেট আহার মিলত, না পারলে অনাহারে যাপন করতে হত জীবন। কঠিন ছিল সেই সময়। এই কঠিন সময়ই বদলে দিল মানুষকে। কষ্ট সহিষ্ণু সময়ে টিকে থাকতে মানুষের দরকার ছিল অল্প খাবারেই অধিক শক্তি ও পুষ্টি। তাই, সময়ের প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে এমন এক জিন, যা খাবার থেকে যথাসম্ভব শক্তির আরোহণ করতে ভূমিকা রাখে। এই জিনকে বিজ্ঞানী জেমস নিল ১৯৬২ সালে নাম দেন ‘মিতব্যয়ী জিন’ বা ‘থ্রিফটি জিন’ (Thrifty genes)। মিতব্যয়ী জিনের কাজ হলো, খাবার থেকে প্রত্যেক ক্যালোরি নিষ্কাশিত করা এবং পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য জমা করে রাখা।
প্রশ্ন হলো, কেন পরবর্তী সময়ের জন্য জমা করতে হবে? আবারও ফিরে যাই প্রাগৈতিহাসিক সময়ের আফ্রিকার সেই প্রান্তরে, যখন শিকারি মানুষের নিয়মিত খাবারের নিশ্চয়তা ছিল না। খাদ্যবিহীন দিনগুলো বা দুর্ভিক্ষের সময়ে, টিকে থাকার জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজন ছিল মানুষের। সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ে এই কাজটি করত আমাদের থ্রিফটি জিন। যাদের শরীরে এই জিন ছিল, তারা খাবারের অভাবের সময়ও টিকে থাকতে পেরেছে। কিন্তু, অকাতরে মারা পড়েছে এই জিনবিহীন মানুষেরা। বিবর্তনের ধারায় সেই জিন আজ বহন করে চলেছি আমরা।
বর্তমান পৃথিবীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির জন্য দায়ী স্থূলতা সমস্যায় আপনি দায়ী করতে পারেন এই জিনকে। কার্যকর উপায়ে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য জিনটি যা করে তা হলো- আমরা এই জাতীয় খাবার গ্রহণ করলেই তা চর্বি বা ফ্যাটে রূপান্তরিত করে। কারণ, অন্য যেকোনো ধরনের খাবারের চেয়ে চর্বি সবচেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চয়ে সক্ষম এবং এটি অপেক্ষাকৃত হালকাও। তাছাড়া, এই মিষ্টিজাতীয় খাবার সহজেই হজম হয় এবং দ্রুত চর্বিতে রূপান্তরিত হয়। এক গ্রাম চর্বিতে ৯ ক্যালোরি জমা থাকে, যেখানে শর্করা ও প্রোটিনে প্রতি গ্রামে থাকে এর অর্ধেক। বিবর্তনের ধারায় পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া এই জিন বলতে গেলে আমাদের বাধ্য করে চর্বি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে। অর্থাৎ, এই জাতীয় খাবারের প্রতি একধরনের টান মানুষের মধ্যে বিবর্তিত সেই প্রাগতৈহাসিক সময় থেকেই। অত্যধিক পরিমাণে চর্বি ও মিষ্টি জাতীয় খাদ্যপ্রেমীরা এখন ভেবে দেখতে পারেন, দোষ আসলে কার! আপনার, নাকি থ্রিফটি জিনের?
মাকড়শা ভীতি
মাকড়শা দেখে মানুষের ভয় পাওয়ার অতি সাধারণ একটি ঘটনা। যদিও, সাধারণত আমাদের বাসস্থানের আশেপাশে থাকা বেশিরভাগ মাকড়শা এমন বিষাক্ত নয় যে, কামড় দিলে মারা যাব। মাকড়শা ভীতির কারণ প্রোথিত রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে, আফ্রিকায় মানুষের বিবর্তনের শুরুর দিকের সেই সময়ে যখন মাকড়শা ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী প্রাণী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, জশোয়া নিউর মতে, আফ্রিকায় তখন প্রাণঘাতী বিষাক্ত মাকড়শা ও মানুষের একইসাথে বসবাস ছিল। তখন এসব বিষাক্ত মাকড়শার জন্য মানুষের জীবন অত্যন্ত ঝুঁকি ও হুমকির মুখে ছিল। কারণ, সামান্য একটি কামড়ও হয়তো জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
গবেষক জশোয়া ও তাসমিনের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের মধ্যে মাকড়শা ভীতি এত গভীরভাবে ঢুকে পড়ে যে, তা আমাদের জেনেটিক পর্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তাই, তখন যাদের মধ্যে দ্রুত মাকড়শা বা সাপের মতো বিষাক্ত প্রাণী শনাক্ত করার জিন ছিল, তারা পরিবেশে টিকে থাকার ব্যাপারে এগিয়ে ছিল।
ছয়-সাত মাসের বাচ্চাদের যদি সাপ ও মাকড়শার ছবি দেখানো হয়, তাহলে তাদের মধ্যেও একধরনের চাপ বা ভীতির সঞ্চার হয়। প্রাণীগুলো বিষাক্ত বা ক্ষতিকারক এই ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট ধারণা তখনও তৈরি হওয়ার কথা নয়। ফুল ও মাছের ছবি দেখার পর একই শিশুদের প্রতিক্রিয়া ঠিক একই রকম ছিল না।
এই মতবাদের সাথে অবশ্য প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন মে একমত নন। তার মতে, এই ভীতি মানুষের জিন দ্বারা ততটা নিয়ন্ত্রিত নয়। মানুষ মাকড়শা ভয় পায় কারণ এর গাঢ় রঙ, লোমশ আটটি পা ও লক্ষ্যভ্রষ্ট চলাচলের জন্য, যা মানুষের চোখে স্বাভাবিক নয়। শিশুদের মধ্যে এই ভীতির অনুপ্রবেশ ঘটে মাকড়শা দেখার সময় বাবা-মা বা ভাই-বোনদের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখার মধ্য দিয়ে।
প্রতারণা
যদি বলা হয়, প্রতারণার জন্য সরাসরি পুরুষ নয়, তার শরীরের একটি জিন দায়ী, তাহলে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই, তাই না? কিন্তু ২০১০ সালে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই এক চিত্র। বিংহ্যামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জাস্টিন গার্সিয়ার অধীনে একদল গবেষক পরীক্ষা চালান ১৮১ জনের একদল পুরুষ অংশগ্রহণকারীর উপর। যেখানে সবার ডিএনএ নমুনা নেয়ার পাশাপাশি যৌনতার অভ্যাস সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছিল। দেখা গেছে, সেসব পুরুষেরই প্রতারণা করার সম্ভাবনা রয়েছে বা তারাই সম্ভাব্য প্রতারক, যাদের ডিএনএ’তে DRD4 নামের নির্দিষ্ট জিন বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই, শুধুমাত্র রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্যই প্রতারণার প্রবণতাও ছিল লক্ষ্যণীয়।
অবশ্য, এই গবেষণাই শেষ কথা নয়। কারণ কিছু গবেষক মনে করেন, মাত্র ছোট একটি সংখ্যার মানুষের উপর চালানো এই গবেষণা এমন উপসংহারে আসার জন্য যথেষ্ট নয়। পরিবেশ, জীবনের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ইত্যাদি প্রতারণা করার ব্যাপারে প্রভাবিত করে।
ব্যয় ও বিনিয়োগ
জীবনযাত্রার উপর জিনের প্রভাব নিয়ে ১৫,০০০ যমজের মধ্যে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক স্টেফান ও হেনরিক দেখলেন, তারা যদি একসাথে বসবাস না-ও করেন, তবুও তাদের মধ্যে ব্যয় করার ক্ষেত্রে একই রকম স্বভাব বিদ্যমান। একইসাথে দেখা যায়, আমাদের জিনই নির্ণয় করে আমাদের ব্যয়, বিনিয়োগ ও অর্থ জমানোর মতো অর্থনৈতিক বিষয়গুলো। মজার ব্যাপার হলো, এই গবেষকদের মতে, ২৫ বছর পর্যন্ত ব্যয় ও জমানোর ব্যাপারটি বাবা-মা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিচালিত হলেও, ৪০ এর পর মঞ্চে হাজির হয় আমাদের জিন এবং প্রভাবিত করে অর্থব্যয় ও জমানোর বিষয়টি।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যদি আপনি অতীতে সাফল্য পেয়ে থাকেন, তাহলে দেখা যায় পরবর্তীতে বিনিয়োগের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। যদিও, পরবর্তীতে যে সাফল্য আসবে সেই নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে ব্যবসায় কতটা ঝুঁকি একজন নিতে পারে বা আগ্রহী, এটিও জিন দ্বারা প্রভাবিত।
ব্যয় যেমন জিন দ্বারা প্রভাবিত, তেমনি মিতব্যয়িতাও। গবেষক হার্স সেফরিনের মতে, জিন আমাদের মিতব্যয়ী হিসেবে গড়ে তোলে। অবশ্য, মাত্র ২৫% মানুষের মধ্যে মিতব্যয়ীতার এই জিন বিদ্যমান এবং বাকিরা অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যয়ের জিনের ধারক।
ঘুম
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য একজন মানুষের গড়ে সাত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। কমপক্ষে ছয় ঘণ্টার কম সময় ঘুমানো মানুষদের মধ্যে ধীরে ধীরে অবসন্নতা, ক্লান্তি, দুর্বলতা ও বিষন্নতাসহ আরও অন্যান্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি ঠিকমতো চিন্তাও করতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু, কিছু মানুষ আবার অপেক্ষাকৃত কম ঘুমিয়েও বা খুবই অল্প ঘুমিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম।
ঘুম সংক্রান্ত একটি গবেষণার প্রধান রেনেটা পেল্লেগ্রিনো ও তার দল ১০০ যমজের মধ্যে একটি পরীক্ষা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একদল পর্যাপ্ত সময় না ঘুমানোর পরও কোনোো রকম সমস্যা ছাড়াই তাদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে সমস্ত কাজ করে যেতে সক্ষম। দেখা গেছে, এই দলের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে p.Tyr362HIS নামের একটি জিন রয়েছে। এই জিনটি ‘থ্যাচার জিন’ নামেও পরিচিত। কারণ, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার খুব অল্প ঘুমের জন্য পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে, অপর দলের মানুষের মধ্যে এই থ্যাচার জিন না থাকার দরুন, অপর্যাপ্ত ঘুমের জন্য মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দুর্বল হতে দেখা গেছে। তাছাড়া, অনেকেই মনে করে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলেও তারা তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা অব্যাহত রাখতে সক্ষম। কিন্তু, গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জনের এই ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
This article is in Bangla language. It is about things are controlled by genes surprisingly. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: sfari.org